আহমদ ছফা বলেছিলেন, তিনি বদরুদ্দীন উমরের যুগে বাস করেন বলে গর্বিত। ছফা প্রয়াত হয়েছেন ২০০১ সালে। তার আড়াই দশক পরে শেষ হল বদরুদ্দীন উমরের যুগ।
৯৪ বছরের জীবনে উমর (ছবি) দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, তিনটি গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। নৈর্ব্যক্তিক ভাবে লিখেছেন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক জীবনী। তাঁর বর্ণিত ইতিহাস দলীয় এবং ধর্মীয় স্বার্থসংলগ্ন ইতিহাসের একমাত্রিক বয়ানকে চুরমার করে দিয়েছে। চিরকাল তিনি ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রের কাছে অস্বস্তিকর থেকেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে অনুপেক্ষণীয়ও থেকেছেন। তাঁর জনপদের ইতিহাসচর্চা তাঁকে বাদ দিয়ে অসম্ভব।
ক্ষমতার বিপ্রতীপে থাকা উমর কোনও রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি পুরস্কার গ্রহণ করেননি। প্রত্যাখ্যান করেছেন বাংলা একাডেমি, ইতিহাস পরিষদ-সহ অসংখ্য পুরস্কার। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে প্রত্যাখ্যান করেছেন স্বাধীনতা পদক। প্রতিস্পর্ধী যাপনের তৃপ্তিতে উমর বলেছেন “সেই জীবনই যাপন করেছি, যা করতে চেয়েছি।”
উমরের জন্ম বর্ধমানে, ১৯৩১ সালে। বাবা আবুল হাশিম অবিভক্ত বাংলার গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লীগ নেতা। দেশভাগের পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গ ছাড়তে চাননি। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক হিংসার পর আবুল হাশিম সপরিবারে ঢাকায় চলে যান। ২০২৩ সালে বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, “পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া উদ্বাস্তুদের নিয়ে কত উপন্যাস, কত সিনেমা, কত আলোচনা! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে চলে আসার স্মৃতি নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা নেই। এই নৈঃশব্দ্য রাজনৈতিক।”
আবুল হাশিম মুসলিম লীগ করলেও পরিবারে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ছিল যথেষ্ট। কলকাতায় ২ নম্বর পার্ক সার্কাস রোডের বাড়িতে কমিউনিস্ট রাজনীতির চর্চাই হত বেশি। ১৯৫০ সালে উমর ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন দানা বাঁধছে ভাষা আন্দোলন। আরমানিটোলায়, আমতলায়, ভিক্টোরিয়া পার্কে সভা হচ্ছে ছাত্রদের। উমর উৎসাহী শ্রোতা। তখনও তিনি রাজনৈতিক কর্মী নন। নিজেকে বলছেন ভাষা আন্দোলনের ‘সচেতন অবলোকনকারী’।
১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত হল সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। তার ইস্তাহার লিখলেন উমর। অনেক বছর পরে উমর লিখবেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি।
ছফা বলেছিলেন, উমর যদি সারা জীবনে আর কিছু না-ও করতেন, কেবলমাত্র তিন খণ্ডের এই গ্রন্থের জন্যই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এই মহাগ্রন্থে উমর দেখিয়েছেন কী ভাবে ঢাকার ছাত্রসমাজের সংগ্রামের সঙ্গে পূর্ব বাংলার মেহনতি মানুষের লড়াই মিশে গিয়েছিল। দ্বিতীয় অংশের অংশগ্রহণই ভাষা আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করেছিল। ১৯৪৮ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, সেই সময়ের সঙ্গে ১৯৫১-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দুস্তর পার্থক্য। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর পুরনো ঢাকার বাসিন্দারা চড়াও হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে তাঁরাই ছিলেন আন্দোলনের প্রধান শক্তি। উমরের কথায়, “বাংলা ভাষাটা শিক্ষিত লোকের চেয়ে গরিবদের অনেক বেশি দরকার।”
উমরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে কৃষক সমাজ এবং দুর্ভিক্ষ। পূর্ব বাংলার রায়ত এবং কৃষকরাই পাকিস্তান এনেছিলেন। কিন্তু দ্রুতই তাঁদের মোহভঙ্গ হয়। ভাষা আন্দোলনের আগের কয়েক বছর পূর্ব বাংলায় ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটে বহু গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল। উমর দেখিয়েছেন, কৃষকসমাজের ক্ষোভ ভাষা আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা উমর উচ্চশিক্ষার জন্য যান অক্সফোর্ডে। চাকরি ছাড়ার পর মওলানা ভাসানী তাঁকে প্রস্তাব দেন কৃষক সভার সম্পাদক হওয়ার। উমর নারাজ, তিনি গ্রাম ও কৃষক সম্পর্কে কিছুই জানেন না। পরে যোগ দিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন ‘চিনপন্থী’ কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দল যে অবস্থান নিল, তিনি তা সমর্থন করেননি। আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, “মওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানদের কাণ্ডজ্ঞান কমিউনিস্ট নেতাদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল।”
উপমহাদেশের বামপন্থীদের তীব্র সমালোচক উমরের মতে, সাম্যতন্ত্রী শিবিরের বিভাজন অনেক ক্ষেত্রেই মতাদর্শিক নয়, বরং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের ফসল। বামপন্থীদের বিভক্তি নিয়ে বলেছেন, “মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়ে না। লড়াই করতে করতে ঐক্য হয়।”
জয়া চট্টোপাধ্যায়, পেরি অ্যান্ডারসনের আগেই উমর দেখিয়েছেন বঙ্গভঙ্গের প্রকৃত দায় কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশের। কলকাতা-কেন্দ্রিক নবজাগরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ গ্রন্থে। দেখিয়েছেন দ্বিজাতিতত্ত্ব এসেছে উনিশ শতকে, হিন্দু মেলার হাত ধরে। তাঁর তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক থাকবেই, কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’-এর লেখক হয়ে উঠেছেন কলকাতা-কেন্দ্রিকতার বিপরীতে ঢাকার প্রতিরোধী চিহ্ন।
বদরুদ্দীন উমর ছিলেন গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর অভিমত, বাংলাদেশের মতো জনপদে শহরাঞ্চলের ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে জনতাকে সংগঠিত করে অভ্যুত্থানই প্রকৃত পথ। তাঁর সহযোদ্ধা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে উমরের ভাবনার আভাস মেলে। বাংলাদেশে ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান উমরের বক্তব্যের প্রমাণ। তিনি প্রথমটিকে ‘নাগরিক বুর্জোয়া অভ্যুত্থান’ এবং দ্বিতীয়টিকে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান’ বলেছেন। একই সঙ্গে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থার উত্থান নিয়েও উমরসরব হয়েছেন।
উমর মনে করতেন মাতৃভাষায় শিক্ষা জাতীয় উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাঙালি পরিচয়কে ব্যবহারকারী যে উচ্চ রাজনীতি, তার বিরুদ্ধেও তিনি সরব। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনতার সংগ্রামের পরম বন্ধু ছিলেন তিনি।
বদরুদ্দীন উমরের ম্যাজিক এখানেই: তাঁকে কোনও ফ্রেমে আটকানো কঠিন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)