E-Paper

উন্নয়নের আয়নায় জীবন

জন্মের সময়ে প্রত্যাশিত আয়ু— স্বাস্থ্যের এই সূচকটি একটি দেশের স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের বাস্তব চিত্র দেখায়। গড় আয়ু উঁচুর দিকে থাকলে তা উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পুষ্টিকর খাদ্যের সহজলভ্যতার নির্দেশক।

অরবিন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:১৫

মানুষের জীবনযাত্রার যথাযথ মান ও তার ক্রমপরিবর্তনের অবস্থাকে সকলের সামনে তুলে ধরতে ব্রতী রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন কর্মসূচি, সেই ১৯৯০ থেকে— জীবনযাত্রার মানের সূচক (হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইন্ডেক্স)-এর মাধ্যমে। এই যৌগিক সূচকটি কোনও দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মানের ভিত্তিতে উন্নয়নের মাত্রা নির্ধারণ করে।

এই সূচকের মূলত তিনটি প্রধান মানদণ্ড। স্বাস্থ্য— জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু, শিক্ষা— গড় শিক্ষাবর্ষ ও প্রত্যাশিত শিক্ষাবর্ষ এবং জীবনযাত্রার মান— মাথাপিছু জাতীয় আয় যা আমেরিকান ডলারে ক্রয়ক্ষমতার সমতার নিরিখে প্রকাশ করা হয়।

জন্মের সময়ে প্রত্যাশিত আয়ু— স্বাস্থ্যের এই সূচকটি একটি দেশের স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের বাস্তব চিত্র দেখায়। গড় আয়ু উঁচুর দিকে থাকলে তা উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পুষ্টিকর খাদ্যের সহজলভ্যতার নির্দেশক। এটি মানবিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিতবাহী। জন্মকালে প্রত্যাশিত আয়ু একটি জাতির সার্বিক ও স্থিতিশীল উন্নয়নের মানদণ্ড এবং সামাজিক ন্যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সরকারি সদিচ্ছার প্রতিফলন।

সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান জনগোষ্ঠী অধিক উৎপাদনশীল, দীর্ঘ সময় কর্মক্ষম। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, উন্নয়ন মানে মানুষের সামর্থ্য বাড়ানো, এর অন্যতম দিক সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবনযাপন; সুতরাং উন্নয়নের লক্ষ্য জন্মকালে প্রত্যাশিত আয়ুর বৃদ্ধিও বটে। নোবেলজয়ী আমেরিকান অর্থনীতিবিদ থিয়োডোর শুল্ৎজ় এই ধারণাটি তুলে ধরেন যে, মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে ব্যয় শুধুমাত্র সামাজিক কল্যাণখাতের ব্যয় নয়, বরং এটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিনিয়োগ। বলেন, কারখানা, যন্ত্রপাতি বা পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মতোই, মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও স্বাস্থ্যোন্নয়নে বিনিয়োগ করলে শ্রমশক্তির গুণমান বৃদ্ধি পায় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তা গুরুত্বপূর্ণ। শুল্ৎজ় এই ধারণার মাধ্যমে অর্থনীতিতে মানব-পুঁজির গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অপর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি বেকার, শুল্ৎজ়ের কাজকে সম্প্রসারিত করে মানব-পুঁজির তত্ত্বকে সুসংগঠিত রূপ দেন। তিনি পরীক্ষিত তথ্য ও গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে দেখিয়েছেন কী ভাবে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য আজীবনের জন্য ব্যক্তির কর্মদক্ষতা ও আয় ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়।

১৯৯৩-এ প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাঙ্কের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট’টি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের গুরুত্বের ভিত্তিতে তৈরি। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় শুধুই জনকল্যাণ নয়, এটি লাভজনক অর্থনৈতিক বিনিয়োগও বটে। সুস্থ, শক্তিশালী এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য, এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করলে দারিদ্র কমে, উৎপাদনশীলতা বাড়ে, সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।

রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্টস ২০২৪’-এ ১৯৫০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দেশভিত্তিক মানুষের জন্মকালে প্রত্যাশিত গড় আয়ুর বিশদ চিত্র উপস্থাপিত। ভারতের বিগত ৭৫ বছরের গড় আয়ুর অগ্রগতির যথাযথ মূল্যায়ন করতে হলে, প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকেও দেখা দরকার। অর্থাৎ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চিন, মায়ানমার, মলদ্বীপ, আফগানিস্তান। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে এই দেশগুলোর অধিকাংশেরই গড় আয়ু ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ১৯৫০-এ ভারতের গড় আয়ু মাত্র ৪১.২ বছর (নারীদের ৪০.৪ বছর)। তখন প্রতিবেশীদের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে চিন ৪৩.৮ (নারীদের ৪৫.৭) এবং শ্রীলঙ্কা ৫৩.২ (নারীদের ৫৪.৭) কিছুটা এগিয়ে। বাকিরা ভারতের কাছাকাছি বা আরও পিছিয়ে। যেমন পাকিস্তান ৩৪.২ (নারীদের ৩২.৮), মলদ্বীপ ৩৬.৫ (নারীদের ৩৭.৫), মায়ানমার ৩৫.৭ (নারীদের ৩৭.৪)।

৫০ বছর পরে, ২০০০-এ ভারতের জন্মকালে প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে ৬২.৭ (নারীদের ৬৩.৮) হয়। এই সময়ে চিন ও শ্রীলঙ্কার জন্মকালে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ভারতের চেয়ে অনেকটাই বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭২.৩ (নারীদের ৭৪.৯), ৭১.২ (নারীদের ৭৬.৩)। ভারতকে অনেকটাই পিছনে ফেলে মলদ্বীপও পৌঁছয় চিন, শ্রীলঙ্কার কাছাকাছি— গড় আয়ু ৭০.৯ (মেয়েদের ৭২.২)। ভারতের কাছাকাছি পৌঁছে গেল বাংলাদেশ— ৬২ (নারীদের ৬২.৮)।

সর্বশেষ তথ্যে, ২০২৩-এ প্রতিবেশী অনেক দেশই জন্মকালে প্রত্যাশিত গড় আয়ু সূচকে ভারতকে অনেকটা ছাড়িয়ে গিয়েছে। ২০২৩-এ ভারতের গড় আয়ু ছিল ৭২ (নারীদের ৭৩.৬)। মলদ্বীপ ৮১ (নারীদের ৮২.৮) গড় আয়ু নিয়ে সকলকে লক্ষণীয় ভাবে অতিক্রম করেছে। চিনে গড় আয়ু হয়েছে ৭৮ (নারীদের ৮০.৯), শ্রীলঙ্কায় ৭৭.৫ (নারীদের ৮০.৬)। বাংলাদেশ (৭৪.৭, নারীদের ৭৬.৪) ও ভুটানও (৭৩, নারীদের ৭৫) অনেক এগিয়ে এখন।

পাশাপাশি ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে বৈষম্যের বিশ্লেষণও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসআরএস)-সংক্ষিপ্ত আয়ু সারণি (২০১৯–২০২৩) অনুযায়ী, রাজ্যগুলির মধ্যে জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু সর্বোচ্চ কেরলে— ৭৫.১। এর পর হিমাচল প্রদেশ— ৭৪.৪, দিল্লি— ৭৪.২, তামিলনাড়ু— ৭৩.৪, মহারাষ্ট্র— ৭২.৮ এবং পশ্চিমবঙ্গ— ৭২.৫, যা সেই সময়ে সর্বভারতীয় গড়ের উপরে। কিছু রাজ্য অনেকটাই পিছিয়ে। সবচেয়ে কম যথাক্রমে ছত্তীসগঢ়ে (৬৪.৬), মধ্যপ্রদেশে (৬৭.৬) উত্তরপ্রদেশে (৬৮)। এই আয়ুর পার্থক্য দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, উন্নয়নের অসাম্যের প্রতিফলন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, জন্মকালে গড় আয়ু, যা মানব উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে বিবেচিত, তার উন্নয়নের ধারায় ভারত স্বাধীনতার পর থেকে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সন্তোষজনক নয়। প্রতিবেশীদের অনেকেই সীমিত সম্পদ ও সঙ্কট সত্ত্বেও তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে মানব উন্নয়নের পরিসরে কার্যকর ভাবে রূপান্তর করতে পেরেছে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ বা চিন— প্রত্যেকেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পুষ্টি, নারীস্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করে জন্মকালে গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। অথচ ভারত, বৃহত্তর অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও সম্পদের বৈচিত্র সত্ত্বেও, এই সূচকে অনেকাংশে পিছিয়ে পড়েছে।

অনস্বীকার্য যে, স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যথেষ্ট হলেও, সেই অগ্রগতিকে সমান তালে মানবোন্নয়নে রূপান্তরিত করা যায়নি। ফলে এখন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে মিলিত ভাবে একটি বিশেষ ও সুপরিকল্পিত কৌশলগত নীতি গ্রহণ করতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকে উন্নয়ন ঘটালেই চলবে না, বরং সেই প্রবৃদ্ধির সুফল যাতে সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি অঞ্চলে, প্রতিটি নাগরিকের জীবনে পৌঁছয়, সেই দিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। না হলে বড় দেরি হয়ে যাবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Health Education Healthy Lifestyle

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy