Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Uniform Civil Code

আমি স্ত্রী বা বান্ধবীকে সারা দিনে কত বার চুমু খাব, তারও হিসাব কি এ বার সরকারকে দিতে হবে?

সামনে লোকসভা ভোট। অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে এখন সামনে নিয়ে আসার মধ্যে যে রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে রয়েছে, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ফলে প্রশ্ন ওঠে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কি আমাদের দেশে এ ভাবে কার্যকর করা সম্ভব?

Bengali Actor Ranojoy Bishnu writes on the Uniform Civil Code passed by Uttarakhand Assembly seeking registration for live-in partners dgtls

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

রণজয় বিষ্ণু
রণজয় বিষ্ণু
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৯
Share: Save:

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল দেশে এই প্রথম এল। এটা কি সত্যিই দেশকে ‘অভিন্ন’ করবে? না কি এর মধ্যে বিস্তর রাজনীতি জড়িয়ে? আমি যেটুকু বুঝতে পেরেছি, এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বলতে চায়— সারা দেশে এক আইনের প্রচলন। এবং সেই আইন সকলের জন্য সমান ভাবে কার্যকর হবে। কিন্তু দেশের সর্বত্র তো একই আইন কার্যকর রয়েছে। অপরাধীকে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তান দত্তক নেওয়া, পারিবারিক উত্তরাধিকার— এ রকম কিছু ক্ষেত্রে হয়তো আইন ‘অভিন্ন’ নয়। আফসোস একটাই, দেশের সব কিছুই যদি আইন অনুযায়ী চলত, সমাজে তা হলে হয়তো এত সমস্যা তৈরি হত না।

সম্প্রতি উত্তরাখণ্ড বিধানসভায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল পাশ হয়েছে। যদিও আইন হিসাবে এখনও তা কার্যকর হয়নি। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, এই আইন কারও বিরুদ্ধে নয়। বরং সেখানে সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। কোনও জাতি বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত করবে না এই আইন। সমাজে যাঁরা প্রতি পদে সমস্যার সম্মুখীন হন, এই আইন সেই মহিলাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে। ইতিহাস বলে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সংবিধান তৈরির সময়ে জওহরলাল নেহরু এবং বিআর অম্বেডকর এ রকম আইনের কথাই বলেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ধর্মকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত একটা নতুন দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনা সম্ভব ছিল না। অম্বেডকর বলেছিলেন, দেওয়ানি বিধি কার্যকর হলেও সেটা যাতে ঐচ্ছিক হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে। ফলে নেহরু ‘হিন্দু বিবাহ আইন’কে আরও সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে ‘হিন্দু বিবাহ আইন’ এবং পরের বছর আসে ‘হিন্দু নাবালকত্ব এবং অভিভাবকত্ব আইন’। ওই একই বছরে আসে ‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন’ এবং ‘হিন্দু দত্তক এবং খোরপোশ আইন’। এর ফলে হিন্দু সম্প্রদায়কে অনেকটাই ‘এক বন্ধনী’তে আনা সম্ভব হয়েছিল। আমার মনে হয়, নেহরু এটা করেছিলেন, যাতে পরবর্তী সময়ে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। যাতে তাঁদের ক্ষেত্রেও নতুন অভিন্ন আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়। কিন্তু কোনও কিছুই কারও উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। বিকল্প পথ খোলা ছিল।

সামনেই লোকসভা ভোট। অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে এখন সামনে নিয়ে আসার মধ্যে যে রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে রয়েছে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ফলে প্রশ্ন ওঠে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কি আমাদের দেশে এ ভাবে কার্যকর করা সম্ভব? সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দীপক গুপ্ত বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু আইনের সব কিছুই ভাল আর মুসলমান আইনের সবই খারাপ, এই ধারণা একদমই ঠিক নয়।’’ অর্থাৎ বলতে চাইছি, কোনও কিছু জোর করে কারও উপরে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। দেশ অনেক দিক থেকেই ছোট ছোট পরিসরে ভেঙে রয়েছে। সেখানে নতুন করে আর বিভাজন তৈরির কী অর্থ, সেটাই বুঝতে পারছি না!

Bengali Actor Ranojoy Bishnu writes on the Uniform Civil Code passed by Uttarakhand Assembly seeking registration for live-in partners

অভিনেত্রী সোহিনী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে একত্রবাসে ছিলেন রণজয়। যদিও সেই সম্পর্কে ২০২৩ সালেই ইতি টেনেছেন দু’জনেই। ছবি: সংগৃহীত।

হিন্দু বিবাহ আইনে লেখা আছে, ছেলের বাড়ির গত পাঁচ পুরুষ এবং মেয়ের বাড়ির তিন পুরুষের মধ্যে কোনও বৈবাহিক সম্পর্ক হতে পারে না। অথচ দক্ষিণ ভারতে আমরা দেখি, দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের প্রচলন রয়েছে। একই জিনিস উত্তর ভারতের কোথাও ঘটলে হয়তো রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে! এরও সমাধান কিন্তু ওই হিন্দু বিবাহ আইনেই বলা আছে— কোথাও যদি নিয়মনিষ্ঠা, রীতি মেনে এ রকম বিয়ে হয়, তা হলে তাকে আইনের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। মুসলিমদের ভিতরে শিয়া এবং সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যেও ‘উত্তরাধিকার আইন’-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর হতেই পারে। কিন্তু তার জন্য অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় মানুষের সঙ্গে বৈঠক করে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই যেত। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর মূলত তিনটে বিষয়ে জোর দেয়— সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ, রামমন্দির এবং অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। প্রথম দুটো বিষয়ের ইতিমধ্যেই ‘নিষ্পত্তি’ হয়েছে। লোকসভা ভোটের আগে এ বার তৃতীয় বিষয়টিকে ‘খুঁচিয়ে’ দেওয়া হল।

উত্তরাখণ্ডে পাশ হওয়া বিলে বলা হয়েছে, রাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে ৩ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ, প্রথমেই একটা ‘অন্য খেলা’ শুরুর প্রচেষ্টা। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, নির্দিষ্ট কোনও ধর্ম বা জাতির স্বার্থ এই আইনের মধ্যে লুকিয়ে নেই। প্রশ্ন, বাল্যবিবাহ যদি রাজস্থানের একটি ‘প্রথা’ হয়ে থাকে, সেটাকে কি শুধু ধর্মের নামে রেখে দেওয়া হবে? আরও বলা হয়েছে, অনুমতি না-নিয়ে বিয়ে করা যাবে না। এখানে আবার দেখছি, ‘এলজিবিটিকিউ’কে বাদ রাখা হয়েছে। তা হলে সকলের জন্য কী ভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি? স্পষ্ট নয়।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কিছু ইতিবাচক দিকও উঠে আসছে। যেমন, বিয়ের পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে ‘রেজিস্ট্রেশন’ সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় জরিমানা। এতে বিবাহ সংক্রান্ত জালিয়াতি রোখা অনেকটাই সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয়। অন্য দিকে, একত্রবাস করার সময়ে যদি কোনও সন্তানের জন্ম হয়, তা হলে তার দায়িত্ব নিতে হবে। কোনও জীবন পৃথিবীর আলো দেখার পর তার মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার রয়েছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও স্বামী-স্ত্রীর সমানাধিকারের ভিত্তিতে বিচ্ছেদ হবে। কোনও ইচ্ছাপত্র না-থাকলে সন্তান এবং স্ত্রী সম্পত্তির ভাগ পাবেন, এটাও খুব ভাল দিক।

কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নামে সরকার যদি ‘জ্যাঠামশাই’ হওয়ার চেষ্টা করে বা আমার শোয়ার ঘরে ঢুকে আসে, তা হলে তো মুশকিল! একত্রবাস করতে হলে অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এলেও সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিদের জানাতে হবে! মানে, আমি কারও সঙ্গে সম্পর্কে থাকব কি না সেটাও আমাকে আইন মেনে করতে হবে। আমি একত্রবাস করছি, সেই তথ্য তার মানে নিকটবর্তী থানায় জমা থাকবে। বিষয়টা যেন অনেকটা ‘আমি বিশাল বড় অপরাধ করে ফেলেছি’ গোছের। তাই থানায় আমার নাম নথিভুক্ত করা হল। ২১ বছরের কম বয়স হলে আবার যুগলের বাড়িতে সেটা জানানো হবে। অনুমতি নিতে হবে। অনুমান করা যায়, এর পর পুলিশ আমার সঙ্গে কী কী করতে পারে! এখানে আরও একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায়, এই ধরনের আইন এলে সমস্যায় কিন্তু পড়বে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কারণ, পুলিশের সঙ্গে উচ্চবিত্তের সম্পর্ক অনেকাংশেই অর্থনৈতিক! নিম্নবিত্ত এ সবের থেকে অনেকটাই দূরে।

বিষয়টা তা হলে এ রকম দাঁড়াচ্ছে— ধরা যাক, আমি কারও সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছি। আমি তাঁর সঙ্গে থাকব কি না, সেটা তা হলে সরকারি কর্মী আমাকে ঠিক করে দেবেন! আবার না-জানালে তিন মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে! তার মানে, প্রেম করতে হলে আমাকে কোনও দাদা কিংবা দিদিকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, একটু প্রেম করব? কোনও সমস্যা নেই তো? প্রেমটা এগোলে আমি কি তার সঙ্গে থাকতে পারি? এটা যে কতটা অযৌক্তিক এবং অভব্য, ইতিমধ্যেই তা স্পষ্ট। যে দেশে নারী সুরক্ষা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, যে দেশে শিক্ষা নিয়ে কোনও কথা নেই, সেখানে একত্রবাস নিয়ে কথা হচ্ছে দেখে সত্যিই খারাপ লাগছে। পেটে ভাত না-পড়লে কোনও ধর্ম আমাদের খিদে মেটায় না। নিজেরটা নিজেকেই করে নিতে হয়। আর শিক্ষা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। সেখানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি যে একটা আসন্ন ভোটের ‘নেপথ্য ইস্যু’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এটাই দেখিয়ে দেয় যে, আমরা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছি!

সম্পর্কে থাকতে এবং বেরোতে হলে সরকারকে জানাতে হবে। এর মাধ্যমে কি তা হলে ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকবে? তার মানে কি এটাই বলার চেষ্টা হচ্ছে, দুটো মানুষ এক বার সম্পর্কে থাকলে তাঁদের দমবন্ধ হয়ে গেলেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা? আমার কানে এ রকম কথাও এসেছে যে ‘‘কেন! আগেকার দিনের যুগলেরা কি একসঙ্গে থাকতেন না?’’ চাঁদের পর আজ আমরা মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে গিয়েছি। মুঠোফোনে সারা বিশ্বের খোঁজখবর করি। সেখানে দাঁড়িয়ে আজ এই তুলনা অযৌক্তিক। বিশ্বে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকটা মানুষের ভালবাসা এবং ভাল থাকার অধিকার রয়েছে। কেউ শুধুমাত্র একটা খারাপ সম্পর্ককে দীর্ঘায়িত করবে আদালতের জটিলতা থেকে বাঁচতে, সেটা ভাবা যায় না। আমাদের আগের প্রজন্ম সেটা করেছেন বলে যে আজও সেটাই হবে, তার কোনও কারণ নেই। আমরা হয়তো কোনও দিন খোঁজ নিইনি। কে বলতে পারে যে, আমার ঠাকুমা হয়তো ভাল ছিলেন না। কিন্তু লোকলজ্জার খাতিরে আজীবন সংসার করেছেন!

দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। আমার মনে হয়, জনগণের শোয়ার ঘরে প্রবেশ করার আগে সরকারের উচিত, সেই সমস্যাগুলির সমাধান করা। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্রে সকলের সঙ্গে আলোচনা না-করে কী ভাবে নতুন আইন প্রণয়ন হতে পারে, তা ভেবে অবাক লাগে। গণতন্ত্রে বাঁচতে গিয়ে আবার কি আমরা রাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছি! আমার তো এখনও ভাবলে অবাক লাগে, কোন সময়ে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ রায় ‘হীরক রাজার দেশে’ বানিয়েছিলেন! উনি নিশ্চয়ই হস্তরেখা বিচার করতে পারতেন। বুঝতে পারতেন দেশের ভবিষ্যৎও। আমরা মধ্যবিত্ত। সমীক্ষা বলে, আমাদের সারা বছরের উপার্জনের ৩০ শতাংশ সঞ্চয় হয়, বাকিটা খরচ হয়ে যায়। আয়কর এবং অন্যান্য খরচ— সব বুঝলাম। কিন্তু এর পর আমার স্ত্রী বা বান্ধবীকে সারা দিনে আমি কত বার চুমু খাব, তারও হিসেব সরকারকে দিতে হবে? অদূর ভবিষ্যতে সেই আইনও কি আসতে চলেছে? আর কত দিন যে আমাদের রাষ্ট্রের হাতের পুতুল হয়ে দিন কাটাতে হবে জানি না। কোন অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছি জানি না তা-ও।

(লেখক অভিনেতা। মতামত ব্যক্তিগত।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Uniform Civil Code Bengali Actor Ranojoy Bishnu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE