এই নিরন্তর ‘অরওয়েলীয়’ বাস্তব— যুদ্ধ, বোমাবর্ষণ, পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা, প্লেন-দুর্ঘটনা, সেতু ভেঙে মৃত্যু, রেল বেলাইনে মৃত্যু— এই সবের মধ্যে বসে মন যখন ভারাক্রান্ত, অবসাদগ্রস্ত, তখন একটা সুসংবাদ এলে তাকে যেন মনে হয় দুঃস্বপ্নের রাতের শেষে ভোরবেলার সূর্যের আলো।
আমেরিকার নিউ ইয়র্কের অতি-ধনিক শ্রেণি, তাদের বড় বড় ব্যাঙ্ক, দর্পিত ওয়াল স্ট্রিট, তাদের সুবিশাল প্রোপাগান্ডা যন্ত্র ও প্রচারমাধ্যম এবং যুদ্ধবাদী গণহত্যা সমর্থনকারীদের চার দিক ছাপানো হুঙ্কার— এই সবকে হারিয়ে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে এগিয়ে গেলেন তেত্রিশ বছর বয়সের জ়োহরান মামদানি। ‘এগিয়ে’ মানে এ ক্ষেত্রে ‘জিতে’ই ধরে নেওয়া যায়। হারালেন কাকে? বিশাল গুরুত্বের ডেমোক্র্যাটিক নেতা অ্যান্ড্রু কুয়োমোকে, যে কুয়োমো এই সে দিন পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর ছিলেন। যাঁর পিছনে বিল ক্লিন্টন, হিলারি ক্লিন্টন, চাক শুমার জাতীয় বড় মাপের রাজনীতিকদের সমর্থন, যাঁর পিছনে নিউ ইয়র্কের শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়নগুলোরও সমর্থন। যদিও ট্রাম্পের মতোই কুয়োমোর বিরুদ্ধেও নারী-নির্যাতনের অভিযোগ, তবে ট্রাম্পের মতোই তাঁর ক্ষেত্রেও, ও-সব কথা মানুষ আজ ভুলে গেছে। ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কে এই জ়োহরান মামদানি? এক বিরাট সংখ্যক আমেরিকান তাঁর নামটাই উচ্চারণ করতে পারেন না। মামদানির জনমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোর কথা তাঁদের কানে পৌঁছয় না। ঠিক যেমন ভারতে এখন মুসলিম নাম শুনলেই ‘ফোবিয়া’ কাজ করে, নিদেনপক্ষে বিরূপ সমালোচনা সৃষ্টি হয় ‘মূলস্রোত’ সমাজে, আমেরিকাতেও তেমন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প থেকে শুরু করে আমেরিকার সমাজের এক বিরাট অংশ এখন মামদানির বিরুদ্ধে, এবং তাঁর অভিবাসী পরিবারের বিরুদ্ধে নিকৃষ্টতম অপপ্রচারে ব্যস্ত।
কে মামদানি, তা বোঝার জন্য বরং দেখা যাক কী বলেন এই মামদানি। বলেন, নিউ ইয়র্কে গরিব মানুষের উন্নয়নের কথা। বলেন, অ্যাসফল্ট স্কুল চত্বরগুলোকে সবুজায়ন করার কথা। বলেন, অতি শক্তিশালী ধনী বাড়িওয়ালারা যেন যখন খুশি বাড়িভাড়া বাড়াতে না পারেন, তার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করার কথা। বলেন, আরও বেশি মানুষ যেন আধুনিক গণ-পরিবহণব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারেন, তার কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নিউ ইয়র্কের অবিশ্বাস্য সম্পদশালী ধনিকশ্রেণির উপর কর বসানোর কথা! কেন নিউ ইয়র্কে কিছু মানুষ রাজা রানি ও রাজপরিবারের মতো জীবনযাপন করবেন, আর এক বিশাল সংখ্যক মানুষ অনাহারে, দারিদ্রে, রোগে, শোকে, যন্ত্রণায়, একাকিত্বে গ্রস্ত হয়ে থাকবেন, সেই অসম্ভব স্পর্ধিত প্রশ্নটি তিনি তুলেছেন। পুলিশ কেন গরিব মানুষের উপর অত্যাচার করে যাবে, সে কথাও জানতে চেয়েছেন।
ফলে ওয়াল স্ট্রিট ও ক্লিন্টন ডেমোক্র্যাটদের চক্ষুশূল হয়েছেন তিনি। তাদের প্রোপাগান্ডা মিডিয়া তাঁর বিরুদ্ধে সীমাহীন অপপ্রচার চালিয়ে গেছে। তবুও তিনি জিতে গেলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ায়, বিশাল ভোটে। সত্যিই এ এক নিঃশব্দ বিপ্লব, বলা চলে। নিউ ইয়র্কের মানুষ প্রমাণ করে দিল অর্থ ও প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে ব্যালট-বাক্সে সাধারণ মানুষের রায়দানই শেষ কথা।
নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনেও এই শহরের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম কাউন্সিল সদস্য সাহানা হানিফ ‘পুনর্নির্বাচিত’ হলেন। এই মুহূর্তে, যে আমেরিকায় প্যালেস্টাইনের গণহত্যার বিরুদ্ধে, ইরানে বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বললেই তা দ্রোহের শামিল, সেখানে যে সব নেতা ও নেত্রী সরবে সজোরে এই সব কথা বলছেন, জ়োহরান মামদানি, সাহানা হানিফ তাঁদের সামনের সারির নেতা ও নেত্রী। এই মুহূর্তে তাই তাঁদের বিশাল ভোটে বিজয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমেরিকার রাজনীতি কি একটা নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে? রাজনীতিতে কি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করছে? আমেরিকায় আসা অভিবাসীদের ‘আমেরিকান’ সন্তানরা যোগ দিচ্ছে? এরা আধুনিকতার পক্ষে, উদারতার পক্ষে, লিঙ্গ ও জাতির সমানাধিকারের পক্ষে। যুদ্ধ, হিংসা, ধর্মান্ধতা, পুলিশি অত্যাচারের বিপক্ষে। এরা জলবায়ু সঙ্কটের তীব্রতা বোঝে। ট্রাম্পের বেপরোয়া শাসন যে স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, তা বোঝে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধতা করা জরুরি, তা-ও বোঝে।
এরা গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই সমাজ পরিবর্তন চায়। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েগুলো চায় যুদ্ধ, বঞ্চনা ও ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা, সমানাধিকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ‘বিগ মিডিয়া’র বিরুদ্ধে, অতি-ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়।
মামদানি ‘নির্বাচিত’, ‘বিজয়ী’, শব্দগুলি এখনও উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে। কেননা আসল নির্বাচন হবে নভেম্বর মাসে। এখন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ‘প্রাইমারি’ নির্বাচনে সেই দলের প্রার্থী হলেন। সাধারণ ভাবে, নিউ ইয়র্ক শহরে এই দলের প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ মানেই মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়, নভেম্বর মাসের আসল নির্বাচনে জয়লাভ— কারণ এখানে রিপাবলিকান পার্টির জয়ের কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মামদানির ক্ষেত্রটা আলাদা। তাঁর বিরুদ্ধে যেমন খড়্গহস্ত দেখা যাচ্ছে ‘ক্লিন্টন ডেমোক্র্যাট’দেরও— তাতে রাজনৈতিক অন্তর্ঘাতে তাঁর নিজের পক্ষই তাঁকে কোণঠাসা করবে, সে আশঙ্কা বিরাট। তবে যদি তা ঘটেও, তবু আজকের দিনটি সত্যি। আজকের বিজয় বলে দেয়, এই আমেরিকার মধ্যে জেগে উঠছে আর এক আমেরিকা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)