বাঙালির বড্ড বিপদ। বাঙালির হাসি হারিয়ে গিয়েছে। হা-হা হাসি, হি-হি হাসি, শত বিরোধের মধ্যে বলিষ্ঠ হাসি— ছিল, নেই। হাসি বলতে এখন সে বোঝে কোনও না কোনও পক্ষে থেকে অন্যকে ট্রোল করা। অনেকেই হয়তো জানেন না, এই ‘ট্রোল’ শব্দের আদিতে আছে নর্স লোককথার এক দানব। ট্রোল দানব জীবনের মাঝে নানা বিচিত্র-বিবাদী বিরোধিতার বুকে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ হা-হা খোলা হাসিকে খুন করেছে।
বিপদ কেবল এখনকার জীবন্ত বাঙালির নয়, সে-কালের ইতিহাসের বাঙালিরও। তাঁরা কিন্তু যেমন-তেমন মানুষ ছিলেন না। অন্য ভারতীয়রা, ভারতের বাইরের মানুষজন তাঁদের চিনতেন— এখনও নামে চেনেন। তাঁদের জীবনে শুচিবায়ুগ্রস্ততা ও সঙ্কীর্ণতার বালাই ছিল না, ছটফটানি ছিল। তাঁরা পথ খুঁজছিলেন, দেশের-দশের কী ভাবে ভাল হয় ভাবছিলেন। পরাধীন দেশ। ইংরেজরা বাণিজ্যের লোভে দেশ দখল করেছে। আবার দেশ দখলের ফলে পশ্চিমের সভ্যতা-সংস্কৃতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যে অনেক কিছু বড়, মহৎ। ছোট স্বার্থলোভী বণিক ও প্রশাসকদের থেকে সেই বড়র জগৎ আলাদা। সব মিলিয়ে দেওয়া-নেওয়ার, নিজেকে-নিজেদের গড়ে তোলার সে অন্য সময়।
এই অন্য সময়ের মানুষেরা, ছটফটে-সচেতন মানুষেরা জানতেন জীবনের অভিজ্ঞতা বহুমাত্রিক। জীবনের প্রতি তাঁদের বিস্ময়বোধের অভাব ছিল না। বিস্ময়বোধ ছিল বলেই বহুমাত্রিক জীবন থেকে তাঁরা বিষয়-আশয় গ্রহণ করতেন, তার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধিতা ছিল, কিন্তু সেই স্ববিরোধিতা সৃজনশীল স্ববিরোধিতা। অনেক সময় বৃহত্তর কোনও উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য নিজেকেই নিজে খণ্ডন করেছেন এমন উদাহরণ আছে, কিন্তু কখনও তা ক্ষুদ্রতর ব্যক্তিগত স্বার্থচালিত ছোট মতলববাজের স্ববিরোধী আত্মপরতার সঙ্গে তুলনীয় নয়। ব্যক্তিস্বার্থ বড় ছিল না বলে তাঁরা ভুল করে হাসতেন, হাসাতেন। তাঁদের আত্মবিশ্বাস গভীর ছিল বলে নিজেকে নিয়ে হাসতেও মানা ছিল না। যেমন বিবেকানন্দ নিজেকে দেখিয়ে বলতেন তিনি ‘ফেটিয়ে’ (ইংরেজি মোটা অর্থে ব্যবহৃত ‘ফ্যাট’ শব্দের রূপান্তর) গিয়েছেন। ভাবতেও পারতেন না, কোনও শুষ্কমুখ সঙ্কীর্ণবাদী তাঁর দিকে আঙুল তুলে বলবেন, বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে ‘অভাব’ সন্ন্যাসী ছিলেন।
সমকালে অবশ্য ‘কায়স্থ’ সন্ন্যাসী বলে তাঁকে খোঁটা দেওয়া হয়েছিল। সন্ন্যাসীর আবার বামুন-কায়েত কী? তবু কায়স্থের সন্ন্যাস গ্রহণের অধিকার ছিল কি না তা নিয়ে কথা উঠল। কালাপানি ডিঙিয়েছেন বলে কোনও কোনও মন্দিরে তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ হল। ঊনচল্লিশ বছরে প্রয়াত ছটফটে মানুষটি চিঠিপত্রে জাতবজ্জাত হিন্দু পুরোহিতদের তুলোধোনা করলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নামের ভ্রমণকাহিনিতে খাওয়াদাওয়ার বাছবিচার নিয়ে মশকরা করতে ছাড়লেন না। শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, বিলেতে তিনি সব কিছুই খেতেন। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর স্বামী-শিষ্য সম্বাদ নামের গুরু-শিষ্যের কথোপকথনের বইয়েই আছে, গো-পূজকরা কী ভাবে স্বামীজির কৌতুকের বিষয় হয়েছেন। বিবেকানন্দ হাসতেন, হা-হা করে হাসতেন। তাঁর ‘ভাববার কথা’ নামের গল্পগুলি পড়লে বোঝা যায়, হাসতেন যেমন হাসাতেও তেমনই ভালবাসতেন। হিন্দু লোকাচার ইসলামি লোকাচার দুই-ই তাঁর কৌতুকবাণে বিদ্ধ।
এই ছটফটে মানুষটি, যিনি ১৯০২ সালে প্রয়াত, তাঁর লেখায় আবার এমন অনেক কিছু ছিল যেগুলি নিয়ে তর্ক করতে ইচ্ছে করে। বর্ণাশ্রমের ইতিবাচক দিকের কথাও কখনও বলেছেন এই কায়স্থ সন্ন্যাসী, ফলে এ কালে অনিবার্য ভাবেই সমালোচিত মানুষটি। কোনও কোনও কথা এমন কর্তৃত্ব নিয়ে বলেছেন যাতে মনে হতে পারে এ কী রে বাবা! তবে সেই উভবল ভঙ্গি— কখনও হেসে উড়িয়ে দেওয়া, কখনও আবার একবগ্গা বিশ্বাস; কোনও ভঙ্গিই মানুষটিকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, হাসতে-মানা সঙ্কীর্ণ গ্রাম্য পাঁচুঠাকুর করে তোলেনি। হিন্দু সন্ন্যাসী বাঙালি বিবেকানন্দ ‘ওয়েল গ্রুমড’, কসমোপলিটান ছিলেন। হা-হা হাসি তাঁর ভব্যতার অঙ্গ। এখনও প্রশ্নের মুখোমুখি হলে হেসেই জবাব দিতেন।
কে-ই বা তখন সৃজনশীল স্ববিরোধী ভাবনায় আন্দোলিত নন! বঙ্কিমচন্দ্র বিবেকানন্দের আগের প্রজন্মের মানুষ, তাঁর দ্বিতীয় বাংলা উপন্যাস কপালকুণ্ডলা-তেই শেক্সপিয়র-পড়া মানুষটি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিগুলি তুলে ধরেছিলেন। বনচারিণী কপালকুণ্ডলা স্বাভাবিক মানবিকতার টানে নবকুমারকে কাপালিকের হাত থেকে বাঁচালেন। তাঁদের বিয়েও হল। নবকুমার কপালকুণ্ডলার রূপে মুগ্ধ। সমুদ্রের প্রেক্ষাপটে সে অপরূপ উন্মুক্ত নারীরূপ তাঁকে বিভোর করেছিল। কিন্তু কপালকুণ্ডলা? পরে নবকুমারের সংসারে প্রবেশ করার পর বলে, “যদি জানিতাম যে স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না।” আবার বঙ্কিমই পরে দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে প্রফুল্ল নামের মেয়েটিকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে তুলে শেষে সতিন-কবলিত সংসারে বাসন মাজাতে ফিরিয়ে আনলেন। এক সময়ের প্রগতিশীলতা পরে পিছন দিকে এগিয়ে যাওয়ায় রূপ নিল, এমন বললে বঙ্কিমকে পুরোপুরি বোঝা যাবে না। শিশিরকুমার দাশ বঙ্কিম সম্পর্কে যে শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন সেটি বরং কাজে লাগতে পারে, ‘আর্টিস্ট ইন চেনস’। শিল্পী বঙ্কিম নিজেকে সামাজিক দায় দিয়ে শৃঙ্খলিত করেছিলেন। সমাজভাবনার সূত্রে হিন্দু ধর্ম-দর্শনের কোনও কোনও বিষয় তাঁকে আলোড়িত করেছিল, তিনি ভাবছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ এই বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে তর্ক করেছিলেন, কেন্দ্রে ছিল কৃষ্ণচরিত্র। মহাভারতের কৃষ্ণের কৌশল বঙ্কিম যে ভাবে ব্যাখ্যা করেন, তা রবীন্দ্রনাথ মানতে নারাজ। আবার বঙ্কিমের প্রয়াণের পর বাংলা সাহিত্যের এই উদ্যোগী পুরুষের প্রতি তিনি অকুণ্ঠ সমাদরবাক্য নিবেদনে দ্বিধা করেননি। ঠোঁটচাপা সুস্মিত বঙ্কিমের ভাবনার গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথ জানতেন। তাঁর মতে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের প্রধান অবদান ‘শুভ্র সংযত হাস্যরস’। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘজীবী ছিলেন, দীর্ঘজীবন তাঁর ভাবনার জগৎ সমৃদ্ধ করেছিল। নিজের দোটানা তিনি সংশোধন করে নিতেন। আবার কখনও এমন কিছু করেছেন যা অতিযুক্তিবাদীদের বিরক্ত করবে। প্ল্যানচেট-করিয়ে রবীন্দ্রনাথকে এ-কালের যুক্তিবাদীরা কী বলবেন? সোনার কেল্লা-র সত্যজিৎও ছাড় পাননি, পরজন্মে বিশ্বাসের ছবি বানিয়ে সমালোচিত হন। আবার আগন্তুক ছবিতে উৎপল দত্তের কণ্ঠে সত্যজিৎ নিজের গাওয়া হিন্দু দেবতার স্মরণমন্ত্র বসিয়েছেন। সেখানে উৎপল দত্ত পুঁজিবাদী আধুনিক সভ্যতার বিরুদ্ধকণ্ঠ এক নৃতত্ত্ববিদ। ব্যক্তিগত জীবনে উৎপল দত্ত গিরিশ-মানসকে বুঝতে চেয়েছিলেন। রামকৃষ্ণদেবের ভক্তিমার্গ কী ভাবে গিরিশচন্দ্রের নাটকের বিশেষ অভিমুখ তৈরি করল, মার্ক্সবাসী হয়েও তা তাঁর সশ্রদ্ধ ভাবার বিষয়। তিনিই জীবনের শেষবেলায় বাবরি মসজিদ-ভাঙা রাজনীতি নিয়ে তির্যক ভাবে সরব। হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় বাঙালি অভিনেতা তিনি। হিন্দি সিনেমায় তখন যে শিক্ষিত ভদ্রলোক পরিসরের পারিবারিক ছবি তৈরি হত, সেই ভাষা-পরিসরের সঙ্গে তাঁর কেন বিরোধ থাকবে? ভুবন সোমকে হিন্দিভাষী ভদ্রলোকেরা মনে রাখবেন। কমেডিয়ান উৎপল দত্ত হাসাতেন, হাসতেন।
এই যে উনিশ শতক থেকে চলে আসা এক সৃজনশীল টানাপড়েনকে সঙ্গী করা জীবনবোধ, তার প্রতি নানা মতের শুষ্ক সঙ্কীর্ণতাপন্থী হাস্য-হারারা কামান দেগেছেন। এই কামান এক সময় বাঙালি বামেদের মধ্য থেকে উঠে আসা, অতি যুক্তিবাদের ধুয়া তোলা, বহু ক্ষেত্রেই জীবনের সঙ্গে যথাযথ সম্পর্কহারা যুবক-যুবতীর প্রতিবাদের অস্ত্র। পরে পরিণত বয়সে সেই আগুনখেকো ‘ইমেজ’ বজায় রাখার জন্য তাঁরা আগের কথার ‘সীমাবদ্ধতা’ আর স্বীকার করেননি। তাঁদের হাসিহীন সিরিয়াসনেসের দাপটে বিদ্যাসাগর-মূর্তির মাথা কাটা পড়েছে, বিবেকানন্দ-বঙ্কিম নিতান্ত হিন্দুত্ববাদী কিংবা হিন্দুত্ববাদীদের আদিগুরু বলে বাদ পড়েছেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারতনয় বলে অস্বীকৃত হয়েছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় হাসতে জানতেন বলেই ভূতের বেগার লিখে ঢোলগোবিন্দ হয়ে ক্রমশ হাসিহারা হয়ে ওঠা দলে আর ফিরলেন না।
এই অতি-বিপ্লবের বামনাই যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনই এখন তারই বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার আঁচও ভয়ানক। এখন হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থার নির্ঘোষ, কোথাও এক বিন্দু হাসি-ঠাট্টার জো নেই। কী সিরিয়াস মুখে ‘হনুমান চালিসা’ বিক্রি হচ্ছে। বাঙালির সু্নন্দ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘জাগো রে নগরবাসী ভজ হনুমান’ নামে যে টেনিদা-কীর্তন লিখেছিলেন, এখন তা শুনলেও মাথা কাটা যাবে। গীতা-মহাভারতে পারদর্শী সংস্কৃতজ্ঞ রসায়নবিদ রাজশেখর বসু, পরশুরাম নামে ব্রহ্মচারী হনুমানের সঙ্গে চিলিম্পার বিচিত্র লীলাকদলী সম্পর্কের ব্যর্থ ইতিবৃত্ত লিখেছিলেন, তাও বুঝি আর পড়া চলবে না।
এক সময় কেউ কেউ বাঙালি চিন্তকদের বলতেন ‘রোবাস্ট’। বলিষ্ঠ শক্তিশালী জীবনবোধ থাকলে সঙ্কীর্ণতার পাঁক গায়ে লাগে না। জীবনের নানা অভিজ্ঞতা গায়ে মেখে সত্যানুসন্ধান সম্ভব হয়। সেই সন্ধানেই এই বড় বাঙালিরা যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন অনেক কিছু, আবার ‘জানি না’ এই বিস্ময়বোধও তাঁদের অটুট ছিল। এখন সবাই সব কিছু জানে, শুধু তা-ই নয়, নিজের জানাকেই শেষ কথা বলে মানে। তার উপরে জুটেছে গ্লোবাল-কূপমণ্ডূকতা। তথ্যসর্বস্ব এই কূপমণ্ডূকতা পুঁজির দেখানো পথকেই রাজপথ বলে মানে, তার বাইরে প্রকৃতি যে বিচিত্র অসংখ্য উপায়ের রাস্তা রেখে দিয়েছে তা চোখেই পড়ে না। বামপন্থী রামগরুড়, হিন্দুত্ববাদী রামগরুড়, গ্লোবাল রামগরুড় সবাই একটা জায়গায় এক, তারা হাসতে জানে না। এখানেই তাদের লিবার্টি, ইকোয়ালিটি আর ফ্রেটারনিটি। তিন দলই সবজান্তা দাদা। দেখেশুনে বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের আদলে ফুট কাটতে ইচ্ছে করে, ‘লিবার্টি, ইকোয়ালিটি আর মটরশুঁটি’। প্লিজ়, হনুমানের দোহাই একটু হাসুন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাঁদর, হনুমান সবাইকে নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি আছে। নিজেকে নিয়ে হাসুন, সবজান্তাপনার খাঁচার বাইরে আসুন। একটু নাহয় স্বার্থ ও আত্মপরতাশূন্য, জীবনমুখী, স্ববিরোধী জ্যান্ত মানুষ হলেন!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)