E-Paper

কর্মে সিংহী, হৃদয়ে প্রেমসুধা

মার্গারেট স্বামীজির কাছ থেকে পেলেন ভারতের সভ্যতা-সংস্কৃতির পাঠ। ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হয়ে তাঁর নাম হল ‘নিবেদিতা’। আগেই শ্রীমা সারদাদেবীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, তাঁকে নিজ কন্যারূপে গ্রহণ করে ‘খুকি’ ডাকতেন তিনি।

রমাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:২২
আজ ভগিনী নিবেদিতার ১৫৯তম জন্মদিন।

আজ ভগিনী নিবেদিতার ১৫৯তম জন্মদিন।

১৮৯৫ সালের ১০ নভেম্বর, লন্ডনে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা ইসাবেল মার্গাসেন-এর বাড়িতে ঘরোয়া সভায় আমন্ত্রিত অতিথি ও বক্তা স্বামী বিবেকানন্দ। ইতিমধ্যেই ভারতের বেদান্ত দর্শন প্রচারে আমেরিকার বিদ্বৎসমাজে বিস্ময় জাগিয়ে তিনি লন্ডন এসেছেন, প্রথম বার। ইসাবেলের বান্ধবী মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবল সভায় উপস্থিত। লন্ডনের শিক্ষিত মহলে বিশিষ্ট স্থান তাঁরও। শিক্ষকতা, সঙ্গে পত্রপত্রিকায় নারীর অধিকার, কয়লাখনির শ্রমিকদের দুরবস্থা ইত্যাদি নিয়ে প্রবন্ধ লিখছেন। ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর মার্গারেট প্রথাগত খ্রিস্টান চার্চে খুঁজে পাচ্ছিলেন না, এই ‘হিন্দু যোগী’র বাক ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে আকর্ষণ করে। যেন এক মহান আদর্শের খোঁজ। স্বামীজির সঙ্গে পত্রবিনিময় চলতে থাকে তাঁর, ভারতে এসে কাজ করার আগ্রহ জাগে।

স্বামীজি অবশ্য ভারতের দারিদ্র, কুসংস্কার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ইত্যাদির কথা জানিয়ে তাঁকে সতর্ক করে লেখেন, “এ সব সত্ত্বেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস করো, তবে অবশ্য তোমাকে শতবার স্বাগত জানাচ্ছি।” ১৮৯৮-এর ২৮ জানুয়ারি মার্গারেট কলকাতায় এলেন, খিদিরপুর জাহাজঘাটায় স্বামীজি তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। এর আগে চিঠিতে লিখেছিলেন মার্গারেটের মধ্যে ‘জগৎ আলোড়নকারী শক্তি’র, কথা, ভারতের কাজে তাঁর এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে, সে কথাও। “ভারতের জন্য, বিশেষত ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর— একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন।” মার্গারেটের শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, অসীম ভালবাসা, দৃঢ়তার জন্য ভারতের কাজে তাঁকে সর্বোত্তম বিবেচনা করেছিলেন স্বামীজি।

মার্গারেট স্বামীজির কাছ থেকে পেলেন ভারতের সভ্যতা-সংস্কৃতির পাঠ। ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হয়ে তাঁর নাম হল ‘নিবেদিতা’। আগেই শ্রীমা সারদাদেবীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, তাঁকে নিজ কন্যারূপে গ্রহণ করে ‘খুকি’ ডাকতেন তিনি। ১৮৯৮-এর ১৩ নভেম্বর ছোট্ট এক বাড়িতে স্থাপিত হল নিবেদিতার বিদ্যালয়, সম্পূর্ণ ভারতীয় রীতিতে নারীশিক্ষার ঐতিহাসিক সূচনা হল সেখানে। নিবেদিতা ইতিমধ্যেই হয়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়। ভারতীয়দের তিনি বলতেন ‘আওয়ার পিপল’, ভারতকে নিজের দেশ; ইংল্যান্ডকে বলতেন ‘ও দেশ’।

নিবেদিতার তেজস্বিতা বহু ঘটনায় উদ্ভাসিত। ১৯০৩ সালে মেদিনীপুরে ভাষণ দিতে এলে স্টেশনে সমবেত মানুষ ‘হিপ হিপ হুররে’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে, নিবেদিতা তাদের থামিয়ে বলেন, ও সব ইংরেজ জাতির বিজয়োল্লাস ধ্বনি, ভারতীয়দের তা ব্যবহার করা উচিত নয়। তিন বার তিনি ‘ওয়াহ গুরুজি কি ফতেহ’, ‘বোল বাবুজি কি খালসা’ উচ্চারণ করে সকলকেও তা উচ্চারণ করান। ১৯০২-এর অক্টোবরে নাগপুরে মরিস কলেজে তাঁকে দিয়ে ছাত্র ক্রিকেটারদের পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ভাষণে বলেন, সময়টি যখন দেবী দুর্গার আরাধনার মাধ্যমে শক্তিকে আহ্বানের, তখন এক বিদেশি খেলা ঘিরে মাতামাতি করা ঠিক হয়নি। তাঁর আশা ছিল ভোঁসলে রাজার রাজধানীতে প্রকৃত মরাঠা বীরত্বের নিদর্শন তিনি দেখতে পাবেন। নিবেদিতার ভাষণে উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা পরদিন মল্লযুদ্ধ, তরবারি খেলা ইত্যাদি প্রদর্শন করে। ১৯০৫-এর ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে লর্ড কার্জ়ন প্রাচ্যবাসীর সত্যবাদিতা নিয়ে কটাক্ষ করেন, এই মিথ্যা অভিযোগ নিবেদিতাকে ক্রুদ্ধ করে। সভা শেষে স্যর গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে গিয়ে প্রবলেমস অব দ্য ফার ইস্ট গ্রন্থে কার্জ়নের মিথ্যা উক্তি খুঁজে বার করে, ১৩ ফেব্রুয়ারি কাগজে সেই তথ্য ছাপিয়ে তিনি কার্জ়নের মিথ্যাচার প্রমাণ করেন। মহাভারত রামায়ণ পুরাণ উদ্ধৃত করে নিবেদিতা দেখিয়েছিলেন, ভারতে সত্যের ধারণার স্থান কত উচ্চে।

স্বামীজি নিবেদিতাকে লিখেছিলেন, ভবিষ্যৎ ভারতসন্তানদের কাছে তিনি যেন একাধারে জননী, সেবিকা ও বন্ধু হয়ে ওঠেন। হৃদয়ের অফুরান প্রেমসুধা দিয়ে তিনি স্বামীজির কথা সার্থক করে তুলেছিলেন। ১৮৯৯-এ কলকাতায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব হলে রোগ নিবারণে নিঃসঙ্কোচে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসক আর জি করের বর্ণনায় আছে, কী ভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাতৃহারা মৃত্যুমুখী এক শিশুকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন নিবেদিতা— মৃত্যুর আগে শিশুটি তাঁকেই ‘মা, মা’ বলে জড়িয়ে ধরে। স্কুলের মেয়েরা তাঁর কাছে মাতৃস্নেহ পেত। হিন্দু সমাজের রীতিনীতি মেনেই তিনি ছাত্রীদের শিক্ষা দিতেন, স্বাবলম্বী ও সাহসী হয়ে ওঠার পথ দেখাতেন। শ্রীমা সারদাদেবীর কাছে গিয়ে তাঁর একটু সেবা করার জন্য ব্যস্ত হতেন— তা সেটা মায়ের জন্য মাদুর পেতে দেওয়া হোক বা লন্ঠনের কাচ কাগজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া, যাতে মায়ের চোখে আলো পড়ে অসুবিধা না হয়। জীবজন্তুর প্রতিও ছিল দরদ, তাঁর কাছে আগত কারও ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়াগুলির প্রতিও তাঁর ভালবাসার প্রকাশ দেখেছেন কাছের মানুষেরা। সরলাবালা সরকারের নিবেদিতাকে যেমন দেখিয়াছি (১৯১৪) গ্রন্থে নিবেদিতার জীবনের বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ জানা যায়। তিনি লিখেছেন, নিবেদিতার মধ্যে ছিল এক যোদ্ধৃর মনোভাব, অন্য দিকে হৃদয় ছিল ভালবাসায় পূর্ণ।

ভারতের বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল খুব। ভারতের ধর্ম ঐতিহ্য সংস্কৃতি নিয়ে সিংহবিক্রমে পুনর্জাগরণ— এই ছিল তাঁর স্বপ্ন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bhagini Nivedita Swami Vivekanda Sarada Devi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy