সমাজমাধ্যম যখন কাঁপছে ‘অর্ডার ছাড়া বর্ডার ক্রস’ নামের এক গানের তালে, তখনই দেখলাম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের সীমান্তবর্তী এলাকায় জনবিন্যাস একেবারে পাল্টে গেছে, যেটা দেশের সুরক্ষার জন্য বিপজ্জনক। কেন্দ্রীয় সরকার এ জন্য বেজায় উদ্বিগ্ন। এত দিন জানতাম, বাংলাদেশি নাগরিকরা পশ্চিমবঙ্গে এসে শাসক দলের মদতে বিভিন্ন সরকারি পরিচয়পত্র বানিয়ে ভারতের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে— কারণ এ রাজ্যে কাজ নেই। সেই ‘অনুপ্রবেশকারী’দের ধরার অজুহাতেই বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষীদের প্রবল নিগ্রহ করা হল। এ বার অমিত শাহ বললেন— অনুপ্রবেশকারীরা নাকি সীমান্তবর্তী অঞ্চলেই থাকছে ও (ধর্মীয়) জনবিন্যাস আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে।
সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানে কি এই দাবির কোনও ভিত্তি আছে? সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথে তিনটি বাধা। প্রথমত, ধর্মীয় জনবিন্যাস সম্পর্কে সাম্প্রতিকতম কোনও তথ্য জনসমক্ষে নেই; দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় জনবিন্যাসের পরিসংখ্যান জেলা স্তরের নীচে (ব্লক বা গ্রামস্তরে) প্রকাশিত হয় না; এবং তৃতীয়ত, ২০২১-এর জনশুমারি না হওয়ার জন্য ধর্মীয় জনসংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি ২০১১ সাল অবধিই মেলে। তাই এক দিকে ১৯৯১ ও ২০১১ সালের জনশুমারি, আর অন্য দিকে পঞ্চম জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০১৯-২১) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলিকে সীমান্তবর্তী (কোচবিহার থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা) আর অ-সীমান্তবর্তী (বাকি সব জেলা মিলিয়ে) জেলাতে ভাগ করে নেব।
জনশুমারির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে সামগ্রিক ভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। ১৯৯১-২০০১ এবং ২০০১-২০১১— এই দু’দশকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২২% ও ১৬.২%; অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এই হার ছিল যথাক্রমে ১৪% ও ১১.৬%। অর্থাৎ, ১৯৯১-২০০১ দশকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলির চেয়ে ৮ শতাংশ-বিন্দু বেশি ছিল, যা পরের দশকে কমে ৪.৬ শতাংশ-বিন্দু হয়। অর্থাৎ, এই সময়কালে সীমান্তবর্তী এবং অ-সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ব্যবধান কমেছে।
১৯৯১-২০১১ পর্যন্ত সীমান্তবর্তী এবং অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে ধর্ম-ভিত্তিক জনসংখ্যার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৯৯১-২০০১ এবং ২০০১-২০১১, এই দুই দশকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দুদের মধ্যে বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১৮.৫% ও ১১.৮%; অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এই হার ছিল যথাক্রমে ১১.১% ও ১০.১%। অর্থাৎ, এই দুই দশকে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের ব্যবধান সীমান্তবর্তী আর অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলির মধ্যে ৭.৪ শতাংশ-বিন্দু থেকে কমে ১.৭ শতাংশ-বিন্দু হয়েছে। ওই দুই দশকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মুসলমানদের মধ্যে বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২৮.১% ও ২৩.৮%; অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এই হার ছিল যথাক্রমে ২১.৮% ও ১৭.৮%। মানে, এই দুই দশকে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের ব্যবধান সীমান্তবর্তী আর অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলির মধ্যে ৬.৩ শতাংশ-বিন্দু থেকে সামান্য কমে ৬ শতাংশ-বিন্দু হয়। অর্থাৎ, ২০১১ পর্যন্ত হিন্দুদের মধ্যে সীমান্তবর্তী আর অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের মধ্যে পার্থক্য কমে এলেও, মুসলমানদের মধ্যে ফারাকটা রয়ে গেছে।
অন্য দিকে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দুদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লিখিত দশকগুলির মধ্যে কমেছে ৬.৮ শতাংশ-বিন্দু; মুসলমানদের মধ্যে কমেছে ৪.৩ শতাংশ-বিন্দু। অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এই হ্রাসের পরিমাণ যথাক্রমে ১ শতাংশ-বিন্দু এবং ৪ শতাংশ-বিন্দু। অর্থাৎ, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দুদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে মুসলমানদের তুলনায় বেশি হারে; আর অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে ঘটছে ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হ্রাসের হার যে শুধু হিন্দুদের চেয়েই কম, তা নয়; অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলির মুসলমানদের চেয়েও কম। সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মুসলমানদের বিপুল অনুপ্রবেশের ফলেই কি এমনটা ঘটছে?
