E-Paper

চিন-নির্ভরতার বিপদ এড়িয়ে

বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিরল মৃত্তিকা খনিজগুলির বিপুল চাহিদা থাকলেও মাত্র কয়েকটি দেশ এগুলি উৎপাদন ও রফতানি করে— যাদের মধ্যে চিন সর্বাগ্রগণ্য।

শাশ্বত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৫ ০৬:২৭

রেয়ার আর্থ মিনারেল বা বিরল মৃত্তিকা খনিজ আসলে যে খুব বিরল, তা নয়। ১৫ ধরনের ল্যান্থানাইড (পর্যায়সারণিতে ল্যান্থানাম থেকে লিউটেটিয়াম), এবং স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়াম— এই ১৭টি মৌলের দুষ্প্রাপ্যতার কারণ হল, এগুলো প্রকৃতিতে অবস্থান করে অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত ভাবে; ফলে, এদের নিষ্কাশন সাধারণত আর্থিক ভাবে অলাভজনক। এ দিকে, পরিবেশবান্ধব ও সুস্থায়ী শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই খনিজগুলির ভূমিকা বিপুল। ইলেকট্রনিক্স, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও তা-ই।

আধুনিক ব্যাটারি প্রযুক্তিতে লিথিয়াম যেমন অত্যন্ত প্রয়োজন, তেমনই সুস্থায়ী শক্তিপ্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বিরল মৃত্তিকা মৌলগুলির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। বায়ুকলে ব্যবহৃত চুম্বক, বিদ্যুৎ-চালিত যানবাহনের মোটর, বিদ্যুৎ সঞ্চয়ক ব্যাটারিতে ব্যবহৃত জ্বালানি কোষ, সৌর প্যানেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশে বিরল মৃত্তিকা খনিজের প্রভূত ব্যবহার রয়েছে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে (যেমন, এমআরআই মেশিন, ক্যানসার চিকিৎসা ইত্যাদি), মহাকাশ সম্পর্কিত ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিরল মৃত্তিকা খনিজের ব্যবহার অনেক। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির বিশ্লেষণ অনুসারে, আগামী দু’দশকে বিরল মৃত্তিকা খনিজের বৈশ্বিক চাহিদা দ্বিগুণ হবে; এবং তার প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হবে স্বচ্ছ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে।

বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিরল মৃত্তিকা খনিজগুলির বিপুল চাহিদা থাকলেও মাত্র কয়েকটি দেশ এগুলি উৎপাদন ও রফতানি করে— যাদের মধ্যে চিন সর্বাগ্রগণ্য। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর বৃহত্তম বিরল মৃত্তিকার ভান্ডারটি (৪৪০ কোটি টন) রয়েছে চিনে— তা গোটা দুনিয়ার মোট বিরল মৃত্তিকা খনিজ ভান্ডারের (১১৫৬ কোটি টন) প্রায় ৩৮%। এ ছাড়া, ১৮% খনিজ রয়েছে ব্রাজ়িলে। কিন্তু বিরল মৃত্তিকা মৌলের আন্তর্জাতিক উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ (৩.৫৬ লক্ষ টনের মধ্যে ২৪০ হাজার টন) চিনে, ও ১২.২% আমেরিকায় উৎপাদিত হয়। ২০২২-এর তুলনায় ২০২৩-এ চিনের উৎপাদন ১৪% বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিরল মৃত্তিকা খনিজের আন্তর্জাতিক রফতানির পরিমাণের ৮৬% চিনের দখলে— তা মোট অর্থমূল্যের ৬৪%— দু’টি হিসাবেই চিন সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তাইল্যান্ড, যদিও চিনের তুলনায় তারা অনেক পিছিয়ে। অন্য দিকে, বিরল মৃত্তিকা খনিজের আমদানির ক্ষেত্রে ৫৭% যায় জাপানে, এবং ২৫% মালয়েশিয়ায়। আন্তর্জাতিক আমদানির মাত্র ০.৭% আসে ভারতে। চিনের মোট রফতানির ৮৫%, ৩.৫% ও ৩.২% যথাক্রমে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকায় পৌঁছয়, যেখানে ভারতে পৌঁছয় মাত্র ১.২%। কিন্তু, ভারতের মোট আমদানির ৮১% আসে চিন থেকে। ২০১৭-এর তুলনায় ২০২৩-এ ভারতের বিরল মৃত্তিকা খনিজের মোট আমদানি বেড়েছে ১০%, আর চিন থেকে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ৮%।

পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রযুক্তিতে বিরল মৃত্তিকা খনিজের গুরুত্ব আর তার সঙ্গে এর কেন্দ্রীভূত বাজার এক অভূতপূর্ব ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন দেশ যত পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রতি নির্ভরশীল হচ্ছে, ততই তাদের বিরল মৃত্তিকা খনিজের ব্যবহার বাড়ছে; আর সেই কারণে তাদের শক্তিনিরাপত্তা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সেঙ্কাকু-ডিয়ায়ু দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কিত বিবাদের কারণে ২০১০-এ চিন জাপানে বিরল মৃত্তিকা খনিজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর ফলে জাপানের বিরল মৃত্তিকা খনিজ আমদানি ৭৭% কমে যায়, দাম বাড়ে চার গুণ। এর ফলে জাপানের বিভিন্ন শিল্প (বিশেষত ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি) বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১২-তে জাপান-সহ কয়েকটি দেশ চিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে, ২০১৪ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সেই অভিযোগ মেনে নেয়। চিন বেশির ভাগ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হলেও এই ঘটনা বিরল-মৃত্তিকা-মৌল সম্পর্কিত শক্তি-নিরাপত্তা বিতর্ককে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে।

এই চিন-নির্ভরতা এড়ানোর তিনটি বিকল্প রাস্তা রয়েছে— এক, বাতিল পণ্য থেকে বিরল মৃত্তিকা খনিজ সংগ্রহ করে তার পুনর্ব্যবহার; দুই, বিকল্প আমদানি সূত্রের সন্ধান; এবং তিন, বিরল মৃত্তিকা খনিজের বিকল্প সন্ধান, বা তার ব্যবহার কমানোর জন্য গবেষণা। তিনটে পথেই সমস্যা রয়েছে। প্রথম পথের মুশকিল, এটি অত্যন্ত সম্পদনির্ভর, বিশেষত শক্তিনির্ভর। দ্বিতীয় বিকল্পটি ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্ভর। এবং, তৃতীয় বিকল্পটি অনিশ্চয়তার কারণে সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।

ভারত নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিরল মৃত্তিকা খনিজের জোগান সুনিশ্চিত রাখতে সব ক’টি বিকল্পই ব্যবহার করছে। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান রেয়ার আর্থ লিমিটেড— বর্তমানে ভারতে বিরল মৃত্তিকা খনিজের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এই সংস্থার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকার ছাড়পত্র পাওয়ায় এই সংস্থা ভারতে দুর্মূল্য খনিজ পদার্থ বিশেষত বিরল মৃত্তিকা মৌলের জোগানে বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে। এ ছাড়াও ২০২৩-এ সংস্থার অধীনে বিশাখাপত্তনমে বিরল মৃত্তিকা খনিজ-নির্মিত চুম্বক শিল্পের একটি কারখানা স্থাপিত হয়। এই কারখানাটি দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতি বছর ৩০০০ কেজি এই বিশেষ ধরনের (সামারিয়াম কোবাল্ট) চুম্বক প্রস্তুত করতে সক্ষম।

এই প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল বিরল মৃত্তিকা খনিজ আমদানি সুনিশ্চিত করতে কাজ়াখস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। মধ্য এশিয়ায় ভারতের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার কাজ়াখস্তান, যেখানে ১৭টি বিরল মৃত্তিকা খনিজের মধ্যে ১৫টিই পাওয়া যায়। এ ছাড়াও তাদের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা ও বেসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা চুক্তি রয়েছে। বিভিন্ন বৃহৎ অর্থনীতির সঙ্গে কাজ়াখস্তানের বিরল মৃত্তিকা খনিজ সরবরাহের চুক্তি রয়েছে, ও সেই চুক্তি অনুযায়ী জোগান দেওয়ার ব্যাপারে দেশটির বিশেষ সুনাম রয়েছে। কাজেই ভৌগোলিক দূরত্ব আর ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিক থেকে চিনের চেয়ে এগিয়ে থাকায় দেশটি ভারতের বিরল মৃত্তিকা খনিজের চাহিদা পূরণে উপযুক্ত বিকল্প হতে পারে। এই ব্যাপারে কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যা থাকলেও ‘ইন্ডিয়া-সেন্ট্রাল এশিয়া রেয়ার আর্থস ফোরাম’-এর সহায়তায় এই সমস্যা সমাধান ও যৌথ উদ্যোগে বিরল মৃত্তিকা নিষ্কাশনের পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে বিরল মৃত্তিকা খনিজের একটি বিকল্প আঞ্চলিক বাজার গড়ে উঠবে, ও পারস্পরিক সুবিধার মাধ্যমে ভারতের পক্ষে চিন-নির্ভরতা ছাড়াই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির পথে চলা সম্ভব হবে।

দি এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Minerals Energy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy