মনে পড়ছে, অ্যালান একবর্ন-এর বিপুল জনপ্রিয় নাটক আর্নি’জ় ইনক্রেডিবল ইলিউসিনেশনস্-এ আর্নি নামে এক বালক যা যা ভাবে, আশেপাশের সবাই তা ভাবতে শুরু করে দেয়। আর্নি যদি ভাবে যে, স্কুলের লাইব্রেরিতে এক ঘনঘোর রহস্যকাহিনির পরতের পর পরত উন্মোচিত হচ্ছে, তা হলে খানিক বাদেই সকলে দেখতে পায় যে, একটি ছুরিবিদ্ধ মৃতদেহ শুয়ে আছে বাঁ দিকের বইয়ের আলমারিটার সামনেই। নাট্যকার, ‘ইলিউশন’-এর (বিভ্রম) এই সামাজিক ‘হ্যালুসিনেশন’-এর নাম দেন, ‘ইলিউসিনেশন’, যা এমনকি এক মনোবিদকেও ওই বালকের কল্পনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্ররোচিত করে।
নাটকে যা দেখলে মজা পাওয়া যায়, বাস্তবে তা দেখলে আতঙ্কিত হতেই হয়। দেড়শো কোটি মানুষের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার অধিনায়ক কিংবা বাঘা খেলোয়াড়দের অনেকে দর্শককে প্রায় করজোড়ে মিনতি জানাচ্ছেন, ‘অনলাইন জুয়া’ খেলার জন্য, এমন কিছু কি আমরা কুড়ি বছর আগে কল্পনাও করতে পারতাম? সম্প্রতি ভারতের সংসদে এই অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে বিল পাশ হয়েছে। অযৌক্তিক বা অন্যায় হলেই যে কোনও বস্তু জনপ্রিয় হবে না, তা কিন্তু নয়। আর, অনেকে যা ভালবাসে, তাকে বন্ধ করে দেওয়া খুব কঠিন ব্যাপার এখন। কারণ যে মানুষ ভাত না-পেলেও সয়ে যাচ্ছে, সে বিনোদনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলেই ক্ষোভে ফেটে পড়ছে।
হ্যাঁ, এ কথা না মানলে ভুল হবে যে, সমাজমাধ্যম আজ কেবল বিনোদনের নয়, ব্যবসারও জায়গা। ক্রমহ্রাসমান নিশ্চিত চাকরির যুগে অনেক দেশেই তরুণ প্রজন্মের একাংশ জীবিকার জন্য ইন্টারনেটের নানান প্ল্যাটফর্মের উপরে নির্ভরশীল। তার পরও গোষ্ঠী-সংঘর্ষ বা অন্য বহু ঘটনাই ঘটে, যার জেরে নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা ভিন্ন উপায় থাকে না পুলিশ-প্রশাসনের কাছে। কিন্তু অন্য অনেক কিছু মেনে নেওয়া প্রজন্মও ওই সমাজমাধ্যমের আঙিনা বন্ধ হওয়া মেনে নিতে চায় না কিছুতেই।
নেপালের বিদ্রোহেও যেন তাই। সরকারের নানাবিধ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সঙ্গত ক্ষোভ তখনই দু’কূলপ্লাবী আন্দোলনে বদলে গেল, যখন ফেসবুক, এক্স, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি সমাজমাধ্যমের উপরে নিষেধাজ্ঞা নেমে এল। ওই বিদ্রোহ নিয়ে গণমাধ্যমের নানান তরজার মধ্যে একটি কথা মনে দাগ কাটল— “কারও বাড়িতে আগুন লাগলে নেবানোর জন্য দশ জনকে পাওয়া যায় না, কিন্তু বড় বড় সরকারি বাড়িতে আগুন দেওয়ার জন্য নিমেষে হাজার লোক জড়ো হয়ে গেল।” অবাক করার মতো আর একটি ব্যাপার হল, নেপালের সংসদ ভবন বা সিংহ দরবারের মতো ঐতিহ্যের ধারক বাড়িগুলিকেই কেবল ধ্বংস করা হয়নি, পোখরা কিংবা বিরাটনগরের মতো শহরের অসংখ্য সাধারণ সরকারি সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভস্মীভূত হয়েছে পঞ্চাশের কাছাকাছি গ্রাম-পঞ্চায়েতের দফতর। কাঠমান্ডুর মতো শহরে ক্ষমতার শীর্ষ স্তরে বসে থাকা ব্যক্তিদের উপরে বল্গাহীন রাগ যদি মেনেও নেওয়া হয়, তাঁদের স্ত্রী কিংবা পরিবারের উপরে প্রাণঘাতী আক্রমণকে ‘সংশ্লিষ্ট ক্ষয়ক্ষতি’ বলে দায় এড়ানো কঠিন। আরও কঠিন, প্রত্যন্ত গ্রামের পঞ্চায়েত দফতরে আক্রমণের ঘটনাকে ক্ষমার চোখে দেখা। এর মধ্যে দিয়ে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস নয়, স্বেচ্ছাচারের উচ্ছৃঙ্খলতাই প্রকাশ পায়।
পাল্টা যুক্তি আসতেই পারে যে, ‘দুর্নীতি’ হচ্ছিল সর্বত্র। কিন্তু সরকারের টাকায় চলা ‘মিড-ডে মিল’এর চাল কেনার ক্ষেত্রে পয়সার নয়ছয় হয়ে থাকলে, স্কুলের ‘কমিউনিটি কিচেন’ পুড়িয়ে দিতে হবে— এটা কোথাকার যুক্তি? খবরের কাগজেই প্রকাশ, বিপ্লবের নামে এই তাণ্ডবের ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় তিন লক্ষ কোটি নেপালি টাকার কাছাকাছি, যা নেপালের দেড় বছরের বাজেটের সমতুল। কেন এ রকম হল, সেই প্রশ্নের উত্তরে ‘জেন-জ়ি’র নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে বলতে শোনা গেল যে, দেশের প্রধানমন্ত্রী-সহ আরও আট-দশ জন নেতা-মন্ত্রীর পুত্রকন্যারা অনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন প্রচুর, আর সেই ‘নেপো কিডস্’-এর বিরুদ্ধে ক্ষোভই সমাজমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় আছড়ে পড়েছে রাস্তায়।
শুনে মনে হতেই পারে যে, ওঁরা বোধ হয় বাক্স্বাধীনতা আর মতপ্রকাশের অধিকারকে সবচেয়ে উঁচু জায়গা দিচ্ছেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যায় যে যাঁরা ‘পাঁচ কোটি’র মূলধন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করা সংবাদপত্র কিংবা পত্রিকাকে ‘অমুক’-এর কাগজ, ‘তমুক’-এর কাগজ বলে দাগিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত, তাঁরাই পাঁচ লক্ষ কোটি কিংবা তারও অনেক বেশি পুঁজির সমাজমাধ্যমকে স্বাধীন ভাবপ্রকাশের জায়গা বলে মেনে নিতে কসুর করেন না। যেন, এই সমস্ত সমাজমাধ্যমের পিছনে বহু বিলিয়ন ডলার ঢালা হয়েছে লাভের আশা ছাড়াই। ব্যাপার তা নয় বলেই ফেসবুক হোক কিংবা এক্স-এর মতো সমাজমাধ্যম তাদের কর্ণধারদের ইচ্ছাধীন। আর সেই সকল কর্ণধাররা সর্বশক্তিমান দেশটির বাসিন্দা বলেই, ব্যক্তির বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থ অনেক জায়গায় মিলে যায়।
তার পরও সংবাদমাধ্যম বনাম সমাজমাধ্যমের দ্বৈরথে সমাজমাধ্যমই এগিয়ে থাকবে আজ— কারণ, দ্বিতীয় পরিসরটি, বহু ক্ষেত্রেই, ত্রিশ বছর অভিনয় বা সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের থেকে, ‘দু’মিনিটের রিল’ বা ‘দশ মিনিটের মোনোলগ’ বানানো ব্যক্তিকে অধিকতর পরিচিতি দিয়েছে। কিন্তু সেই সংখ্যা সামগ্রিক জনসংখ্যার নিরিখে ঠিক কতখানি? ‘জেন-জ়ি’র নেতৃত্ব হিসাবে যে মুখগুলো উঠে আসছেন— কেবল নেপালে নয়, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশেও— তাঁরা কত জন খেতমজুর কিংবা প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সন্তান? দেশ চালানো অনেক দূরের কথা, একটি পঞ্চায়েতের দায়িত্ব পেলে তাঁদের কত জন বলতে পারবেন যে, ধান এবং চা-এর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কোন সারগুলোর উপর সরকারি ভর্তুকি বেশি করে পাওয়া দরকার? মদেশীয় চা বানাবার পদ্ধতি যে পাহাড়ি চা বানাবার পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, আর তার অন্যতম কারণ হল উত্তর এবং দক্ষিণ নেপালে জলের সরবরাহ সমান নয়, এই শিকড়-সিঞ্চিত বোধ কত জনের আছে? বোধ থাকলে কি পাঁচ জন নেতার উপর রাগে পাঁচশো সরকারি বাড়ি অর্থাৎ দেশের সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া যায়?
যায় না। কিন্তু গেল। কী ভাবে গেল? অত বড় বড় অফিস, হোটেল, সংস্কৃতি-কেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়ার মতো পেট্রল বা ডিজ়েল রাতারাতি কোথা থেকে একত্রিত করা হল? যারা তা করতে পারল, তারা সীমান্তের এ পারে থাকা ভারতের কোনও শহরে একই রকম তাণ্ডবের নীল নকশা তৈরি করবে না, কী গ্যারান্টি তার? অতএব, নেপালের অপসৃত প্রধানমন্ত্রী বা মার খাওয়া অর্থমন্ত্রী ভারত-বিরোধী ছিলেন, এই আনন্দে আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে শাস্তি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, তাঁরা দু’জনই রাজনীতি করতে গিয়ে দশ বছরের বেশি সময় জেল খেটেছেন এবং মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন, এ কথা বিস্মৃত হওয়ার কোনও কারণ দেখি না।
বাংলাদেশের ধাঁচে নেপালেও রাজনীতির বাইরে থেকে মানুষ এনে শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে। এ রকম ঘটলে ঠিক কী হয়, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গত এক বছর আমরা প্রত্যক্ষ করছি। নেপালে অন্য রকম কিছু ঘটবে কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে যে ক্রমাগত রাজনৈতিক পদে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিষ্ঠান ঘটছে, তা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষেও খুব শুভ সংবাদ নয়। ইঞ্জিনিয়ারদের বানানো সেতু ভেঙে গেলে নতুন সেতু গড়ার জন্য আমরা ডাক্তার ডেকে আনি না। রাজনীতির জায়গা থেকে রাজনৈতিক লড়াই করে আসা মানুষদের সরিয়ে দিলেই রাতারাতি দুর্নীতি-মুক্ত দেশ ডানা মেলবে, এটাও এক প্রকার ‘ইলিউসিনেশন’।
সেই ভ্রম নাটকের বালক আর্নির করা মানায়, কিন্তু উপমহাদেশের যুবসমাজ যদি সেই ‘ভ্রম’কেই মুক্তির উপায় বলে ভাবতে থাকে, তবে কেবল ফেলুদা নয়, তোপসেরও নিশ্চিন্ত থাকার উপায় নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)