না, এর কারণ অন্য। প্রথমত, সীমান্তবর্তী কিছু জেলাতে মুসলমানদের মধ্যে ১৫-২৪ বছর বয়সের প্রজননশীল মহিলাদের শতাংশ হার সেখানকার হিন্দুদের এবং অ-সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ-বিন্দু বেশি। দ্বিতীয়ত, বহু গবেষণা বলছে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, জীবনযাত্রার মানে ও সমাজজীবনের মৌলিক সুযোগসুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিস্তর ঘাটতি আছে, যেটা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের হ্রাসকে ত্বরান্বিত করার প্রতিকূল।
২০০১-এর জনশুমারি অনুযায়ী, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দুদের মধ্যে মহিলাপিছু বাচ্চার সংখ্যা ছিল ২.৭; আর মুসলমানদের মধ্যে ৪.৪— ফারাক ১.৭। সেখানে অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে মহিলাপিছু বাচ্চার সংখ্যা ছিল ২.২ ও ৩.৮, ফারাক ১.৬। অন্য দিকে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মুসলমানদের মধ্যে মহিলাপিছু ০.৬ বাচ্চার সংখ্যা বেশি অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলির মুসলমান মহিলাদের থেকে। ২০১১-র জনশুমারি অনুযায়ী, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দুদের মধ্যে জন্মহার কমে হয়েছে ১.৬ আর মুসলমানদের কমে হয়েছে ২.৩, ফারাক ০.৭। অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার যথাক্রমে ১.৬ আর ২.১, পার্থক্য ০.৫। সীমান্তবর্তী আর অ-সীমান্তবর্তী মুসলমানদের মধ্যে বাচ্চার সংখ্যার পার্থক্য কমে হয়েছে ০.২। ২০১৯-২০২১’এর পঞ্চম জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মহিলাপিছু বাচ্চার সংখ্যা যথাক্রমে ১.৬ ও ২.১ (পার্থক্য ০.৫) আর অ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে যথাক্রমে ১.৫ ও ১.৯ (পার্থক্য ০.৪)। আর সীমান্তবর্তী আর অ-সীমান্তবর্তী জেলার মুসলমানদের মধ্যে মহিলাপিছু বাচ্চার পার্থক্য একই আছে। আগামী জনশুমারিতে জন্মহারের এই অভিন্নতার প্রক্রিয়াটি ধরা পড়া উচিত।
২০১৬ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, ভারতে অনুপ্রবেশের সময় মোট ১,৬০১ জন বাংলাদেশি ধরা পড়েছিল। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে সংখ্যাটি যথাক্রমে ৯০৭ এবং ৮৮৪-এ নেমে যায়। ২০১৯ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১,১০৯; ২০২০-তে ৯৫৫। বিএসএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২,০১৯-এর ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২-এর ২৮ এপ্রিল অবধি অন্তত ৪,৮৯৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করার সময় আটক করা হয়েছিল; ২০২৩ সালে ২,৪০৬ জনকে আটক করে ফেরত পাঠানো হয়েছিল; ২০২৪ সালে এই সংখ্যা সামান্য বেড়ে ২,৪২৫ জনে দাঁড়িয়েছে; ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ৫৫৭ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে গত তিন বছরে মোট ২,৬৮৮ জন বাংলাদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গে এই সংখ্যা ছিল ২,৪১০; উত্তরবঙ্গে ২৭৮।
আটক করা বাংলাদেশি নাগরিকরা কোন ধর্মের, বিএসএফ-এর রিপোর্টে তা উল্লেখ করা হয়নি; সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বেআইনি ভাবে বসবাসকারী কত জন বাংলাদেশি নাগরিক ধরা পড়েছেন, উল্লেখ নেই তারও। সুতরাং, ‘অর্ডার ছাড়া বর্ডার ক্রস’ অনেকেই করছেন। কেউ কেউ আবার বৈধ ভিসা নিয়ে ভারতে আসছেন, কিন্তু তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও এ-পারে থেকে যাচ্ছেন, ও ভারতীয় সরকারি পরিচয়পত্র তৈরি করে নিচ্ছেন। এ দলে মুসলমানও আছেন, হিন্দুও। কিন্তু, তার সংখ্যা কোনও মতেই এমন নয় যে, তা সীমান্তবর্তী এলাকার জনবিন্যাস পাল্টে দেবে। সত্যিই যদি তেমন হয়ে থাকে, তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উচিত সেই গ্রামগুলির নাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ করা। না হলে বুঝতে হবে যে, এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিমূলক তত্ত্ব।
শেষে একটা অন্য প্রশ্ন করি। সীমান্তের দু’পারে ভাষা ও সংস্কৃতির মিল থাকলে দু’পারের মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিবিড় সম্পর্ক আর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। দুই দেশের কূটনৈতিকবৈর সীমান্তে পাহারা বাড়ালে সেই দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক সীমান্ত কি মানুষের মনেও সীমারেখা টানতে পারে? তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদান কখনও বন্ধ করা যাবে কি?
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)