E-Paper

কোথায় সেই ঝাউবন ছায়া

ইতিহাস বলে, দিঘার আদি নাম বীরকুল। প্রসিদ্ধিলাভ অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে। ওয়ারেন হেস্টিংস দিঘাকে বলেছিলেন ‘প্রাচ্যের ব্রাইটন’— ইংল্যান্ডের সমুদ্রতীরে ছোট্ট সে শহর, ছুটি কাটানো, আনন্দ উপভোগের জন্য ইংরেজদের প্রিয়।

আকাশ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:১৪

দক্ষিণ এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া-সহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদ একটি চিরসবুজ গাছ: ক্যাসুরিনা। চলতি কথায় ‘বিলিতি ঝাউ’। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন: ‘চলো রিনা— ক্যাসুরিনার ছায়া গায়ে মেখে, এঁকে বেঁকে, লাল কাঁকরের পথ ধরে, একটু একটু করে এগিয়ে যাই...’ তার পর থেকে, যে বাঙালি দিঘার সৈকত দেখেছে, সে ক্যাসুরিনা চেনে। এ গানে কোথাও দিঘার উল্লেখ ছিল না। কিন্তু, ১৯৭১ সালের এ গান তার পরের তিন দশকে যাঁরা শুনেছেন, কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন, গানটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে দিঘার ঝাউবনের ছবি ভেসে ওঠা? বাঙালির নিজস্ব সমুদ্রসৈকত— যেখানে অনেক কিছুই ছিল না, কিন্তু সাগরের ঢেউ-মাখা বালুতটের পরে অনন্ত ঝাউবন ছিল, হারিয়ে যাওয়ার জন্য?

ইতিহাস বলে, দিঘার আদি নাম বীরকুল। প্রসিদ্ধিলাভ অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে। ওয়ারেন হেস্টিংস দিঘাকে বলেছিলেন ‘প্রাচ্যের ব্রাইটন’— ইংল্যান্ডের সমুদ্রতীরে ছোট্ট সে শহর, ছুটি কাটানো, আনন্দ উপভোগের জন্য ইংরেজদের প্রিয়। ১৯২০-র দশকে জন ফ্র্যাঙ্ক স্নেথ নামে এক ভ্রমণপ্রিয় ব্রিটিশ বসবাস শুরু করেন দিঘায়। তাঁর লেখার সূত্রেই মানুষের আগ্রহ বাড়ে। স্বাধীনতা-উত্তর এখানে পর্যটনের সুবিধা বাড়াতে তিনিই উৎসাহ দেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে। কলকাতা থেকে দিঘার পথে একাধিক নদীর উপরে গাড়ির চলাচলযোগ্য সেতু তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয় এই সময় থেকে। অনেক পরে আরও নিবিড় উন্নয়নের লক্ষ্যে তৈরি হয় ‘দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ’।

অস্বীকারের উপায় নেই যে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিমতো গোয়া না হয়ে উঠলেও দিঘার উন্নয়ন হয়েছে বটে। দিঘার মেরিন ড্রাইভ দিয়ে চলার সময় মুম্বইয়ের ‘কুইন’স নেকলেস’-এর কথা মনে পড়া স্বাভাবিক। মহার্ঘ হোটেল, জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের রেস্তরাঁ, নামী প্রকাশনীর বই বিপণি, লোকমুখে ‘জাহাজবাড়ি’ নামে সমাদৃত কমিউনিটি সেন্টার— কী নেই দিঘায়! উন্নয়নের প্রভাব কত গভীর, উপলব্ধি করা যায় চোখ মেলে তাকালেই। প্রায় গোটা দিঘা তন্নতন্ন করে খুঁজলেও যেন চোখে পড়বে না একটি বিশুদ্ধ ব্যক্তিগত বাসগৃহ! সম্ভ্রান্ত থেকে সাধারণ, প্রায় সমস্ত বসতবাটী এখন সরাইখানায় পরিণত। যেখানে এখনও গৃহস্থের বাস, তারও একাংশে অবধারিত ভাবে হোম-স্টে বা অতিথিশালা।

প্রশস্ত বাইপাস তৈরির পর যানজটের সমস্যা অনেকটাই কমেছে। সমুদ্রের পাড়ব্যাপী চওড়া গার্ড ওয়াল বাঁধানো দামি পাথরে। পাশ দিয়ে জায়গাবিশেষে দীর্ঘ প্রশস্ত হাঁটাপথ। সেই প্রাচীরের গায়ে কটালের সময় খেপা মহিষের মতো শিং বাগিয়ে এসে ধাক্কা দেয় সাগরের জল। হঠাৎ উছলে-ওঠা ঢেউয়ের সঙ্গে কুমির-ডাঙা খেলা চলে পর্যটকদের। নেহরু মার্কেটের বিপরীতে পুরনো দিঘার বাঁধানো চত্বরে সম্বৎসর যেন সান্ধ্যকালীন মেলার আয়োজন।

ভোজনপ্রিয় ভ্রমণার্থীর জন্য আছে ভোরের ঘোলা আলোতেই জমে ওঠা মোহনায় পাইকারি মাছের বাজার। সস্তায় কেনা তাজা মাছ ভাজায়-ঝোলে-ঝালে-অম্বলে খাওয়ার বন্দোবস্ত করে নেওয়া যায় সাগরপাড়ের ঝুপড়িতে, ফরমায়েশ মোতাবেক। ইলিশ মনে ধরলে থার্মোকলের বাক্সে বরফ-নুন দিয়ে অন্তত দিন দুই ভাল থাকবে এমন ব্যবস্থা করে কলকাতা নিয়ে আসার বন্দোবস্তও হয়ে যাবে চোখের পলকে। সর্বোপরি রয়েছে নবপ্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ মন্দির। সরকারি কাগজে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সাইনবোর্ডে ‘ধাম’। সন্নিকটেই জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি। পুরাতন, প্রসিদ্ধিহীন জগন্নাথ মন্দিরটিই মাসির বাড়িতে রূপান্তরিত।

গোটা সৈকত জুড়ে খুঁজলেও অবশ্য এই একটি জায়গা ছাড়া আর চোখে পড়ে না ক্যাসুরিনার বন। যেটুকু আছে, তা এই ‘মাসির বাড়ি’র কাছে। বাকিটা উন্নয়ন উদরস্থ করেছে। কথাসাহিত্যে দিঘার প্রসঙ্গ এলেই এই ঝাউবনের উল্লেখ ছিল অবধারিত। টলিপাড়ার স্বল্প পুঁজির আউটডোর শুটিং-এর অমোঘ গন্তব্য দিঘার ঝাউবনের সারি কত বার যে সেলুলয়েড-বন্দি হয়েছে বাংলা ছবিতে!

অনেক কিছুই আছে আজকের দিঘায়। অমরাবতী পার্ক, দিঘা বিজ্ঞানকেন্দ্র ও কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান শিবির, মোহনা ওয়াচ পয়েন্ট, মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম অ্যান্ড রিজিয়নাল সেন্টার, ঢেউসাগর পার্ক। শুধু চিরতরে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে পাড় জুড়ে প্রকৃতির আপন খেয়ালে গড়ে ওঠা ঝাউবনের প্রাচীর। সপ্তাহের পাঁচ দিন ধরে ‘উইকএন্ড’-এর প্রহর-গোনা দিঘায় কারও সম্ভবত ভাবার সময় নেই, কী হবে আবার কোনও দিন হঠাৎ সমুদ্রের জল ফুঁড়ে সুনামি আক্রমণ করতে এলে! কে বাঁচাবে আবার, কোনও ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়বে যে দিন! গার্ড ওয়াল আর তার সামনে ফেলা পুরনো পাথুরে বোল্ডার, অথবা আরব সাগরের ধারে মেরিন ড্রাইভ পাড়ের ধাঁচে তৈরি তেচোখো কংক্রিটের ব্লক বা ‘টেট্রাপড’গুলো যদি সব ধাক্কা সে দিন সামলে দিতে না পারে?

অথচ এখনও উইকিপিডিয়ায় দিঘা সম্পর্কে লেখা, “এখানে ঝাউ গাছের সৌন্দর্যায়ন চোখে পড়ে; যা ভূমিক্ষয় রোধেও সমান সহায়ক।” পিন্টু ভট্টাচার্যের গান মনে বাজে, ‘চলো না দিঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায়।’ সেই ঝাউবন নিয়ে কথা বলবে কে, আর কবে?

বাংলা বিভাগ, শ্রীগোপাল ব্যানার্জী কলেজ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tamarisk trees awareness

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy