Advertisement
E-Paper

পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, সুন্দরবনের জীবনও

এত দিন আবহাওয়ার পরিবর্তনের কথা বিশেষজ্ঞ, সরকারি অফিসার, টিভির পর্দার আলোচনা থেকে জেনেছেন সুন্দরবনের মানুষ। এখন নিজেদের জীবনে সেটা অনুভব করতে পারছেন।মাটিতে বসানো সার দিয়ে রাখা কাঠের বাক্সের ভিতরে বসানো মৌচাক। বাক্সের বাইরে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি। সাঁ করে নদীর দিকে ধেয়েও যাচ্ছে অনেকে। বাক্সগুলি যিনি বসিয়েছেন সেই সুবল মাইতির মুখে তবু হাসি নেই। বছরের এই সময়টায় সুন্দরবনের বাদাবনে ফুলের মরসুম।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০০

মাটিতে বসানো সার দিয়ে রাখা কাঠের বাক্সের ভিতরে বসানো মৌচাক। বাক্সের বাইরে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি। সাঁ করে নদীর দিকে ধেয়েও যাচ্ছে অনেকে। বাক্সগুলি যিনি বসিয়েছেন সেই সুবল মাইতির মুখে তবু হাসি নেই। বছরের এই সময়টায় সুন্দরবনের বাদাবনে ফুলের মরসুম। খাঁড়ি দিয়ে যেতে যেতে সিঁদুরে রঙের ফুল চোখ টানে। সুন্দরী গাছের ফুল। তবু কেন মুখভার সুবল মাইতির?

“প্রতিটি বাক্সে থাকা মৌচাক ১০ দিন পর পর ভাঙি আমরা। অন্তত ১২ থেকে ১৩ কেজি মধু সংগ্রহ হয় ওই ১০ দিনে। কিন্তু এ বার ১০ দিনে ২ থেকে ৩ কেজির বেশি মধু হচ্ছে না,” মুখের কাছে উড়ে আসা একটি বড় সাইজের মৌমাছিকে গামছা দিয়ে সরিয়ে মন্তব্য করলেন সুবল।

প্রতিটি বাক্সে রয়েছে একটি করে রানি মৌমাছি। হাজার হাজার শ্রমিক মৌমাছিও বাক্স ভরে ফেলেছে। তা হলে পর্যাপ্ত মধু হচ্ছে না কেন? রাজ্যের সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম অধিকর্তা সুভাষ আচার্য বুঝিয়ে দিলেন, “আপনি ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি দেখেছেন সেটা যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি সুবল মাইতির বিলাপও।”

সুন্দরবনের পরিকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্ত সুভাষবাবু বলেন, চৈত্র মাস পড়ে গেল। বছরের এই সময়টায় দক্ষিণ দিক থেকে হাওয়া বয়। উথালপাথাল হাওয়া। মৌমাছিরা ওই হাওয়ায় ভর করেই গ্রাম থেকে উড়ে এসে বিদ্যা নদী পেরিয়ে চলে যায় জঙ্গলে। ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে তা নিয়ে আসে বাক্সের মৌচাকে। কিন্তু এ বার দখিনা হাওয়ার দেখা নেই। তার বদলে বইছে উত্তুরে হাওয়া। আর সেই ‘অপরিচিত’ হাওয়া সমুদ্র পেরিয়ে যেতে দিচ্ছে না মৌমাছিদের। নদীপথে একটু এগিয়েই ফের গ্রামে ফিরে যাচ্ছে ওরা। গ্রামে পর্যাপ্ত গাছ নেই। যে ক’টা আছে সেগুলি থেকেই মধু নিয়ে মৌচাকে রাখছে মৌমাছিরা। “তার পরিমাণ এতই কম, সুবল মাইতিদের লাভ হবে কী করে?” সুভাষবাবুর মন্তব্য।

সুবল মাইতিরা সুন্দরবনের স্থায়ী বাসিন্দা নন। বাক্সের মৌচাক, তার মধ্যে থাকা মৌমাছির ঝাঁক আর রানি মৌমাছিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান সুন্দরবন, মালদহ, মুশির্দাবাদ আর দার্জিলিঙের পাহাড়ে। আমের ফুলের মধু, লিচুর ফুলের মধু, কমলালেবুর মধু সংগ্রহ করেন ওঁরা। যে ফুল যখন যেখানে ফোটে সেখানেই বাক্স নিয়ে হাজির হন সুবলের মতো শ’খানেক লোক। তা হলে তাঁদের লাভ-লোকসানে সুভাষ আচার্যের কী?

বালি দুই নম্বর ঘুরে বোঝা গেল, কেন এত উদ্বিগ্ন সুভাষবাবুরা। প্রতি বছর সুবল মাইতিদের বছরের এই সময়টায় গ্রামে এসে প্রচুর পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে দেখে গ্রামের মাতব্বরদের একটা ভাবনা মাথায় এসেছিল। তাঁদের গ্রামের মানুষেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে মধু সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন। অথচ সুবলদের জঙ্গলেই যেতে হচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে না গিয়ে সুবলদের মতো গ্রামে বসেই মধু সংগ্রহ করা কী না, সেই ভাবনাটা সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের কর্তাদের বলব বলব করছিলেন মাতব্বরেরা। কিন্তু এ বার চৈত্র মাসে হাওয়ার মতিগতি আর সুবলদের হা-হুতাশ দেখে নিজেদের ভাবনাটা আর বাইরে প্রকাশই করছেন না বালি ২-এর মানুষ।

আবহাওয়ার পরিবর্তন সুন্দরবনের মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তাঁরা আর ঝুঁকি নিতে রাজি নন। এত দিন আবহাওয়ার পরিবর্তনের কথা বিশেষজ্ঞ, সরকারি অফিসার, টিভির পর্দার আলোচনা থেকে জেনেছেন সুন্দরবনের মানুষ। এখন অনুভব করতে পারছেন। ১৮ মার্চের সকালের কথাই ধরা যাক না কেন। নামখানায় নোঙর করে ছিল আমাদের জাহাজ এম ভি পরমহংস। সকালের আকাশে ঘন কুয়াশা। এক হাত দূরের জিনিস ভাল করে ঠাহর করা যাচ্ছে না। কুয়াশার আস্তরণের মধ্য দিয়ে এক সময় সূর্য উঁকি মারল। যেন চৈত্র নয়, পৌষ-মাঘের সকাল। সকালে এমন কুয়াশা থাকলে দখিনা বাতাস কোথা থেকে ঢুকবে?

সুবল মাইতি, ভবেশ পাঁজা-রা বুঝতে পারছেন সব কিছু ঠিকঠাক চলছে না। নামখানার ট্রলার মালিক ভবেশ বলেই ফেললেন, “সবাই বলছে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। এ বার তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। নদীতে মাছ কমে গিয়েছে। বছরের এই সময় যদি কুয়াশা পড়ে, এমনটা তো হবেই। মাছেদের দোষ কোথায়?”

বর্ষার পিছিয়ে যাওয়া, গ্রীষ্মের সময়ে অত্যধিক গরম পড়া, সবই একফসলি জমিতে ফলন কমিয়ে দিয়েছে। আবার ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ে নদীবাঁধ ভেঙে লবণাক্ত জল ঢুকে পড়ছে চাষের জমিতে। ২০০৯ সালে আয়লায় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষের জমি, পুকুর ভরে গিয়েছিল নোনা জলে। তার পরের বছরগুলিতে ভাল বৃষ্টি হয়নি। তাই মাঠের লবণাক্ত ভাব কমেনি এতটুকুও। অনেক জায়গায় পুকুরের জল সেঁচে তুলে ফেলে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে রাখা হলেও, তার নুনের ভাগ পুরোপুরি কমিয়ে আনা যায়নি।

গোমর নদীর ধারে গ্রাম সোনাগাঁ সাত নম্বরে বাড়ি প্রতিমা রায়ের। বছর ত্রিশের প্রতিমার বাড়ির দক্ষিণ দিকেই বিশাল নদীবাঁধ ছিল। ২০০৯ সালের আয়লায় সেই বাঁধ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। উত্তর দিকে তৈরি হয়েছে নতুন একটি নদীবাঁধ। দুই বাঁধের মাঝে প্রতিমার বাড়িটা একটা দ্বীপের মতো। চার দিকে মাটির ঢিবি ফেলে একটা উঁচু জায়গা করা হয়েছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে প্রতিমার বাড়ি। আয়লার মতো ঝড় এলে সেই বাড়ি মিশে যাবে নদীগর্ভে। তখন স্ত্রী, দুই পুত্র নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন সেই ভাবনায় রাতে ঘুম হয় না ভুলুর।

নতুন বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে ভুলু বলেন, “বাড়ির সামনে এখন যে পুকুরের মতো জায়গাটা দেখছেন ওখানে আগে ধান চাষ হত। বছরে এক বার। সেই জমিও গিয়েছে। যেখানে চাষ হত সেখানে এখন সারা দিন জাল ও বঁড়শি ফেলে আমরা চার জন মাছ আর কাঁকড়া ধরি। এটাই এখন আমাদের জীবন ও জীবিকা।”

রাতে ঘুম হয় না প্রতিমারও। সুন্দরবনের গৃহবধূ বলেন, “দু’ছেলেকে বুকে আগলে জেগে কাটাই। স্বামী নদীর দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে থাকে। কাটতেই চায় না রাতটা। নদী সব নিয়েছে। আবার নদীর ভরসাতেই বেঁচে থাকি। সে না থাকলে মাছ, কাঁকড়া পেতাম কোথায়?” আয়লায় নদীবাঁধ ভেসে যাওয়ায় অনেকেই সরে গিয়েছেন অন্যত্র। ভুলু কোথাও সরতে পারেননি। “যাব কোথায়? এইটুকুই তো ভিটে। এখান থেকে উঠে যেতে হলে বউ-বাচ্চা নিয়ে চলে যেতে হবে ক্যানিং, ডায়মন্ড (ডায়মন্ডহারবার) বা কলকাতায়। না হলে বাঁচব কী করে?” নদীর পাড় যত ভাঙছে, নতুন নতুন এলাকা চলে যাচ্ছে নদীগর্ভে। বাড়ছে ভুলু-প্রতিমাদের সংখ্যা।

১৯ মার্চ দুপুরে যখন প্রতিমাদের গ্রামে গেলাম তখন নদীতে জোয়ার। প্রতিমার দুই কিশোর ছেলে গামছা পরে এক গলা জলে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে মা। তিন জনের হাতেই খাপলা জাল। জোয়ারের জলে ভেসে আশা পার্শে, ভাঙন, কাঁকড়া, যা পড়বে সেটাই লাভ। প্রতিমা বলেন, “নিজের ও জমিটা ছিল বলেই তো যে মাছটা পাই তার পুরোটা আমাদের। না হলে অনেক ভাগীদার জুটে যেত যে!”

অন্য বিপদও আছে। পরিবেশ দূষণ এবং আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় সমুদ্রজলের তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বেড়ে গিয়েছে সমুদ্র জলের উচ্চতা। বিজ্ঞানীদের সতর্কতায় কেউ আমল না দেওয়ায় ইতিমধ্যেই তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জম্বু দ্বীপের বড় অংশটাই ডুবে গিয়েছে। ডুবছে মৌসুিম দ্বীপও। সেখানকার মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছেন। কেউ অন্য দ্বীপে উঠে গিয়েছেন, কেউ বা জঙ্গলের ধারে নতুন বসতি করেছেন। মানুষের সঙ্গে বনের প্রাণীর সংঘাত বাড়ছে।

পরিস্থিতির সঙ্গে যাঁরা লড়াই চালাতে পারছেন না তাঁরা কলকাতায় পাড়ি দিচ্ছেন। সুন্দরবনের মানুষকে দ্বীপভূমিতে ধরে রাখতে বিকল্প পেশার খোঁজ চলছে। বাক্সে মধুচাষ তার মধ্যে যেমন একটা। হাওয়ার পরিবর্তন সেই প্রস্তাবের বাস্তবায়নের উপরে বড় প্রশ্নচিহ্ন বসিয়ে দিয়েছে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জাহাজ, লঞ্চের পোড়া তেল, মোবিল। ট্যাঙ্কার থেকে তেল উপচে নদীতে পড়লে জঙ্গলের কী হাল হয় তা বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার শেলা নদীর দুই দিকের গোলপাতা গাছগুলির হাল দেখলেই বোঝা যায়। নদীর জলের উপরে যেমন তেলের সর পড়েছে, তেমনই তেলের আস্তরণ জোয়ারের জলের সঙ্গে গোলপাতা গাছের পাতায় মিশেছে। গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোনও বড় জাহাজ ওই নদীপথে যায় না। কেবল যায় মালবাহী ট্রলার। তার থেকে চুঁইয়ে পড়া তেলে নদীর দফারফা। প্রাণীদের উপরে দূষণের প্রভাব এখনও অজানা।

environment of sundarban sundarban environment sundarban danger honey collector honey bee abp post edit debdut ghosh thakur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy