Advertisement
১৫ অক্টোবর ২০২৪
Senior Citizens

‘একলা’ প্রবীণদের জন্য

প্রবীণদের সংখ্যার বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর প্রভাব পড়তে চলেছে শ্রমবাজার, অর্থনীতি, আবাসন, পরিবার, চিকিৎসা— সর্বত্র। ভারতকেও এই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে, কারণ ২০৫০-এর মধ্যে সারা বিশ্বের প্রবীণ মানুষের ১৭%-এর বাসভূমি হতে চলেছে ভারত।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:৪১
Share: Save:

রাস্তায় হাঁটার সময় চোখ যায় ল্যাম্পপোস্ট বা ডাস্টবিনের পাশে ধুলোয় শুয়ে থাকা, ছেঁড়া কাপড় পরা মানুষের দিকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা প্রবীণ; অপুষ্টি, অসুখ, অনাদর তাঁদের প্রবীণতর করে তুলেছে। পয়লা অক্টোবর দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’ হিসাবে, সমাজের সঙ্গে প্রবীণরা কী ভাবে জড়িয়ে আছেন, সেই সত্যের উদ্‌যাপন-লক্ষ্যে। বিশ্বজোড়া প্রবীণ ও বৃদ্ধ মানুষেরা কি এই একটি দিনে সব অপমান অবহেলা ভুলে হঠাৎ খুশি হয়ে উঠতে পারেন?

রাষ্ট্রপুঞ্জ ১৯৯০ সালে এই দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। হয়তো সমাজে প্রবীণদের ভূমিকা নিয়ে এই বিশেষ দিন নির্ধারণের পিছনে আছে বিশ্বে জনবিস্ফোরণের বাস্তবতা। মৃত্যুর হার কমছে, বেড়ে চলেছে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা। ২০২২-এ বিশ্বের জনসংখ্যার ১০% ছিলেন পঁয়ষট্টির বেশি বয়সি। ২০৫০-এ তা হবে ১৬%, ২১০০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াবে ২৩%-এ। পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকার কম উন্নত দেশে প্রবীণদের অংশ জনতার মাত্র ২%। কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলিতে, উত্তর আমেরিকায়, এশিয়ার নানা দেশে প্রতি চার জন নাগরিকের এক জন প্রবীণ। ২১০০ সালের মধ্যে বেশ কিছু এশীয় দেশের সম্মিলিত নাগরিকের এক-তৃতীয়াংশ হবেন প্রবীণ। এই বৃদ্ধদের ভাল থাকা তাঁদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি।

প্রবীণদের সংখ্যার বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর প্রভাব পড়তে চলেছে শ্রমবাজার, অর্থনীতি, আবাসন, পরিবার, চিকিৎসা— সর্বত্র। ভারতকেও এই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে, কারণ ২০৫০-এর মধ্যে সারা বিশ্বের প্রবীণ মানুষের ১৭%-এর বাসভূমি হতে চলেছে ভারত। ২০১১-র জনগণনামতে, ভারতে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৪০ লক্ষ (মহিলা ৫.৩০ ও পুরুষ ৫.১০ কোটি), এঁদের ৭০%-এর বেশি থাকেন গ্রামে। শারীরিক ভাবে ক্রমশ অশক্ত হওয়া এই মানুষদের ভাল থাকার জন্য দেশে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, এ আসলে অর্ধসত্য। এঁদের ভাল রাখার দর্শনটাই এ দেশ শিখে উঠতে পারেনি। এ কথা হয়তো ঠিক, এই প্রবীণরাও অনেকে যৌবনে তাঁদের পরিপার্শ্বকে হয়তো ভাল রাখেননি; এঁদের উত্তরপ্রজন্মও কর্মব্যস্ত জীবনে ও অন্য নানা কারণে এঁদের যত্ন নিতে অপারগ। এই যুক্তিতে কিন্তু রাষ্ট্র প্রবীণদের ছুড়ে ফেলে দিতে পারে না। অথচ উচ্চবিত্ত গৃহে পরিচারক-নির্ভর প্রবীণ, মধ্যবিত্ত আবাসনে একলা হয়ে যাওয়া প্রবীণ, দরিদ্র ভিটেয় অসুস্থ প্রবীণ আর খোলা আকাশের নীচে পরিত্যক্ত প্রবীণ এ সমাজে প্রকটতম সত্য। তাঁদের সাহচর্য দেওয়ার লোক কম বা নেই, পরিবারে তাঁদের জন্য ব্যয়-বরাদ্দ ক্রমহ্রাসমান। বহু প্রবীণ ঘরের আশ্রয় থেকেই বঞ্চিত; তাঁদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা তো পরের কথা।

প্রবীণা ও বৃদ্ধাদের কথা পৃথক গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ তাঁরা আরও বিপজ্জনক পরিবেশে বাস করেন। পরিবারের লোক থেকে শুরু করে সেবাকাজে নিযুক্ত ব্যক্তির দ্বারা এঁরা যে শুধু অপমানিত ও অবহেলিত হন তা-ই নয়, প্রায়ই শারীরিক ভাবেও নির্যাতিত হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লড়াই করার প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এঁদের থাকে না (বৃদ্ধদের সাপেক্ষে বৃদ্ধাদের সাক্ষরতা অর্ধেকেরও কম)। তাঁদেরই বাড়িতে তাঁরাই কোণঠাসা হয়ে যান, তাঁদেরই সঞ্চিত অর্থ তাঁদের জন্য ব্যয় হলে তা ‘অপব্যয়’ সাব্যস্ত হয়। পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যক নারীর বার্ধক্য কাটে পরের আশ্রয়ে। ‘পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (২০১৮-১৯)’ দেখাচ্ছে, ৬০-৬৪ বছর বয়সসীমায় থাকা পুরুষের ৬৫% অর্থনৈতিক কাজে জড়িত থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে তা শহর-গ্রাম মিলিয়ে মাত্র ১৮%-এ সীমাবদ্ধ। প্রায় সব বিষয়ে বৃদ্ধাদের পরনির্ভরতা তাঁদের দুঃখের বারোমাস্যা করুণতর করে তোলে।

আর আছেন ‘একলা প্রবীণ’রা। কেউ স্বেচ্ছায় একা, কেউ পরিস্থিতির চাপে। শরীর অশক্ত, এমন অবস্থায় যদি বাড়িয়ে দেওয়ার মতো একটিও হাত না জোটে, বেঁচে থাকা একান্তই মুশকিল। ৬০-৬৪ বছরের ভারতীয় প্রবীণদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জীবনসঙ্গীকে হারিয়েছেন, অতি অল্প সংখ্যক জীবনসঙ্গী বেছে নেননি। কারও হয়তো সন্তান নেই। এ ক্ষেত্রেও পুরুষের তুলনায় ‘একা মহিলা’র সংখ্যা বেশি। ভারতে একা বার্ধক্য যাপন করছেন কত জন নরনারী, সে খবর প্রায় কেউ রাখে না। একা বাঁচাও যে মানুষের অধিকার, তা বোঝার মতো বোধে এখনও পৌঁছতে পারেনি দেশ। অথচ ধীরে হলেও এ দেশে একা বাঁচতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রাষ্ট্রের কাছে তাঁদের নিরাপত্তার দাবি কি অসঙ্গত?

প্রবীণ, বিশেষত একা হয়ে যাওয়া প্রবীণের সমস্যার সঙ্গে যুঝতে উন্নত দেশগুলি নানা নিরীক্ষা করছে। কেউ তৈরি করেছে ‘টাইম ব্যাঙ্ক’, প্রবীণকে সহায়তা করলে তাতে সময়-পুঁজি সঞ্চিত হয়। কোথাও অফিসকর্মী বা ছাত্রদের বলা আছে কোনও প্রবীণকে ফোন করে রোজ খানিক গল্প করতে। ভারতে প্রবীণদের জন্য দু’-একটি ভোটমুখী প্রকল্প ঘোষণা করেই রাষ্ট্র রণে ভঙ্গ দেয়, অন্য দিকে বাড়তে থাকে তাঁদের যন্ত্রণা। বৃদ্ধাবাস স্থায়ী সমাধান দেয় না, প্রয়োজনের তুলনায় তা আণুবীক্ষণিক। তা ছাড়া তার খরচ জোগানোর ক্ষমতাও বা ক’জন প্রবীণের আছে? রাষ্ট্রকে প্রবীণদের কথা ভাবতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে। প্রবীণরাও কর দেন, নির্বাচনে অংশ নেন, সমাজের ভরকেন্দ্র ঠিক রাখেন। রাষ্ট্র তাঁদের চিকিৎসা, বিকল্প কাজ, একাকিত্ব দূরীকরণ ও সহায়তা দানের জন্য আলাদা মন্ত্রক গড়ে স্থায়ী ব্যবস্থা করবে না কেন? নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের মতো ‘প্রবীণ কল্যাণ’ মন্ত্রক কেন থাকবে না?

অন্য বিষয়গুলি:

Senior Citizens United Nations negligence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE