আমার বাড়ি যাইও ভোমর
বসতে দেব পিঁড়ে
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে
শালি ধানের চিঁড়ে দেব
বিন্নি ধানের খই
বাড়ির গাছের কবরী কলা
গামছা-বাঁধা দই
(আমার বাড়ি, জসীমউদ্দিন)
এই কবিতায় শালি ও বিন্নি ধানের বদলে যদি লেখা হত ‘আইআর-৮ ধানের চিঁড়ে দেব/ আইআর-৩৬ ধানের খই’, কবরী-র জায়গায় যদি লেখা হত ‘জি-১৯’ তাতে যতটা রসভঙ্গ হত, সবুজ বিপ্লবের পরে আমাদের সাধের মাঠ ঘাট আকাশ প্রাণ মন ইন্দ্রিয় ততটাই নষ্ট হয়ে গেছে। চার দিকে আজকাল ‘পিঠেপুলি উৎসব’-এর ‘ইভেন্ট’ দেখি। কিছু পিঠে কেমন শুকনো, গলায় আটকে যায়। তেমন সুগন্ধ নেই, নরম ও সরস ভাবের অভাব, খেয়ে মনে হয় নারকেলের পুর দেওয়া একটা রোল খেলাম মাত্র। যাঁদের জিভে বৈচিত্রময় সুখাদ্যের স্মৃতি খুব স্পষ্ট, তাঁরা সকলেই হয়তো অনুভব করেন রোজকার খাবার ক্রমে একঘেয়ে ও স্বাদহীন লাগতে শুরু করেছে।
তা ছাড়া নবান্ন বা পৌষ সংক্রান্তি কি কেবল পিঠে খাওয়ার আয়োজন? কখনওই না। চাষের শুরু থেকে মাঠপুজো, হালপুণ্য, ধানের সাধ ভক্ষণ, নল সংক্রান্তি, শুক্রবিড়া রেখে ধান কাটতে নামা, সংক্রান্তির দিন নাড়াভরা মাঠের পুজো, সারবিড়া কেটে নতুন ধানভরা বেতের চুপড়িতে চাপিয়ে ঘরে এনে দুই বিড়া বেঁধে নতুন চালের পরমান্ন, পিঠা প্রস্তুত করে কাকাবলি দিয়ে বিশ্বপ্রাণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পূর্বপুরুষদের নতুন ফসল উৎসর্গ করে তার পরে সকলে মিলে খেতে বসা। ছয়-সাত মাস ধরে চলা একটা যাত্রা, এক বিরাট সম্পর্কের বুননে গড়ে ওঠা কর্মকাণ্ডের ছোট্ট অংশ পিঠে খাওয়া।
যদি প্রশ্ন করেন, এই পিঠে কোন ধানের চালে বানানো, যতগুলো ধানের নাম শুনবেন প্রায় সবই বাজার থেকে কেনা ধানবীজে চাষ করা। যার মধ্যে অনেক বীজই আবার বাঁজা, অর্থাৎ পরের মরসুমে আর ফসল ফলে না। বাজার ভরা ভেজাল গোবিন্দভোগ, তুলসীভোগ, দুধেরসর, বাঁশকাঠি চালের রাজ্যে এ কথা আমরা প্রায় ভুলে গিয়েছি যে উপকূল থেকে পাহাড়, সারা বাংলা জুড়ে কয়েক হাজার জাতের দেশি ধান চাষ হত। ভাত, মুড়ি, খই, খিচুড়ি, পান্তা, পায়েস, পিঠের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধান চাষ করা হত।
জয়নগরের মোয়া কি আমরা খেতে পেতাম যদি কনকচূড় ধানের ওই নরম সুগন্ধি খই না থাকত? মরিশাল ধানের খইও মোয়া তৈরির কাজে লাগে। আমরা তো কেবল মায়েদের সন্তান না, মায়েদের রান্নাশালেরও সন্তান। রান্নাশাল নীরবে ইকোলজির মহাফেজখানা হয়ে ওঠে। রান্নাশাল জানে কোন ফুল কখন ফোটে, ফল কখন আসে, কোন শাক কখন খাব বা কখন খাব না, কোন মরসুমে ফুল ফুটতে কত দেরি হল, মাঠে কোন মৌমাছি পাখি বা প্রজাপতি আর আসে না, কোন মাছ আর পাওয়া যায় না, কোন খাবারের রান্না ক্রমশ কমছে, সংসার কতটা নগদ টাকা নির্ভর হয়ে উঠছে। তাদের কাছে ঘুরে ঘুরেই জানা তালমুগুর বা মালাবতী ধানের পান্তার স্বাদ গন্ধ বর্ণের কথা, মালাবতীর খিচুড়ি, ঝিঙাশাল গোবিন্দভোগ চালের পিঠা পাটিসাপ্টা, মৌল-হোগলা-হামাই-মরিশাল ধানের ফুরফুরে গোলগোল মুড়ি, দুধেরসর-চামরমণি-সীতাশাল-ঝিঙাশাল-নাঙলমুড়া চালের অপূর্ব সুস্বাদু ভাত, কামিনীভোগ চালের পোলাও, তুলসীমুকুল-রাধাতিলক-চিনাকামিনী চালের পায়েসের কথা। তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পে দেখি আউশ-মরসুমের কোনও ধানের লাল মুড়ির স্মৃতিচারণ করছেন তারানাথ।
চিত্রকর বিনোদবিহারী আত্মজীবনীতে লিখছেন যে, তাঁর বাবা বিশ্বাস করতেন ভাত খেলে ছেলের অসুখ সেরে যাবে। চরকসংহিতা খুলে দেখছি, শালি ধান দিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে৷ এশিয়ার বৃহত্তম অসরকারি দেশি ধানের জিনব্যাঙ্ক ‘ব্রীহি’র প্রতিষ্ঠাতা দেবল দেব-এর তিন দশকের গবেষণা ঘেঁটে দেখছি, গরিবশাল চালের ভাত দিয়ে উদরাময়ের যে চিকিৎসা হত, পরীক্ষাগারে তার যাথার্থ্য তিনি প্রমাণ করেছেন। গরিবশাল, কবিরাজশাল, রক্তশালী-সহ নানা চালের ভাত, ফ্যান, চালধোয়া জল ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দুধেরসর, ভুতমুড়ি-সহ নানা চাল অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পরিচর্যায় গুরুত্বপূর্ণ কাজে লেগেছে।
অন্য দিকে, কায়িক শ্রম কমে আসা বাজারি সার্কাসে ভাত হয়ে উঠেছে খলনায়ক। ‘ভাত খেলে শুগার হবে’, ‘মোটা হবে’, তাই রুটি কিংবা মিলেট খেতে হবে। কিন্তু এই ভাত কোন চালের ভাত? রাসায়নিক সার বিষে ভরা, কোম্পানির বীজে চাষ করা, মিল-এ পালিশ করা চালের ভাত। মিল-এ পালিশ করা চালকে ‘চাল’ বলার চেয়ে চালের বর্জ্য বলাই শ্রেয়। কারণ, অধিক ছাঁটাই আর পালিশের ফলে চালের পুষ্টিগুণ ওষধি-গুণ নষ্ট হয়ে যায়। অতএব দেশি ধানের ঢেঁকিছাঁটা চালের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে হবে না। গুলিয়ে ফেললে প্রজন্মান্তরে নষ্ট হতে থাকে জিভের স্মৃতি। তখন বাজারের যে কোনও চাল ডাল তেল মাছ মাংস মশলা ফল— সব কিছুকেই ঠিক বলে মনে হয়। ভাল খাবারের স্মৃতি না থাকলে কোন খাবারটি নিরাপদ নয়— তা বোঝা অসম্ভব।
কৃষি থেকে কৃষ্টি। চাষবাস, কৃষিসংস্কৃতি, কথাগুলো এই ভাবে বলা হয়। কৃষি নেই তো সংস্কৃতি নেই। সংস্কৃতি নষ্ট তো কৃষিও নষ্ট। দেশের প্রায় যে কোনও উৎসব কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত। দুর্গাপুজোর সঙ্গে কার সম্পর্ক তা খুঁজছিলাম খুব। দুর্গাপুজোর আগে কোনও ধান তো এখন আর কাটা হয় না। তা হলে নবপত্রিকায় যে ধান দেওয়া হয়, তা কি পুরনো? খুঁজতে খুঁজতে জন্মভূমি সুন্দরবনের অশীতিপর কিসানি উষারানি মাইতির কাছে জেনেছিলাম, “একটা ধান চাষ হত ‘দুর্গাভোগ’ নামে। যিনি ব্রতী, তাঁকে এই ধানটা হয় চাষ করতে হত নয়তো অন্য কোনও জায়গা থেকে ওই ধান সংগ্রহ করে আনতে হত। সেই নতুন ধানেই সাজানো হত নবপত্রিকা।” সেই সূত্র ধরে পরে বড়পিসি এবং কৃষিসংগঠক বন্ধু সোমশুভ্র সাহুর কাছে জেনেছিলাম, চূর্ণকাটি, আশ্বিনেসরু, ঘেঁচিপাটনাই ধানের কথা, যা সব পুজোর আগে বা পুজোর মাসেই কাটা হয়ে যেত। এখন আর সে সব ধানের চাষ নেই কোথাও। তাই দুর্গাপুজোর সঙ্গে ফসল কাটার সম্পর্কের কথাও গেছে তলিয়ে।
খাবার যখন স্রেফ পেট ভরানোর বিষয়, নিজের জমিতে কৃষক যখন চুক্তিবদ্ধ অসংগঠিত মজুর, মূল আলোচ্য বিষয় যেখানে ‘ক্যালরি’, যেখানে সব সম্পর্ক ক্রমে ক্রমে পারস্পরিক শ্রদ্ধা হারাচ্ছে, সেখানে এটুকু মনে থাক— শুধু খাওয়া বা কেনাবেচার সম্পর্ক হলে আদি কৃষকেরা ধানের নাম মাছকণ্ঠা, মেঘডুমুর, অলি, লীলাবতী, শিশুমতি, তুলসীমঞ্জরী, আলতাপাটি, মালাবতী— এ রকম রাখতে পারতেন না!
ভিনসেন্ট ভ্যান গখ ভাই থিয়ো-কে এক চিঠিতে আর্ট প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিতেন না ফরাসি চিত্রকর জাঁ ফ্রাঁসোয়া মিইয়ে’র বিখ্যাত ছবি ‘দি অ্যাঞ্জেলাস’-এর কথা, যেখানে দিনান্তে ফসল তুলে ঘরে ফেরার আগে গোধূলির আলো মেখে প্রাণময় মাটিকে প্রণাম করে যাচ্ছেন কৃষক!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)