E-Paper

পুরনো খেলা, নতুন নিয়ম?

ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতি বরাবরই আলাদা। এই রাজ্যে ধর্ম, জাতপাতের ভিত্তিতে মেরুকরণ হয় না।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৫ ০৬:১২
Share
Save

তিনি প্রথমে রাজ্যে কোনও সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনে যাবেন। সঙ্গে জনসভা থাকবে। তার পর প্রতি মাসে অন্তত এক বার, কখনও দু’বার করেও সেই রাজ্যে যাবেন। কোনও না কোনও সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন বা শিলান্যাস। সেই সঙ্গে জনসভা। এ রকম চলতেই থাকবে। যত দিন না ভোট ঘোষণা হয়। ভোট ঘোষণা হলে সরাসরি নির্বাচনী প্রচারে যাবেন।

যে কোনও রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটাই নরেন্দ্র মোদীর ‘ক্লাসিক প্লেবুক’। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের দশ মাস মতো বাকি। নরেন্দ্র মোদী গত ২৯ মে আলিপুরদুয়ারের প্রায় হাজার কোটি টাকার শহর গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প উদ্বোধনের পরে জনসভা করে এসেছেন। ধরে নেওয়া যায়, আগামী বছর এপ্রিলে বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এখন থেকে প্রায় প্রতি মাসেই অন্তত এক বার করে রাজ্যে যাবেন।

প্রধানমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে এই প্রচারযজ্ঞের শুরুতে যে ইঙ্গিত মিলেছে, তাতে স্পষ্ট, তৃণমূলের জমানায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের তোষণ ও মুর্শিদাবাদের হিংসার উদাহরণ সামনে রেখে হিন্দুদের উপর আক্রমণের অভিযোগ বিজেপির প্রধান হাতিয়ার হবে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটকে বিজেপি শুধু তৃণমূলকে সরিয়ে নবান্ন দখলের লড়াই বলে তকমা দিচ্ছে না। একে হিন্দুদের জীবন, জীবিকা ও সম্মান রক্ষার লড়াই হিসেবেও তুলে ধরতে চাইছে।

নরেন্দ্র মোদীর উত্তরবঙ্গ সফরের তিন দিন পরেই অমিত শাহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। বিজেপির প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তির উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ সফর থেকে মোটামুটি স্পষ্ট, ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের জন্য তাঁরা মূলত পাঁচটি হাতিয়ার বেছে নিয়েছেন। এক, সংখ্যালঘু তোষণ ও হিন্দুদের উপর আক্রমণ। দুই, দুর্নীতি। তিন, বেকারত্ব। চার, গরিবের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। পাঁচ, মহিলাদের উপর অত্যাচার ও নিরাপত্তার অভাব। বলা বাহুল্য, প্রথম হাতিয়ারই বিজেপির সব থেকে বড় অস্ত্র হতে চলেছে।

ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতি বরাবরই আলাদা। এই রাজ্যে ধর্ম, জাতপাতের ভিত্তিতে মেরুকরণ হয় না। মেরুকরণ হয় রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। উত্তর ভারতের মতো পশ্চিমবঙ্গে ব্রাহ্মণ প্রার্থী খাড়া করলে তিনি সিংহভাগ ব্রাহ্মণদের ভোট পাবেন, ওবিসি প্রার্থীর দিকে ওবিসিরা ঝুঁকে থাকবেন, এমন নয়। বাংলায় হিন্দু প্রার্থী মুসলিম-বহুল এলাকা থেকে জিতে আসেন। দলিত বা অনগ্রসর এলাকা থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতার ভোটে জিততে অসুবিধা হয় না। কে কোন পার্টি করেন, কে কোন দলের সমর্থক, মূলত তার ভিত্তিতে ভোটের সময় সামাজিক বিভাজন হয়। শুধু জাত বা ধর্ম দেখে কে কাকে ভোট দেবেন, তা বোঝা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের ভোটে জিততে হলে তাই সংগঠন ও ক্যাডার বাহিনী প্রয়োজন। পার্টির অনুগত আঞ্চলিক নেতা প্রয়োজন। সিপিএমের পরে তৃণমূল এই সংগঠন, ক্যাডার বাহিনী ও আঞ্চলিক নেতাদের জোরেই টেক্কা দিচ্ছে।

বিজেপি এই খেলার নিয়ম বদলে দিতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গের চিরাচরিত রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে ভোটের অঙ্কের বদলে ধর্মের ভিত্তিতে ভোটের অঙ্ক কষছে। বিজেপি ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে ভোট করাতে চায়। মুসলিম ভোট যে এককাট্টা হয়ে তৃণমূলের ঝুলিতে পড়বে, তা বিজেপি ধরে নিচ্ছে। তার মানে এই নয়, পুরো হিন্দু ভোট বিজেপির ঝুলিতে পড়ছে। গত লোকসভায় তৃণমূল ৪৩ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল। বিজেপির পেয়েছিল ৪০ শতাংশের মতো। বিজেপির অঙ্ক, যদি হিন্দু ভোটের আরও ৪ শতাংশ মতো গেরুয়া বাক্সে পড়ে, তা হলেই কেল্লা ফতে। সেই কারণেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ভোটকে হিন্দুদের জীবন, জীবিকা, সম্মান রক্ষার লড়াই হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। এতে কোনও ভুল নেই, ‘তৃণমূলের জমানায় মুসলিমদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে’ বলে একটা ধারণা বিজেপি রাজ্যের বহু মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। তাঁরা রাজ্যের যে কোনও সমস্যার জন্য মুসলিমদের দায়ী করেন। এটা বিজেপির সাফল্য। তৃণমূলের মুসলিম তোষণ নিয়ে ক্ষোভ আরও উস্কে দিতেই অমিত শাহ অভিযোগ তুলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম তোষণের জন্য অপারেশন সিঁদুর-এর বিরোধিতা করছেন। সিঁদুরের মতো হিন্দু ঐতিহ্যের অপমান করছেন।

বিজেপির চ্যালেঞ্জ হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতির দাবায় পাল্টা চাল দিতে রাহুল গান্ধীদের মতো দেরি করেন না। প্রতিপক্ষ বাউন্সার ছুড়লে তিনি সহজাত ভাবেই হুক করার ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। বিজেপি যে অপারেশন সিঁদুর নিয়ে হিন্দুত্বের রাজনীতি করবে, তা মমতার জানাই ছিল। তিনি খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাকিস্তানের সন্ত্রাস নিয়ে সরব হতে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দলে পাঠিয়েছেন। অভিষেক পাক সন্ত্রাস ও তার মোকাবিলায় অপারেশন সিঁদুরের পক্ষে সওয়ালে বিজেপির নেতাদের পিছনে ফেলে দিয়েছেন। ফলে মমতা অপারেশন সিঁদুরের বিরোধিতা করছেন, এই অভিযোগ ধোপে টেকা মুশকিল।

বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের মোকাবিলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার্যত সরকারি খরচে জগন্নাথ মন্দির তৈরি করিয়েছেন। মমতা বিলক্ষণ জানেন, প্রতি বছর নিয়ম করে পুরী বেড়াতে যাওয়া আম বাঙালির কাছে জগন্নাথকে নিয়ে আবেগ অযোধ্যার রামের থেকে অনেক বেশি। আর সেই মন্দির দিঘায় হলে, সরকারি খরচে মন্দির নির্মাণ সংবিধান সম্মত কি না, ও নিয়ে বাঙালি মাথা ঘামাবে না। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে জগন্নাথ মন্দির তৈরি করিয়ে মমতা বিজেপির হিন্দুত্বকে ঘরের মাঠে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। বিজেপি ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দারুণ ফল করে ২০২১-এ জয় নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ভোটের প্রচারে জনসভায় চণ্ডীপাঠ করতে শুরু করেছিলেন। বিজেপির হিন্দু ভোটে ‘সুইং’ করিয়ে ‘উনিশে হাফ, একুশে সাফ’-এর ভাবনা দিবাস্বপ্ন হয়েই থেকেই গিয়েছিল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, পনেরো বছর সরকারে থাকলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্মাবে। শাসক দলকে নিয়ে নালিশ থাকবে। সে সব মোকাবিলা করার রাজনৈতিক উপায় আছে। বিজেপির হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদের রাজনীতির মোকাবিলা করতে হলে তাঁকে ক্রিজ় ছেড়ে বেরিয়ে ব্যাট চালাতে হবে। তাই মোদী পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে অপারেশন সিঁদুরের জয়গান গাইতেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নরেন্দ্র মোদীকে বলে দিয়েছেন, ‘আগে নিজের স্ত্রীকে সিঁদুর পরান’। কেউ রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। তবে এই এক খোঁচায় বিজেপি এখন ঘরে ঘরে সিঁদুর বিলির পরিকল্পনাকেও অস্বীকার করছে। কংগ্রেস নেতারা ভদ্রতার খাতিরে এই কথাটাই বলতে না পেরে হাঁসফাঁস করছিলেন। বিজেপির কৌশল ঘেঁটে দিতে মমতা ব্যক্তিগত আক্রমণের রাস্তায় হাঁটতে দ্বিধা করেননি। অথচ নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ তাঁদের বঙ্গ সফরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে হাঁটেননি। মনে হয়, অতীতে মমতাকে ব্যক্তিগত আক্রমণে লোকসান হয়েছে বলেই তাঁদের ধারণা।

রাজনৈতিক মেরুকরণের বদলে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা বিজেপি ২০২১-এও করেছিল। অমিত শাহ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বিজেপি দু’শোর বেশি আসনে জিতে সরকার গড়বে। দু’শো দূর অস্ত্, একশোও টপকাতে পারেনি। কারণ সংগঠন, ক্যাডার বাহিনী ও বিজেপি-আরএসএসের পুরনো নেতাদের বদলে কৈলাশ বিজয়বর্গীয়রা তৃণমূল ছেড়ে আসা নেতাদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির তিন প্রধান অস্ত্র— ‘সারদা, নারদ ও সিন্ডিকেট’-এর প্রধান চরিত্রদের বিজেপিতে বরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফলে বিজেপির টিকিটে জিতে আসা ৭৭ জন বিধায়কের অনেকে আবার তৃণমূলে ফিরে গিয়েছেন।

এখনও পর্যন্ত ইঙ্গিত, বিজেপি এ বার সেই ভুল শোধরাতে চাইছে। বিজেপি-আরএসএসের সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত পুরনো নেতাদেরই এ বার প্রার্থী তালিকায় গুরুত্ব মিলবে। তৃণমূলে ভাঙন নয়, বিজেপি-আরএসএসের মতাদর্শের প্রতি দীর্ঘ দিনের আনুগত্যই টিকিট বিলির ক্ষেত্রে প্রধান মাপকাঠি হতে পারে। এতে বিজেপির হিন্দু ভোট বাড়ার সম্ভাবনাও বাড়তে পারে।

বিজেপির এই কৌশল ঠেকাতে শুধু মুসলিম ভোট নয়, দলিত ও জনজাতি ভোটব্যাঙ্কও তৃণমূলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ মুসলিম। প্রায় ২৩ শতাংশ দলিত। জনজাতি ভোট প্রায় ৬ শতাংশ। মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক তৃণমূলের সঙ্গে থাকলেও বিজেপি দলিত ও জনজাতি ভোটে অনেকখানি ভাগ বসিয়েছে। তার সঙ্গে ‘এলিট’ হিন্দুদের একাংশের ভোট আছেই। বিজেপির হিসাব গোলমাল করে দিতে হলে তৃণমূলকে এই দলিত, জনজাতি ভোটের দিকেও নজর দিতে হবে বইকি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP Narendra Modi Religious

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।