আমার ধর্ষিতা কন্যা ভাল আছে’— অফিসের টেবিলে কাগজে লেখা ছোট্ট একটা প্ল্যাকার্ড। চেয়ারে বসে এক প্রৌঢ়, যাঁর কন্যাটি ধর্ষিতা হওয়ার পর সহকর্মীদের উৎকট কৌতূহলের জবাব দিতে দিতে দৃশ্যত বিধ্বস্ত।
এটা সাম্প্রতিক কোনও ঘটনার বিবরণ নয়, একটা বাংলা সিনেমার দৃশ্য মাত্র। সিনেমাটির নাম আদালত ও একটি মেয়ে, নির্মিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় চুয়াল্লিশ বছর আগে। চিত্রটি আজও যে বিন্দুমাত্র বদলায়নি, একের পর এক ঘটনা থেকে স্পষ্ট। সে দিনের মতো আজও প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে ঘটনার সত্যতা নিয়ে। তার পর নানা কৌশলে বিষয়টিকে লঘু করে দেখানোর জন্যে নেমে পড়ে একদল মানুষ। প্রথমেই শুরু হয় তথ্যপ্রমাণ লোপাট অথবা বিকৃত করার প্রয়াস। অতঃপর তদন্ত প্রক্রিয়াটিকে বিপথে চালিত করার তৎপরতা। একই সঙ্গে ধর্ষিতার চরিত্র, চালচলন, পোশাক অথবা সমাজের জেঠামশায়দের বেঁধে দেওয়া স্থান-কাল-পাত্র লঙ্ঘন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ধর্ষকের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক, ফাঁসিয়ে অর্থোপার্জনের চেষ্টা, শারীরিক বিকিকিনিপ্রসূত আর্থিক বিরোধ-সহ নানা আজগুবি তত্ত্ব হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিপাদ্য একটাই, হয় সাজানো ঘটনা, নয়তো ঘটনার জন্যে ধর্ষক নয়, দায়ী ধর্ষিতা।
ওই সিনেমায় ধর্ষিতার পিতা কন্যার ভবিষ্যৎ এবং সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে প্রথমে ঘটনাটা চেপে যেতে চেয়েছিলেন এবং তদন্তকারী অফিসারদের সেই মর্মে অনুরোধও করেছিলেন। কী অদ্ভুত পরিচিত ঘটনা, আজও আমাদের কাছে! গ্রামগঞ্জে তো বটেই, তথাকথিত শহুরে শিক্ষিত সমাজে প্রগতিশীল এবং সংস্কারমুক্ত বলে দাবি করা অনেক মানুষের কাছে আজও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রাক্শর্ত হল নারীর সতীত্ব। অদ্ভুত ভাবে পুরুষের যৌন-সততা নিয়ে কখনও প্রশ্ন ওঠে না। মধ্যযুগীয় সংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ সমাজ ধর্ষিতা রমণীকে সসম্মানে গ্রহণ করা দূরে থাক, তার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। আজও আধুনিকমনস্কতার সরব দাবিদার যুবকদের বেশির ভাগই সহানুভূতি নিয়ে পাশে থাকার পরিবর্তে ওই সিনেমায় ধর্ষিতার প্রেমিকের মতো অবলীলায় প্রণয়িণীকে ত্যাগ করতে দ্বিতীয় বার ভাবে না, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতদের বিরূপ সমালোচনা উপেক্ষা করে ধর্ষিতাকে বিয়ে করার সাহস খুব কম মানুষই দেখাতে পারে।
তবে পরিবর্তন যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। শিক্ষাঙ্গনে, হাসপাতালে, কর্মক্ষেত্রে, চলন্ত ট্রেন-বাসে, এমনকি নিজের বাড়িতেও অহরহ যৌন-নির্যাতন ঘটছে বটে, তবে এ-সব যেন নাগরিক সমাজকে আর তেমন ভাবে বিচলিত করে না। আর জি কর কাণ্ডে ভারতবর্ষ তো বটেই, বিশ্বের নানা প্রান্তে যে ভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, তাতে অনেকেই আশা করেছিলেন, যে পড়ুয়া-চিকিৎসকটির ন্যায়বিচারের সঙ্গে দোষীদের কঠোরতম শাস্তির মাধ্যমে হয়তো ভবিষ্যতের ধর্ষকরা বার্তা পাবে। কিন্তু কুশলী রাজনীতির মারপ্যাঁচে ওই ঘটনার তদন্তের মতোই গণপ্রতিবাদের সাফল্য নিয়েও হয়তো কিছুটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এক দিকে লোলুপ পুরুষ যেমন বেপরোয়া, তেমনই শাসক আরও বেশি উদ্ধত।
আর এই বাড়বাড়ন্তের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানের জন্যে আবার ওই সিনেমাতেই ফিরে যেতে হয়। সেখানে ধর্ষিতার মামলাটি শেষ পর্যন্ত আদালতে পৌঁছেছিল যে দু’জন পুলিশ অফিসারের অনড় মনোভাবের জন্যে, নিজের আখের বন্ধক রেখে ন্যায়প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইনি এখন কেবল গল্পের চরিত্র মাত্র। বাস্তবে, নিগ্রহ কিংবা শ্লীলতাহানির মতো গুরুতর অভিযোগ জানাতে গেলে কাউকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়, আবার কাউকে ছুটতে হয় এক থানা থেকে আর এক থানায়, মুখোমুখি হতে হয় নানা অস্বস্তিকর প্রশ্নের। অবশ্য রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের সঙ্গে নৈকট্য থাকলে কিংবা তাঁদের শরণ নিলে ভোগান্তি কিছুটা লাঘব হয় বটে, তবে তার জন্যে কখনও কখনও চড়া মূল্যও দিতে হয়। আর অভিযোগ জানাতে পারলেই যে সব সময় সুবিচার মেলে, এমনটাও নয়। এক দিকে আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, অন্য দিকে অদক্ষতার কারণেই হোক বা উপরওয়ালার ইচ্ছায়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কেস ডায়েরি এবং চার্জশিটে এমন সব ছিদ্র রাখা হয়, যা গলে অপরাধী আদালত চত্বর থেকে হাসতে হাসতে ফুলের মালা গলায় পরে বীরবিক্রমে ঘরে ফেরে। এ রাজ্যের কামদুনির কলেজছাত্রী, গুজরাতের বিলকিস বানো বা উত্তর প্রদেশের দলিতকন্যা, প্রতিটি ধর্ষণ মামলার ফলাফল ধর্ষকদের পক্ষে প্রেরণাদায়ক।
তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিবর্তন এসেছে রাষ্ট্রের ভূমিকায়। ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটলে নীতিগত ভাবে নিগৃহীতার সুবিচার এবং অপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা সুনিশ্চিতকরণের আশ্বাস দেওয়া হলেও কার্যক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় তার আচরণ হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষের মতো। সাংবিধানিক পদাধিকারীদের অনেকেই তদন্ত শুরুর আগে গনতকার-সদৃশ নানা মত এবং সন্দেহ প্রকাশ করতে নির্দ্বিধ। আর তাঁদের সমর্থনে আনুগত্য প্রদর্শনে ব্যগ্র দক্ষ অনৃতভাষী ভাতাজীবী তার্কিকের অভাব ঘটে না। শুরু হয় গোয়েবলসীয় কায়দায় বারংবার নানা বিকৃত, অসত্য এবং অর্ধসত্য তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে ঘটনাকে আড়াল করার অশুভ প্রয়াস। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করার অগ্রাধিকারে ইতিহাস ঘেঁটে তুলে আনা হয় অতীতবৃত্তান্ত।
দেশের প্রচলিত আইনে কন্যাভ্রূণ হত্যা নিষিদ্ধ হলেও ভবিষ্যতের বাবা-মায়েরা যদি কন্যাসন্তানের জন্ম দিতে নিরুৎসাহিত হন, তা হলে শাসনের নামে তাঁদের বেড়ি পরানো যাবে কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)