গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গোড়া থেকেই তাঁর এক নম্বর শত্রু হিসেবে জওহরলাল নেহরুকে চিহ্নিত করেছেন। নেহরু চেয়েছিলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে ধর্মসর্বস্ব সংস্কারাচ্ছন্ন এক জাতিকে আধুনিক করে তুলতে। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি এবং আইআইএম স্থাপন করা ছিল এই প্রচেষ্টারই অঙ্গ। নেহরু যতটা সফল হয়েছেন, ততটাই দুর্গম হয়েছে তাঁর উত্তরসূরি মোদীর চলার পথ। তাই প্রতি মুহূর্তে মোদী আক্রমণ করেছেন নেহরু ও তাঁর জীবন দর্শনকে। মোদীর মতে, নেহরুর প্রধান দোষ হিন্দুদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা এবং পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ। কথায় বলে, শত্রুর শেষ রাখতে নেই। মোদী তাঁর কথা এত বার এত ভাবে বলেছেন যে, আমরা অনেকেই এখন বিশ্বাস করি নেহরু মুসলমান ছিলেন।
দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসে নেহরুর সহকর্মী ও সহযোদ্ধা প্রশান্ত মহলানবিশ নিশ্চয়ই এই সংহার পর্ব উপভোগ করেছেন। বুঝেছেন, আঘাত নামবে তাঁর উপরেও। মহলানবিশ শুধু বরাহনগরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করেননি। সরকারি নীতি এবং তার মূল্যায়ন বিজ্ঞানসম্মত করতে হলে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ পরিসংখ্যান একত্র করা। এবং তাকে কাজে লাগানো। এ জন্য যে পরিকাঠামো দরকার তা তিনি প্রায় একা হাতে তৈরি করে দিয়েছিলেন।
মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঠিক আগে মনমোহন সিংহের তদারকিতে দেশের অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব বৃদ্ধি হয়। বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ছুঁয়ে যায়। মোদী তা ধরে রাখতে অসমর্থ হন। হিন্দুত্ববাদী অর্থনীতিবিদ দেখেন চটজলদি কিছু করতে হলে জিডিপির হিসেবে বদল আনতে হবে। কিন্তু প্রাথমিক বদলে কাজ হয় না। মোদী জমানায় বৃদ্ধির হার বাড়ল বটে কিন্তু মনমোহনের সময়কার বৃদ্ধির হার আরও বেড়ে যায়। তখন এমন দাওয়াই দেওয়া হয় যে, একটা বাড়ে অন্যটা বাড়ে না। ভক্তের হৃদয়ে মোদীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় পরিসংখ্যানের যে সুনাম ছিল, যে ‘প্রেস্টিজ’ ছিল, তা জলাঞ্জলি দিতে হয়।
ফল স্বরূপ দেখা যায়, শুধু জিডিপি নয়, মতের অমিল হচ্ছে অন্যত্রও। প্রথমে ধরা যাক, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ব্যাপারটা। ২০২২ সালে এই সূচক অনুযায়ী ভারতের অবস্থান ছিল ১২৫টি দেশের মধ্যে ১০৭। ২০২৩ সালে তা আরও নেমে দাঁড়ায় ১১১-তে। মোদীর বড় সমালোচকও কথাটা বিশ্বাস করার আগে দু’বার ভাববেন। দেশের মানুষ এত ক্ষুধার্ত অথচ রাস্তাঘাট, রেলের স্টেশনে ভিখারি দেখা যায় না? অসম্ভব। কিন্তু সরকারি ভাবে কী বলা হল? স্বীকার করা হল যে, বয়সের তুলনায় দেশের ছেলেমেয়েদের উচ্চতা এবং ওজন দুইই কম। কিন্তু বলা হল, তা ক্ষুধার পরিমাপ হতে পারে না। কিন্তু কম কেন, তার ব্যাখ্যা তো দরকার! কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না।
আমরা ভাল ভাবেই জানি, দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ছে। তার মানে এই নয় যে, গরিব মানুষের পাতে খাবারের পরিমাণ বাড়ছে। চাকরির জন্য হাহাকার কেন কমছে না? ১০০ দিনের কাজের চাহিদা বাড়ছে কেন? আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা কমছে না কেন? বোঝাই যায় যে, এই জটিল পরিস্থিতিতে সরকার যা বলবে তার পিছনে যুক্তি এবং তথ্য থাকতে হবে। সে পথে না গিয়ে সরকার একটাই যুক্তি খাড়া করেছে যা সব পরিস্থিতিতেই কাজে লাগছে। মোদীর নেতৃত্বে হিন্দুদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে বিশ্ব শঙ্কিত এবং ঈর্ষান্বিত। সব সমালোচনাই এই ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ।
দ্বিতীয়ত, দেখা যেতে পারে ভারতে অতিমারিতে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র সঙ্গে মতবিরোধ। ভারত সরকারের মতে, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ৫ লক্ষ লোকের। হু-র হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ লক্ষ। এই আলোচনায় আমরা এই দুই সংখ্যার মধ্যে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সে প্রশ্নে যাচ্ছি না। আমাদের উৎকণ্ঠার কারণ এই যে, চার বছর অতিক্রান্ত কিন্তু হু এখনও আমাদের হিসাব মেনে নেয়নি। মহলানবিশ থাকলে নিশ্চয়ই তাঁরা বলতেন, ‘‘প্রভু আমাদের ভুলটা ধরিয়ে দিন!’’
বাজেট বক্তৃতার পরে এক সাংবাদিক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বললেন, সরকারি পরিসংখ্যান যাতে নিখুঁত এবং গ্রহণযোগ্য হয় তার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী যদি স্বীকার করেন, সরকারি পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্য নয়, তা হলে আর বাকি থাকে কী! অন্য সূত্র থেকে আমরা এ-ও জানি যে, এই বিশেষ কমিটি এখনও কাজ শুরু করেনি। কমিটির চেয়ারম্যান এ কথাও বলেছেন যে, ২০২১-এর জনগণনা শেষ না-হলে কোনও নমুনা সমীক্ষায় সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না। কারণ, সমীক্ষার জন্য যে ফ্রেম দরকার তা আসে জনগণনা থেকে। যত দিন না ২০২১-এর জনগণনা শেষ হচ্ছে, তত দিন ২০১১ সালের ‘ফ্রেম’ ব্যবহার করতে হবে এবং অবশ্যই ভুলের পরিমাণ বাড়বে।
জনগণনার কাজ মুলতুবি করা আছে কেন? পঞ্জিকায় শুভ মুহূর্ত পাওয়া যাচ্ছে না? তা নয়। কুম্ভমেলার মতো জনগণনা প্রতি ১২ বছরে হলে বুঝতাম তা শাস্ত্রসম্মত। তা যখন নয়, তখন দিনক্ষণ না দেখলেও চলে। শুধু জনগণনা নয়, অনেক সমীক্ষার ফল অপ্রকাশিত। সরকার প্রতি পাঁচ বছরে এক বার সমীক্ষা করে দেখে, উপভোক্তাদের মোট ব্যয় কতটা বাড়ল। এই গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষার ইংরেজি নাম ‘কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভে’। ২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়নি। কারণ, তা জিডিপি বৃদ্ধির সরকারি হিসাবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। সংবাদে প্রকাশ, এমন ১৭টি সমীক্ষার ফল চেপে দেওয়া হয়েছে।
জনগণনাতেও এমন তথ্য থাকতে পারে যা নির্বাচনের আগে প্রকাশ না করাই ভাল। শতকরা ক’টি বাড়িতে টয়লেট আছে? তার মধ্যে ক’টি নিয়মিত ব্যবহার হয়? যাঁদের বিনামূল্যে গ্যাসের উনুন দেওয়া হয়েছে তাঁরা কি রান্নায় এখনও কাঠখড় পোড়ান?
আরও বড় সমস্যা সংরক্ষণ নিয়ে। যে সব সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বেড়েছে, তারা বাড়তি সুবিধার দাবি তুলবে। এই জট কবে খুলবে বলা কঠিন। হিন্দুত্ববাদীদের মতে, দেশের এক প্রধান সমস্যা হল মুসলিমদের সংখ্যা। এই সংখ্যা অচিরেই হিন্দুদের পিছনে ফেলে যাবে। এই অনুমানের ভিত্তি হল মুসলমানের চারটে বিয়ে। জনগণনা কি এই অনুমান সমর্থন করবে? জনগণনা পিছিয়ে দেওয়ার এ-ও কি একটা কারণ?
২০১১ সালের জনগণনায় একটা বড় পরিবর্তন আনা হয়। ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিবাহের সংখ্যা যে হেতু বেড়েছে, পরিবারের সব সদস্যকে প্রশ্ন করা হয় তার ধর্ম কী? ধরে নেওয়া হয় না যে, পরিবারের কর্তার ধর্মই সবার ধর্ম। এই উদারতা কি পরবর্তী জনগণনায় বজায় থাকবে? যদি থাকে, তা হলে আর একটা প্রশ্ন অসঙ্গত হবে না। বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক’জন বিয়ে করেছে? দেশ আধুনিক হয়েছে কি না সে প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে এই তথ্য জরুরি।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy