Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Plastic

মানুষের রক্তেও এখন প্লাস্টিক

জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট, দুধের প্যাকেট থেকে শুরু করে ফেসওয়াশ, কসমেটিক্স, এমনকি প্রাণদায়ী ওষুধও বিকোচ্ছে এখন প্লাস্টিক কন্টেনারে।

নবনীতা দত্ত
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪২
Share: Save:

এত দিন তিমি, কচ্ছপজাতীয় প্রাণীদের শরীরে পাওয়া যাচ্ছিল প্লাস্টিকের অবশিষ্টাংশ। এড়িয়ে চলতে অভ্যস্ত মনুষ্যজাতির তা গায়ে না লাগারই কথা। তবে এ বার যে খোদ মানুষের রক্তে মিলল প্লাস্টিকের অবশিষ্টাংশ। একটি গবেষণায় শতকরা প্রায় আশি শতাংশ মানুষের রক্তে পাওয়া গিয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। অ্যামস্টারড্যামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোটক্সিকোলজিস্ট ডিক ভেথাকের কথায়, তাঁদের গবেষণায় এই প্রথম মানুষের রক্তে পাওয়া গিয়েছে পলিমার পার্টিকলস। এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ২২ জন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক, যাঁদের মধ্যে ১৭ জনের রক্তপরীক্ষাতেই পাওয়া গিয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। তাঁদের মধ্যে কারও শরীরে পাওয়া গিয়েছে পেট প্লাস্টিক যা দিয়ে তৈরি হয় জলের বোতল, কারও শরীরে মিলেছে পলিস্টেরাইন, যা থাকে খাবারের কন্টেনারে। আবার কিছু মানুষের রক্তে মিলেছে পলিইথাইলিন, যা দিয়ে তৈরি হয় প্লাস্টিকের ছোট ক্যারি ব্যাগ। এক-এক জনের শরীরের রক্তে আবার দু’-তিন রকমের প্লাস্টিকও মিলেছে। কী ভাবে তা রক্তে প্রবেশ করছে, এখনও গবেষণাসাপেক্ষ।

তবে রক্তে এক বার মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেলে, তা বিভিন্ন অর্গ্যানে যে সহজে পৌঁছে যেতে পারে, তা বোঝা কঠিন নয়। ডেকে আনতে পারে নানাবিধ রোগব্যাধি, যা হতে পারে প্রাণঘাতী। প্লাস্টিক দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর জায়গায় রয়েছে শিশুরা। কারণ গবেষণায় এ-ও স্পষ্ট যে, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বাচ্চাদের মলে প্রায় দশগুণ বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে তাদের শরীরেও ব্যাপক হারে প্রবেশ ঘটছে এই বিষাক্ত বস্তুর। বিজ্ঞানীদের মতে, প্লাস্টিকের ব্যবহার এখনই বন্ধ না করলে ২০৪০ সালে এই পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়ে যাবে প্রায় দ্বিগুণ। তখন মনুষ্যশরীরে এই ‘প্লাস্টিক’রূপী ভাইরাসের দাপট কি রোখা যাবে?

জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট, দুধের প্যাকেট থেকে শুরু করে ফেসওয়াশ, কসমেটিক্স, এমনকি প্রাণদায়ী ওষুধও বিকোচ্ছে এখন প্লাস্টিক কন্টেনারে। একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে যেমন প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা প্রয়োজন, তেমন সরকারেরও হস্তক্ষেপ জরুরি। সরকার প্রণীত নিয়ম ছাড়া প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করা কষ্টকল্পনা। দেশের সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড এ বছরের জুলাই মাস থেকে সিঙ্গল-ইউজ় প্লাস্টিকে তৈরি ব্যবহার্য, চামচ, ক্যান্ডি স্টিক, ইয়ারবাডস ইত্যাদির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চলেছে। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যক্ষেত্রে কতটা বলবৎ হবে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এর আগেও ৫০ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিকের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু এখনও তা বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে পাড়ার দোকানে, গৃহস্থালিতে। যা হয়তো পরে মিলবে মানুষের রক্তে। তাই শুধু নীতি প্রণয়ন করে নিশ্চিন্ত হলেই চলবে না, সেই নিয়মের রশিতে বাঁধতে হবে সকলকে। আর তা যে দুঃসাধ্য নয়, তা দেখিয়ে দিয়েছে সিকিম।

বহু বছর আগেই সিঙ্গল-ইউজ় প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যান করেছে সিকিম। সম্প্রতি সেখানে নিষেধাজ্ঞা জারি হল প্লাস্টিকের বোতলের উপরে। সিকিম যদি পারে, তা হলে বাকি রাজ্য কেন পারবে না? দু’-তিন দশক পিছিয়ে গেলেও স্টিলের ক্যান বা কাচের বোতলে দুধ আসত বাড়িতে, আনাজ ও মাছের বাজারের জন্য বরাদ্দ থাকত আলাদা পাটের ব্যাগ। বাজার-দোকানে গেলেও সঙ্গী করা যায় এই ধরনের পাটের বা কাগজের ব্যাগ। টিনের কৌটোয় দন্তমঞ্জন বা পাউডারের সঙ্গে এই প্রজন্মের মধ্যবয়স্করা কিন্তু ছোটবেলায় এক যুগ পার করেছে। সেই অভ্যেস ফিরিয়ে আনলেই অনেকাংশে এই প্লাস্টিক দূষণ রোধ করা সম্ভব। কিন্তু বাড়িতে প্রাথমিক স্তরে যেমন কাজ শুরু করতে হবে, তেমনই সরকারের তরফেও প্লাস্টিক দূষণ রোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ করা দরকার। প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ না করলে এই দূষণ উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। প্লাস্টিক উৎপাদনে রাশ না টেনে জনগণকে প্লাস্টিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বলে লাভ নেই। তা অনেকটা বহুছিদ্র পাত্রে জল ভরার শামিল।

তাই পরিবেশরক্ষামূলক পদক্ষেপ করতে হবে খুব শীঘ্রই। প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতামূলক বার্তা দিতে হবে, প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কারের কর্মসূচি নিতে হবে। ‘হর ঘর কো এক গ্যাস’-এর মতো পদক্ষেপে আশ্বাসের বুদবুদ যদি দেশের প্রত্যেক ঘরে পৌঁছতে পারে, তা হলে প্লাস্টিকদূষণ রোধে এমন পদক্ষেপ করাও কঠিন নয়। যে প্রকৃতি ও পরিবেশ আমাদের ধারক, তাতেই দিনের পর দিন আমরা যে ভাবে ছিদ্র তৈরি করে চলেছি, তা বিরাট গহ্বরে পরিণত হতে আর দেরি নেই। নিজেদের এখনও নিয়ন্ত্রণ না করলে সেই কালের গহ্বরেই হারিয়ে যাবে একটা গোটা সভ্যতা। আর একটা সভ্যতা-বধে সফল হবে কয়েক মাইক্রনের প্লাস্টিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Plastic Blood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE