Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

কমিশন-তন্ত্র

‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি’র যুক্তিতে সপ্তম দফায় রাজ্যের এই বারের ভোট-অধীন নয়টি কেন্দ্রে নির্বাচনী প্রচার অন্য রাজ্যগুলি অপেক্ষা সতেরো ঘণ্টা আগে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গ এই বারের ভোটে নির্বাচনী হিংসার নিরিখে যে সমগ্র দেশের মধ্যে একেবারে উপরের দিকে স্থান পাইতেছে, সেই বিষয়ে কোনও তর্ক চলে না। কিন্তু তাহার পরও একটি কথা থাকিয়া যায়। এখনও পর্যন্ত চারিদিকের ছবিটি যেমন, তাহাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নির্দিষ্ট বাহিনী দিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করিতে পারিবার কথা নহে। বিশেষত যখন এই রাজ্যে বিরাট সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী মজুত রহিয়াছে— সেই ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার আরও সক্রিয় প্রচেষ্টা কেন করা হইতেছে না, ইহাই একটি বড় প্রশ্ন হইতে পারে। গত কয়েক দফায় প্রকাশ্যতই এমন অনেক দৃশ্য দেখা গিয়াছে, যেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং (নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন) পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সম্মুখে ঘটিয়াছে বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষ। সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ মানিয়া পশ্চিমবঙ্গের উপর নির্বাচন কমিশন যে বিশেষ পরিস্থিতি আরোপ করিল, তাহা কেবল অভূতপূর্ব নহে, এই সিদ্ধান্তের নৈতিকতা লইয়াও বড় রকমের প্রশ্ন ওঠে।

সংবিধানের এই ধারা এক রকমের জরুরি অবস্থা জারি রাখিবার সুযোগ করিয়া দেয়, যেখানে রাজ্য প্রশাসনের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের অনেকখানি দায়িত্ব বর্তায় নির্বাচন কমিশনের উপর। ইহা রাষ্ট্রপতির শাসন অপেক্ষা মাত্র কয়েক ধাপ কম— যে হেতু রাষ্ট্রপতি তথা কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত নির্বাচন কমিশন এই ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্বে থাকে। অর্থাৎ রাজ্য সরকারের বদলে সরাসরি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের হাতেই রাজ্যের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। নির্বাচন কমিশনের এই বিপুল ক্ষমতার কারণেই ক্ষমতা প্রয়োগের নৈতিকতার প্রশ্ন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচনের শেষ পর্বে কমিশনের এত বড় একটি পদক্ষেপ কেবল বিস্মিত করে না, বিচলিতও করে। সঙ্কট মুহূর্তে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকিবে, এবং, তাহার পর, সঙ্কট ঘটিবার যুক্তি দিয়া ৩২৪ ধারা আরোপ করা হইবে? ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের অনুজ্ঞা অনেকখানি ছাঁটিয়া না ফেলিলে এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় কি?

অন্য একটি প্রশ্নও থাকে। ‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি’র যুক্তিতে সপ্তম দফায় রাজ্যের এই বারের ভোট-অধীন নয়টি কেন্দ্রে নির্বাচনী প্রচার অন্য রাজ্যগুলি অপেক্ষা সতেরো ঘণ্টা আগে বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। অন্য রাজ্যের প্রচার আজ বিকাল পাঁচটা অবধি যথারীতি চলিবে। বিভিন্ন মাধ্যমে সেই প্রচার পশ্চিমবঙ্গে আসিয়াও পৌঁছিবে। অর্থাৎ রাজ্যের দলগুলির প্রচার বন্ধ হইলেও প্রকারান্তরে সর্বভারতীয় (কেন্দ্রীয়) দলের প্রচার মানুষের নিকট পৌঁছাইতে অসুবিধা হইবে না। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তে কেন কোনও কোনও পক্ষ হইতে শাসক দলের সহিত ‘ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগ উঠিতেছে, বুঝিতে অসুবিধা নাই। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ও রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকে আকস্মিক ভাবে, গুরুতর কারণ ছাড়াই, পদ হইতে সরাইয়া দিবার যে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হইয়াছে, তাহাও স্বভাবতই একটি প্রশ্নের কুয়াশা তৈরি করিতেছে। কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগের কিয়দংশও যদি সত্য হয় তাহা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলিতে হইবে। জাতীয় নির্বাচনের সময় এই ভাবে আংশিক রাজনৈতিক সমাজের কণ্ঠরোধ কেবল অনুচিত নহে, ভারতীয় গণতন্ত্রের উপর এক বিষম আঘাত। ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার দলের অনেকগুলি অনিয়ম ও অনাচারকে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়া বিচার করে নাই। ‘মডেল কোড অব কন্ডাক্ট’ বা এমসিসি-তে স্পষ্টাক্ষরে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী তাঁহার নির্বাচনী বক্তৃতায় সেনাবাহিনীকে দলীয় আজেন্ডার অংশীভূত করিয়াছেন, এবং কমিশন তাহা অন্যায় হিসাবে গণ্য করে নাই। সব মিলাইয়া যে পরিস্থিতি উদ্ভূত হইয়াছে, তাহা যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অনুকূল নহে। এই বারের লোকসভা নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র ও তাহার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক সংশয়ের জন্ম দিয়া গেল।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE