বাঙালি জুলাই মাসকে মনে রাখে পয়লা আর চব্বিশ তারিখের জন্য— প্রথমটি ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম ও প্রয়াণ দিবস; দ্বিতীয়টি মহানায়ক উত্তমকুমারের প্রয়াণ দিবস। ২৩৮ বছর আগে জুলাই মাসেই জন্মেছিলেন একদা তুমুল আলোচিত আর এক বাঙালি। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
একদা রাজা রামমোহন রায়ের অতি-রক্ষণশীল প্রতিস্পর্ধী হিসাবে তুমুল নিন্দিত। বঙ্কিম বা প্যারীচরণের আগে কলিকাতা কমলালয় বা বাবু-বিবিদের বিলাস বৃত্তান্ত লিখতে বসে প্রায় নভেল লিখে ফেলা ব্যক্তিত্ব। পৈতৃক সূত্রে কলুটোলা অঞ্চলের বাসিন্দা মানুষটির বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয়েছিল শৈশবেই। বিদেশি ভাষায় দখল-যোগ্যতায় চাকরি জুটিয়ে নিতে পেরেছিলেন বিভিন্ন ইউরোপীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে, ইউরোপীয়দের অধীনে। সম্বাদ কৌমুদী প্রকাশের সময় তাঁকেই সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। কিন্তু সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রক্ষণশীল ভবানীচরণের পক্ষে সম্ভব হয়নি বছর খানেকের বেশি রামমোহনের সংসর্গ সহ্য করা। ১৮২১-এর ৪ ডিসেম্বর সূচনা হয়েছিল সম্বাদ কৌমুদী-র। ১৮২২-এ শুরু হয়েছিল ভবানীচরণ প্রতিষ্ঠিত সমাচার চন্দ্রিকা-র পথ চলা। রক্ষণশীল বর্গের উগ্র মুখপত্র। একটি কাগজ সতীদাহ প্রথার অবসান চেয়েছিল। আর একটি পত্রিকা ছিল সেই জঘন্য প্রথার সমর্থক।
১৮৩০ সালে রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ‘ধর্মসভা’ গঠিত হলে ভবানীচরণ নিযুক্ত হয়েছিলেন সম্পাদক। প্রবল বিরোধী ছিলেন নারী-শিক্ষা প্রবর্তনের, বালিকাদের বিদ্যালয়ে প্রেরণের। সমাচার চন্দ্রিকা-র পাতায় ভবানীচরণ বিদ্যালয়ে বালিকা প্রেরণের বিরুদ্ধতা করে লিখেছিলেন, কয়েক জন হিন্দু স্বজাতীয় রীতিনীতি পরিবর্তনের জন্যেই মেয়েদের ইস্কুলে পাঠাতে চাইছেন। ইস্কুল প্রতিষ্ঠা, নারীশিক্ষা আসলে দেশের মেয়েদের খ্রিস্টান বানাবার জন্যে মিশনারিদের ছল!
পাল্টা যুক্তি উঠেছিল— বিদ্যালয়ে মেয়েদের পাঠালে স্বজাতীয় রীতিনীতির বিরোধিতা হয় না। কারণ শাস্ত্রে মেয়েদের শিক্ষার বিরোধিতা নয়, উৎসাহদানের কথাও আছে। মহানির্বাণতন্ত্র মতে ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতি যত্নতঃ।’ কিন্তু এ-সব যুক্তিতে দমবার পাত্র ছিলেন না ভবানীচরণ। শাস্ত্রবিচার ছেড়ে অতঃপর নেমে এসেছিলেন মোকাম কলিকাতার রাজপথে। স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ককে খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বলে ঘোষণা করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, বিদ্যালয়ের পথে মেয়েরা কামার্ত পাপাত্মা পুরুষের দৃষ্টিগোচর হলে তাদের উপরে বলাৎকারের সম্ভাবনা তো প্রবল। তার কী প্রতিবিধান? কী হবে সেই ধর্ষিত কন্যাটির ভবিষ্যৎ? কী মরিয়া চেষ্টা কন্যাদের বিদ্যালয়ে প্রেরণোদ্যত পিতৃকুলকে নিরস্ত করার! মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে ধর্ষিতা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করার চেয়ে কি শ্রেয় নয় বিদ্যালয়ে না পাঠানো?
ভবানীচরণের ফতোয়া টেকেনি ঊনবিংশ শতাব্দীর স্বদেশে। ঘর থেকে বাইরে বেরোনো মেয়েটির নিরাপত্তা নিয়ে নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক উৎকণ্ঠা অভিভাবককুলের ছিল। তার একশো বছরের অধিক সময় পরেও, বিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের সমভিব্যাহারে ছাত্রীকুলের শ্রেণিকক্ষে আগমন এবং একই রীতিতে ক্লাস শেষে নির্গমন ও গার্লস কমনরুমে পুনরায় অবস্থান অমর হয়ে আছে বাংলা কথাসাহিত্যের সৌজন্যে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুবাদে সন্তান ধর্ষিত হতে পারে— ভবানীচরণদের দেখানো এই শঙ্কায় আত্মজাকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ থেকে বিরত থাকার মানসিকতা সব সহনাগরিকের মধ্যে দেখা যায়নি বলেই শিক্ষা প্রাঙ্গণে মেয়েদের উপস্থিতি বেড়েছে ক্রমশ।
সমসময়ে ভবানীচরণের আশঙ্কাকে ধিক্কার দিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত-র মতো স্বীকৃত ‘নারীবিদ্বেষী’ও লিখেছিলেন, বিদ্যালয়গামী মেয়েদের দেখলে যেখানে হৃদয়ে স্নেহ, দয়া আর বাৎসল্য ভাবের উদয় হওয়ার কথা, সেখানে ‘পৃথিবীতে এমন কোন পাপাত্মা পুরুষ আছে যে তাহাদের দেখিয়া মদনানলে প্রজ্বলিত হইয়া বলের দ্বারা কৌমার হরণে উদ্যত হইবেক, তিনি কি ভাবের প্রভাবে এরূপ অদ্ভুত ভাব ব্যক্ত করিলেন তাহা ভাবনা করাই যে এক প্রকার নূতন ভাবনার ব্যাপার হইল।’
আজ বেঁচে থাকলে ঈশ্বর গুপ্তর মুখের উপরে ‘হা-হা’ করে হেসে ওঠার সুযোগ পেয়ে যেতেন ভবানীচরণ। দেখিয়ে দিতে পারতেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কারণে ধর্ষিত হওয়ার বিষয়টা আর ‘নূতন ভাবনার ব্যাপার’ নেই। সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজ-এর প্রবাদপ্রতিম ছাত্র, ছাত্রনেতা, সদ্য বহিষ্কৃত কলেজ-কর্মচারী তথা কলেজ-অভ্যন্তরেধর্ষণের অভিযোগে ধৃত মনোজিৎ মিশ্র-র মতো মানুষদের সূত্রে। আদতে পরাজিত মুষ্টিযোদ্ধার হাত অন্যায় ভাবে তুলে ধরে জিতিয়ে দেওয়া রেফারির মতোই মনোজিৎ ও তার দলবল যেন মৃত্যুর ১৭৭ বছর পর উইন উইন সিচুয়েশনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল একদা প্রবল নিন্দিত, সমালোচিত, ধিক্কৃত ভবানীচরণকে। বোঝাল, ঊনবিংশ শতকে দেখানো ভবানীচরণের জুজু আজকের একবিংশ শতকেও কতখানি জ্যান্ত।
বাংলা বিভাগ, শ্রীগোপাল ব্যানার্জী কলেজ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)