Advertisement
১৭ মে ২০২৪
শেষ হাসি ‘বাঙাল’দেরই
Bangladesh

‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ ইত্যাদি কুডাককে মিথ্যা প্রমাণ করে সাফল্যের কাহিনি

পূর্ব পাকিস্তানকে কার্যত দাস করে রাখা হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিক এবং সামরিক কর্তারা ছিলেন আসল প্রভু।

উদীয়মান: বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্পের কারখানাগুলি ক্রমেই বিশ্বমানের হয়ে উঠছে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

উদীয়মান: বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্পের কারখানাগুলি ক্রমেই বিশ্বমানের হয়ে উঠছে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:০৭
Share: Save:

বা‌ংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে গোটা পৃথিবী তার প্রশংসায় মুখর, কারণ জাতিগঠনে সে সফল, সফল একটি সতেজ এবং প্রসরণশীল অর্থনীতির সৃষ্টিতে। প্রশংসার যথেষ্ট কারণ আছে বইকি। সত্তরের দশকের গোড়ায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়, সে-দিন অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে সে হবে এক ব্যর্থ রাষ্ট্র (‘ফেলড স্টেট’)। আমেরিকার তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তো বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অথচ আজ সমস্ত মাপকাঠিতেই এই দেশ দ্রুত অগ্রগতির পথে, এমনকি তুলনীয় অন্য অনেক দেশের সামনে আদর্শ হওয়ার দাবিদার।

কী করে সম্ভব হল এটা? হয়তো তিনটি কারণে।

প্রথম কারণ অবশ্যই প্রবলতর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ঔপনিবেশিক সম্পর্কের জাল ছিঁড়ে স্বাধীন হতে পারা। এটাই একেবারে প্রধান সাফল্য। পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের জামাতি শাগরেদরা হাজার হাজার বাংলাদেশি মানুষকে খুন-ধর্ষণ করেছে, কিন্তু তাঁরা তাঁদের লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন যত ক্ষণ না মুক্তি আসে। পূর্ব পাকিস্তানকে কার্যত দাস করে রাখা হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিক এবং সামরিক কর্তারা ছিলেন আসল প্রভু। পূর্ব পাকিস্তানকে অনগ্রসর এবং দারিদ্রে নিমজ্জিত রেখে তার আর্থিক সম্পদ তাঁরা শোষণ করে চলতেন। একই সঙ্গে তাঁরা এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছিলেন যাতে পুবের বাঙালিরা কখনও পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার না পান।

এই অন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেল, যখন সাধারণ নির্বাচনে সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ দিতে অস্বীকার করলেন পশ্চিমের প্রভুরা। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসতে না দিয়ে তাঁকে কারাগারে বন্দি করা হল। এর প্রতিবাদে দেশের পূর্ব ভূখণ্ড তুমুল বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, যে ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিভাজন ঘটাল, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে।

বাংলাদেশের সাফল্যের দ্বিতীয় কারণটিও নিহিত আছে সমান সচেতন এবং দৃঢ় এক সঙ্কল্পে। বাংলাদেশ তার ভূতপূর্ব প্রভু-রাষ্ট্র পাকিস্তানের মতো হিংসা, ধর্মান্ধতা এবং সামরিক বাহিনীর আধিপত্যের পথ নেয়নি। দেশের মধ্যে রীতিমতো শক্তিশালী চরমপন্থী গোষ্ঠীরা কোনও কোনও সময়ে চেয়েছিল নতুন এই রাষ্ট্রও পাকিস্তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করুক, কিন্তু দ্রুত শুভবুদ্ধির জয় হয়। বাংলাদেশ মোটের উপর একটি শান্তিপ্রিয় আইন-অনুগামী দেশ হিসাবেই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে, মৌলবাদের অভ্যুত্থান ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ তাকে বিপথগামী করতে পারেনি, আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটাতে বা আগ্রাসী বিদেশ নীতি অনুসরণ করতে চায়নি এই রাষ্ট্র।

এই সংযম কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতি বজায় রাখতেই সাহায্য করেনি, শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেও সহায়ক হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার খরচ সীমিত রাখতে পেরেছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে জনসাধারণের প্রয়োজন মেটাতে।

ভূতপূর্ব প্রভু পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতির এই পার্থক্যের ফল কী দাঁড়িয়েছে, খতিয়ে দেখা যেতে পারে। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তান শতকরা ৭০ ভাগ বেশি সম্পন্ন ছিল। এখন পাল্লাটা উল্টে গিয়েছে। এক দিন যে ভূখণ্ড ছিল পাকিস্তানের হতদরিদ্র, ব্যাধিজর্জর এক অঞ্চল, আজ তা অর্থনীতির মোট আয়তনে এবং আপেক্ষিক বিচারেও পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ এখন আনুমানিক শতকরা ৪৫ ভাগ বেশি সম্পন্ন; তার মাথাপিছু আয় ২,৫৫৪ ডলার, পাকিস্তানের মাত্র ১,৫৪৩ ডলার। (এই লেখায় ডলার মানে সব সময়েই আমেরিকান ডলার।) পাকিস্তানের জিডিপি এখন ২৯৬ বিলিয়ন (২৯,৬০০ কোটি) ডলার, বাংলাদেশের ৪০৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের পণ্য ও পরিষেবা রফতানির মোট অঙ্ক ৩৮ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ২৬ বিলিয়ন ডলার; বিদেশি ঋণের দায়ে পাকিস্তানের মাথা বিকিয়ে গিয়েছে, চিন, সৌদি আরবের মতো দেশের কাছে বা আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানের দুয়ারে ভিক্ষাপাত্র হাতে ঘুরতে হয় তাকে।

১৯৭১ সালের লজ্জাকর পরাজয়ের পরেও পাকিস্তানের শাসকরা সামরিক এবং সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন এলাকা দখল বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছাড়েননি। কাশ্মীরে তাঁরা পারেননি বটে, কিন্তু আফগানিস্তানে সম্প্রতি সফল হয়েছেন, যার পরিণামে সেখানে আরও অনেক দুর্দশা এবং ধারাবাহিক রক্তক্ষয় চলবে। তাঁদের বন্দুকের জোরে শাসন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নাগরিকদের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে, তাঁরা ক্রমাগত সব হারাচ্ছেন, আর কাশ্মীরে ও আফগানিস্তানে জেহাদ চালাতে কোটি কোটি টাকা ঢালছেন দেশের শাসকরা।

বাংলাদেশ তার সীমিত বাজেটের অনেকটাই খরচ করছে শিক্ষায় (সরকারি খরচের ১১ শতাংশ), স্বাস্থ্য পরিষেবায় (৪ শতাংশ), যেখানে প্রতিরক্ষায় তার বরাদ্দের অনুপাত প্রায় ৯ শতাংশ। পাকিস্তানের সরকারি বাজেটের ১৮ শতাংশ খরচ হয় প্রতিরক্ষায়, শিক্ষায় মাত্র ২.৫ শতাংশ, স্বাস্থ্য পরিষেবায় ১.২ শতাংশ! পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আর সন্ত্রাস সৃষ্টির কাঠামোর পিছনে বিপুল টাকা খরচ হয়, যা মূল্যবৃদ্ধিতে বড় রকমের ইন্ধন জোগায়; পাকিস্তানে মূল্যবৃদ্ধির হার এখন অত্যন্ত চড়া— ৯ শতাংশেরও বেশি, বাংলাদেশে সেটা ৫.৬ শতাংশ। ১ ডলারের দাম এখন ১৭৮ পাকিস্তানি রুপি, আর ৮৫ বাংলাদেশি টাকা, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকার দাম পাকিস্তানি রুপির দ্বিগুণ।

বাংলাদেশ একেবারেই অন্য পথে এগিয়েছে: সবচেয়ে বড় কথা হল, সে একটি উদীয়মান সভ্য দেশ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। আর, পরিহাসের বিষয়, এক সময় যে পাকিস্তান ছিল পশ্চিম দুনিয়ার নয়নের মণি, আজ তাকে ব্যর্থ-হতে-চলা একটি রাষ্ট্র বলে গণ্য করা হচ্ছে, যদি না ইতিমধ্যেই সে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দলে চলে না গিয়ে থাকে। দুনিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলেই পাকিস্তানি পাসপোর্টকে সুনজরে দেখা হয় না। এই হল জেহাদের পরিণাম।

বাংলাদেশ যে তুলনায় সফল হয়েছে, তার তৃতীয় বড় কারণ হল একটি শক্তিশালী উদ্যোগী শ্রেণি। সে দেশে ধনতন্ত্রকে খারাপ বলে মনে করার চল নেই। বাংলাদেশের বড় উদ্যোগীরা বিরাট সব বাণিজ্য-সংস্থা তৈরি করেছেন, বিশ্ব অর্থ বাজারে ক্রমশ যাদের পরিচিতি বাড়ছে। এক সময় কেবল বাংলাদেশের পোশাক রফতানির কথাই বলা হত, এখন সেখানে ওষুধ, বিদ্যুৎ, ব্যাঙ্কিং এবং অর্থলগ্নি-প্রযুক্তির মতো নানা ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি হচ্ছে। শেয়ার বাজার এখনও প্রাথমিক স্তরে, কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তার সম্ভাবনাটাকে ইদানীং নজর করছেন। বিশ্ব লগ্নি বাজারে উপদেষ্টা সংস্থা ডন গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে, তারা “বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী”, কারণ সে দেশের আর্থিক নীতি রচনার ইতিহাস ভরসা দেয়, দেশের জনবিন্যাস উন্নয়নের অনুকূল— তরুণ, শিক্ষিত, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ওয়াকিবহাল বহু কর্মী আছেন সেখানে, এবং দেশের অর্থনীতিতে একটা ভারসাম্য আছে— উত্তরোত্তর জাতীয় আয়ের ক্রমবর্ধমান অংশ আসছে পরিষেবা থেকে।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের সঙ্গে তার পশ্চিমি প্রতিবেশীর তুলনা এসে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে বড় ব্যবসা এখনও একটি নোংরা শব্দ হিসাবেই বিবেচিত, এক বড় আকারের মোটরগাড়ি প্রকল্পকে সেই রাজ্য থেকে তাড়ানো হয়েছিল, সেখানে আধুনিক বাঙালি উদ্যোগের প্রসিদ্ধ নিদর্শন হল নানা রকমের তথাকথিত চিট ফান্ড, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে ধন্য হয়ে যারা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম নাগরিকের কোটি কোটি টাকা লুট করেছে।

পশ্চিমবঙ্গ এবং ব্রিটিশ ভারতের এক কালের রাজধানী কলকাতা অতীতে ছিল ভারতের সবচেয়ে অগ্রবর্তী এবং সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির অন্যতম। পশ্চিমের বাঙালিরা পুবের ‘বাঙাল’দের পশ্চাৎপদ, গরিব এবং সাংস্কৃতিক ভাবে অনগ্রসর বলে মনে করত। আজ ১,৬৯৫ ডলার মাথাপিছু আয় আর ২১০ বিলিয়ন ডলার মোট আয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের পিছনে, অংশত পাকিস্তানেরও।

স্পষ্টতই, শেষ হাসি পূর্ব বঙ্গের মানুষই হাসছেন। শাবাশ বাংলাদেশ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE