E-Paper

আগে ভালবাসা, পরে অস্মিতা

কলকাতা পুরসভা আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শহরে সব বিপণির নাম বাংলা হরফে লেখার নির্দেশিকা জারি করেছে। কিন্তু সমস্যা হল, বাংলা হরফই বাংলা ভাষার সব নয়।

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:২৪

সে  দিন এক হিন্দিভাষী মুড়ি-বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো বহু বছর পশ্চিমবঙ্গে আছেন, বাঙালি পাড়ায় ব্যবসা, অথচ বাংলা বলতে পারেন না কেন? উত্তরে ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, “মওকা নেহি মিলতা বাবু, সব লোগ তো হিন্দি হি বোলতে হ্যায়।”

ভারতের নানা প্রদেশে পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিকদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে ধরপাকড়, অত্যাচার ও সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে চালান করে দেওয়ার প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে যে অস্মিতা-তাড়িত প্রতিবাদ, সেই আবহে কথাটা মনে পড়ল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু মানুষ কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে যান, এই ধারা নতুন নয়। গত কয়েক মাস ধরে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া মানুষদের মধ্যে বেছে বেছে বাংলাভাষীদের হেনস্থা ও নিগ্রহের যে ঘটনা ঘটে চলেছে, তা বাঙালির পক্ষে রীতিমতো অপমানের, আতঙ্কেরও। এ কথা অস্বীকারেরও উপায় নেই, অন্যান্য রাজ্য-সহ পশ্চিমবঙ্গেও ইতিমধ্যে কিছু বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর সন্ধান মিলেছে। কিন্তু সেই অজুহাতে এ রাজ্য থেকে অন্যত্র কাজ করতে যাওয়া বৈধ নাগরিকেরা কেন পীড়নের শিকার হবেন? সম্প্রতি দিল্লি পুলিশের বয়ানে ‘বাংলাদেশি ভাষা’র উল্লেখে বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাদের যে অজ্ঞতা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে, তার প্রতিবাদ নিশ্চয়ই জরুরি।

কলকাতা পুরসভা আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শহরে সব বিপণির নাম বাংলা হরফে লেখার নির্দেশিকা জারি করেছে। কিন্তু সমস্যা হল, বাংলা হরফই বাংলা ভাষার সব নয়। কলকাতার ব্যবসায়ীদের সিংহভাগ— অপ্রিয় হলেও সত্য— অবাঙালি। তাঁদের বেশির ভাগই কথা বলেন মূলত হিন্দিতে, এমনকি বাঙালি ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গেও। তাঁদের সন্তানেরা মাতৃভাষা বা ইংরেজিতে পড়াশোনা করে, বাংলা শেখার ধার ধারে না। আপাতভাবে এতে কোনও অন্যায় নেই। বরং জোর করে এদের বাংলা লিখতে পড়তে, বাংলা ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করলে বাংলা ভাষা তথা বাঙালি অস্মিতার কতটা শ্রী-সম্মান বাড়বে তা বলা শক্ত। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিবিধের মাঝে মহান মিলনের দর্শনটিরও যে অপমৃত্যু ঘটবে, সন্দেহ নেই।

ভাষা বা জাতিসত্তার অস্মিতার উপরে আক্রমণ প্রতিহত করা অবশ্যকর্তব্য নিশ্চয়ই। তবে একই সঙ্গে সেই জাতি মাতৃভাষার চর্চা ও বিকাশ নিয়ে কতটা আন্তরিক, সেই প্রশ্নও অবান্তর নয়। এ কালে বহু শিক্ষিত বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা অপাঙ্‌ক্তেয়। তাঁরা ইংরেজি পারঙ্গমতায় যে শ্লাঘা বোধ করেন, নির্ভুল ভাবে বাংলা বলতে বা পড়তে না পারার জন্য তার ছিটেফোঁটা লজ্জাও পান না। তাঁদের বিশ্বাস, বাংলা ভাবের ভাষা হলেও কাজের ভাষা নয়। এই ধারণা পুরো অমূলকও নয়। আজও এ রাজ্যে বেশির ভাগ সরকারি দফতরে ইংরেজিতেই কাজকর্ম চলে, উচ্চশিক্ষাও অনেকাংশে ইংরেজি-নির্ভর, রাজ্যের বাইরে শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে বাংলা ভাষার কানাকড়ি কাজে আসে না। ফলে বাঙালির একটা অংশ মাতৃভাষাকে প্রায় বর্জন করেছেন।

তবু এ রাজ্যের সিংহভাগ বাঙালি আজও বাংলায় কথা বলেন, সন্তানকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়তে পাঠান। দরিদ্র, প্রান্তিক হলেও এঁরাই বাংলা ভাষা তথা বাঙালি অস্মিতার প্রকৃত ধারক। তাই ভাষা ও অস্মিতা রক্ষার স্বার্থে বনিয়াদি শিক্ষায় মাতৃভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। শৈশব থেকে মাতৃভাষার প্রতি পড়ুয়াদের আগ্রহী করে তুলতে প্রয়োজনে পাঠ্য বিষয় ও ভাষা সংস্কারের কথা বিবেচনা করা চাই। এ রাজ্যেই অঞ্চলভেদে প্রমিত বাংলা থেকে পৃথক নানা উপভাষা প্রচলিত, সেখানে শিশুপাঠ্যে সেগুলি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শিশুরা বইয়ের পাঠে যাতে নিজেদের পরিচিত পরিমণ্ডলের মিল খুঁজে পায়, পাঠ নির্বাচনে তা লক্ষ রাখা দরকার। শহর ও গ্রামের শিশুর রোজকার দেখা পরিবেশে ফারাক আছে, শিশুমনে আগ্রহ সৃষ্টির জন্যে অঞ্চলভেদে পাঠ্য বিষয়েও ভিন্নতা আনার কথা বিবেচনা করা জরুরি।

কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলে পড়ুয়াদের ফেরানো ও বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নয়ন। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে স্কুলগুলোর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন যেমন আছে, তেমনই শিক্ষান্তে নিজের রাজ্যেই যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানও জরুরি, ভুললে চলবে না। অন্তত স্নাতক স্তর পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা যাতে মাতৃভাষায় পড়াশোনা করতে পারে, সে জন্য বাংলায় উন্নত মানের পাঠ্যপুস্তক রচনা ও তা সহজলভ্য করে তোলা দরকার। অন্য ভাষায় লিখিত বিষয়ের ভাষান্তর, সহজ বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টিও প্রয়োজন। এটা যে সম্ভব, কিছুটা হলেও তা করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

সরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ ও রাজ্যে অধিকতর কর্মসংস্থান তৈরি না করতে পারলে শিক্ষায় অনাগ্রহ প্রায় অনিবার্য। তাই বাংলা ভাষা ও বাঙালি অস্মিতাকে রক্ষা করতে হলে মাতৃভাষাকে অন্তর থেকে ভালবাসতে হবে, তার চর্চা করতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা শেখায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নয়তো ভিন রাজ্যে বাঙালির উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে, বাংলা ভাষার গরিমা এবং বাঙালি অস্মিতা রক্ষার প্রশ্নে এই ‘আন্দোলন’ শেষে হয়ে দাঁড়াবে নিতান্তই অন্তঃসারশূন্য, অর্থহীন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Mother Tongue

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy