Advertisement
E-Paper

নাগরিক সমাজ প্রশ্ন ও প্রতিবাদের নিরন্তর উৎস, তাই হুঁশিয়ারি

বিজেপির সদ্যপ্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপবাবু বরাবরই স্পষ্টবাদী বলে পরিচিত। মনে এক, মুখে আর এক নীতি নিয়ে তিনি চলেন না।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২১ ০৬:০২
আশঙ্কিত: সাংবাদিক গ্রেফতার ও নিগ্রহের প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের সামনে জমায়েত, ১ অক্টোবর, আগরতলা, ত্রিপুরা।

আশঙ্কিত: সাংবাদিক গ্রেফতার ও নিগ্রহের প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের সামনে জমায়েত, ১ অক্টোবর, আগরতলা, ত্রিপুরা। ছবি: সমাজমাধ্যম থেকে।

তুমি পুরাণকে বলো ইতিহাস, ইতিহাসকে বলো পুরনো, তোমার কাজ শিক্ষাকে লাঠিপেটা করে মূর্খের জ্বালা জুড়োনো।” রাজ্যে বিধানসভা ভোটের তুঙ্গমুহূর্তে বাংলার শিল্পী-অভিনেতা-নাট্যকাররা এই গান বেঁধেছিলেন। সে গান বলেছিল, “আমি গোয়েবলস-এর আয়নায় ঠিক তোমাকেই দেখে ফেলেছি।” গানের কথায় কারও নাম থাকলেও তির ঠিক নিশানাতেই লেগেছিল। চটে গিয়ে দিলীপ ঘোষ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, “শিল্পীদের বলছি, গান করুন, নাচ করুন। রাজনীতি করতে আসবেন না। না হলে রগড়ে দেব।”

বিজেপির সদ্যপ্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপবাবু বরাবরই স্পষ্টবাদী বলে পরিচিত। মনে এক, মুখে আর এক নীতি নিয়ে তিনি চলেন না। তবু তাঁর ‘রগড়ে দেওয়া’-র হুমকি নিয়ে কেউ বিশেষ দুশ্চিন্তা করেননি। বোধ হয় ওটা তাঁর কথার কথা বলে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মুখেও যদি একই ভাবে নাগরিক সমাজকে ‘রগড়ে দেওয়া’-র কথা শোনা যায়, তা হলে কি আর নিশ্চিন্তে থাকা যায়? সেটা সম্ভব নয়।

অজিত ডোভাল সেই রগড়ে দেওয়ার কথাই বলেছেন। হায়দরাবাদের পুলিশ অ্যাকাডেমিতে আইপিএস-দের প্রশিক্ষণ শেষের অনুষ্ঠানে ডোভাল বলেছেন, “নাগরিক সমাজই এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। কারণ নাগরিক সমাজকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় স্বার্থে আঘাত হানার চেষ্টা হতে পারে।” কেন? ডোভালের ব্যাখ্যা, নাগরিক সমাজকে বাগে এনে, তার মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে, উস্কানি দিয়ে জাতীয় স্বার্থে আঘাত করা যায়। নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুদ্ধটা কী ভাবে হবে, তা অবশ্য ডোভাল বলেননি। তবে আইপিএস-দের দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়েছেন।

দিলীপবাবুর মতো ডোভাল নিছক কথার কথা বলেছেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কারণ কিছু দিন আগে পুণেতে গিয়েও ডোভাল একই কথা বলেছিলেন। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কণ্ঠেও প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে। ১২ অক্টোবর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কিছু লোক মানবাধিকারের নামে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে।

প্রশ্ন হল, গত সাত বছরে মোদী জমানায় নাগরিক সমাজের থেকে সরকারের সমালোচনা হলে এমনিতেই তার কঠোর হাতে মোকাবিলা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদীদের জন্য তৈরি ইউএপিএ আইন সাংবাদিক থেকে সমাজকর্মীদের বিরুদ্ধে। যার সর্বশেষ উদাহরণ ত্রিপুরার দুই মহিলা সাংবাদিককে পুলিশি হেনস্থা। কিন্তু হঠাৎ মোদী সরকারকে নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হল কেন? ২০২২-এর গোড়ায় উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন থেকেই কার্যত ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সেমিফাইনাল শুরু হয়ে যাচ্ছে। তার আগে কি নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ মোদী সরকারকে দুশ্চিন্তায় রাখছে? নাগরিক সমাজকে নিয়ে এই দুশ্চিন্তার কারণটাই বা কী?

এতে কোনও ভুল নেই, গত সাত বছরে এ দেশের ছত্রভঙ্গ বিরোধী রাজনৈতিক শিবির মোদী সরকারকে বিশেষ কোনও বেগ দিতে পারেনি। সাত বছরে মোদী সরকার যদি সাত বারও হোঁচট খেয়ে থাকে, তার পিছনে এই নাগরিক সমাজ। ভিড় জুটিয়ে গণপিটুনির ঘটনার পরে অসহিষ্ণুতার নালিশ তুলে সরকারি পুরস্কার ফেরানো বা ‘অ্যাওয়ার্ড ওয়াপসি’ দিয়ে এর সূত্রপাত। তার পরে শাহিন বাগে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হোক বা দিল্লির সীমানায় কৃষক আন্দোলন— বিরোধী শিবির নয়, মোদী সরকারকে বেগ দিয়েছে নাগরিক সমাজ, সামাজিক সংগঠন। বিজেপি নেতৃত্ব এ সবের পিছনে কখনও রাজনৈতিক বিরোধীদের, কখনও আবার সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের যোগ থাকার অভিযোগ তুলেছে। লক্ষ্য ছিল, নাগরিক সমাজের আন্দোলনের সঙ্গে আম নাগরিকের দূরত্ব তৈরি করা। কিন্তু কৃষক আন্দোলনকারীদের গায়ে ‘খলিস্তানি’-র তকমা দেগে দেওয়ার চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হয়নি। তা হলে কি বিজেপি নেতৃত্ব টের পাচ্ছেন, নাগরিক আন্দোলনে শুধু কালি ছিটিয়ে কোনও লাভ হবে না? তার জন্য অন্য দাওয়াই দরকার?

বিজেপি নেতারা জানেন, মনমোহন সরকারের পতনের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল অণ্ণা হজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন। সেই নাগরিক সমাজের অভ্যুত্থান। তাঁরা জানেন, পশ্চিমবঙ্গে যদি অমিত শাহের দু’শোর বেশি আসন জেতার স্বপ্ন ভাগীরথীতে ভেসে গিয়ে থাকে, তার পিছনেই সেই ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র স্লোগান তোলা নাগরিক সমাজ। এই দুশ্চিন্তাই ফুটে ওঠে পেগাসাস-কাণ্ডে। অভিযোগ ওঠে, শুধু রাহুল গাঁধী বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিরোধী শিবির নয়, সমাজকর্মী, সাংবাদিক থেকে আইনজীবীর মতো নাগরিক সমাজের সদস্যদের ফোনেও রাষ্ট্রকে আড়ি পাততে হয়।

আসলে নাগরিক সমাজ সব রাজনীতিকের কাছেই বরাবরের দুশ্চিন্তার কারণ। কারণ ইতিহাস বলে, বিরোধীরা যতই মিইয়ে থাক, রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয় সেই নাগরিক সমাজের মধ্যে থেকেই। তাই নাগরিক সমাজ তেড়েফুঁড়ে উঠলে বা প্রশ্ন করতে শুরু করলেই, রাষ্ট্রনেতারা তার পিছনে বিদেশি শত্রুর কালো হাত দেখতে পান।

জরুরি অবস্থা জারি করার আগে ইন্দিরা গাঁধী বলতে শুরু করেছিলেন, নাগরিক সংগঠনগুলোকে বিদেশি শক্তি মদত জোগাচ্ছে। এখন ডোভাল ঠিক যে আশঙ্কার কথা বলছেন। মনমোহন সিংহের সরকারের আমলে শাসক শিবির নাগরিক সমাজকে দুই ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। এক দিকে সনিয়া গাঁধীর জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের হাত ধরে নাগরিক সমাজ কাজের অধিকার, খাদ্যের অধিকার, তথ্যের অধিকারের আইন তৈরিতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। অন্য দিকে, মনমোহন সিংহ দেশে অনেক প্রচার-আন্দোলনের পিছনে এনজিওগুলির বিদেশি অনুদানের প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী সরকার সংশয় না রেখে এনজিওগুলির বিদেশি অনুদানে রাশ টানতে কোমর বেঁধেছে। আইনের মাধ্যমে রাশ টানা, আয়কর দফতরের হানা, কিছুই বাদ যায়নি।

পশ্চিমবঙ্গে বাম দুর্গের পতন তথা পরিবর্তনের আগে দেখা গিয়েছিল, নাগরিক সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের সিংহভাগ বামেদের পাশ থেকে সরে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যে বুদ্ধিজীবীরা পাশে রয়েছেন বলে এক সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গর্ব ছিল। কিন্তু নাগরিক সমাজের থেকে প্রশ্ন উঠলে, নাগরিক স্বাধীনতা বা মানবাধিকারের প্রশ্ন উঠলে বামফ্রন্ট সরকারও যে তা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামলাতে পেরেছে, তা নয়। জ্যোতি বসুর পুলিশমন্ত্রী থাকাকালীন শিশির মঞ্চের এক অনুষ্ঠানে প্রশ্ন তোলার অপরাধে মানবাধিকার কর্মীদের আটক করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনও বুদ্ধদেববাবু তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মানবাধিকার-ফানবাধিকার’ তিনি বুঝে নেবেন। পরিবর্তনের পরেও এই ধারার পরিবর্তন হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অম্বিকেশ মহাপাত্রকে জেলে পুরেছে। প্রশ্ন করার অপরাধে মুখ্যমন্ত্রী এক ছাত্রীকে ‘মাওবাদী’ বলে তকমা দিয়েছেন।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, ব্যক্তি বা সাধারণ মানুষ ও সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে এই নাগরিক সমাজ। বিক্ষোভ, আন্দোলন হোক বা মামলা-মকদ্দমা, নাগরিক সমাজের হাতেই থাকে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষমতা। কিন্তু তাকে সর্বশক্তি দিয়ে দমন করার চেষ্টা করলে তা বুমেরাং হতে পারে।

স্বৈরাচারী মুসোলিনির হাতে বন্দি হওয়া ইটালীয় দার্শনিক অান্তোনিয়ো গ্রামশ্চি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন। মার্ক্সীয় পূর্বাভাসমতো পশ্চিমের পুঁজিবাদী সমাজের বদলে কেন আধা-সামন্ততান্ত্রিক জ়ারের রাশিয়ায় আন্দোলন গড়ে উঠল? গ্রামশ্চির সিদ্ধান্ত ছিল, যে দেশে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের অধিকার থাকে, সেখানে সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ করে না। রাশিয়ার মতো নাগরিক সমাজকে দমনের চেষ্টা হলেই বিদ্রোহের জন্ম হয়।

দিলীপ ঘোষ ও অজিত ডোভাল গ্রামশ্চির তত্ত্ব পড়েছেন কি না জানা নেই। কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই এই কথাটি তাঁদের হিসাবে অনুপস্থিত।

BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy