E-Paper

সন্তান বড় হয়ে কেমন হবে

শিশু-মনোবিদরা বলছেন, সন্তান প্রতিপালনের কোনও বাঁধাধরা নৃতাত্ত্বিক ছক নেই। নৃতত্ত্বের অধ্যাপক মেরিডিথ স্মলের মতে, শিশুরা বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীদের যৌথ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নিয়েই বড় হয়।

অরবিন্দ সামন্ত

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৩২

সামাজিক অবক্ষয়ের ছবি আমাদের চার পাশে এখন এতই স্পষ্ট যে, তার শিকড়ে পৌঁছনোর চেষ্টা না করলেই নয়। সেই অবক্ষয়ের সূচনা হয় কেন, কখন, কী ভাবে? শিক্ষাদীক্ষাহীন, দুর্বিনীত শিশুই কি ধর্ষকে পরিণত হয়? তা হলে সন্তানদের লালন করব কী ভাবে? শিশু-মনোবিদরা বলছেন, সন্তান প্রতিপালনের কোনও বাঁধাধরা নৃতাত্ত্বিক ছক নেই। নৃতত্ত্বের অধ্যাপক মেরিডিথ স্মলের মতে, শিশুরা বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীদের যৌথ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নিয়েই বড় হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই পণ্ডিতরা বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে, হিটলার, ফ্র্যাঙ্কো, মুসোলিনির মতো যুদ্ধ-উন্মাদ স্বৈরাচারীদের নির্মাণের শুরু কি শৈশবেই? ফ্যাসিস্টদের ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যের শিকড় খুঁজতে গিয়ে থিয়োডোর অ্যাডর্নো আর হ্যানা আরেন্ট লক্ষ করেছিলেন, কর্তৃত্বের কাছে নিরঙ্কুশ আনুগত্য, নির্বিরোধ বশ্যতা, আগ্রাসন এবং যুক্তিবাদ ও বৌদ্ধিক বিচারের বিরোধিতা— ফ্যাসিবাদের এই বৈশিষ্ট্যগুলির গোড়াপত্তন শৈশবেই।

এঁদের গবেষণার সূত্র ধরে মনোবিদ ডায়ানা ব্লুমবার্গ বমরিন্ড ১৯৬০-৭০’এর দশকে তিন ধরনের সন্তানপালন পদ্ধতির কথা বললেন। প্রথম পদ্ধতিটি হল অথরিটেরিয়ান বা স্বৈরাচারী সন্তান প্রতিপালন, যেখানে বিধিনিষেধের অত্যন্ত বাড়াবাড়ি। শিশুর থেকে প্রত্যাশাও আকাশছোঁয়া, নির্বিচার, কঠোর। বেয়াড়া আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় শাস্তির মাধ্যমে। শিশুর আবেগের মূল্যই থাকে না। ক্ষমাহীন, নিষ্করুণ পৃথিবীর জন্য শিশুকে প্রস্তুত করা হয়। বমরিন্ডের মতে, স্বৈরাচারী শাসনে প্রতিপালিত শিশু জীবনে সাফল্য পায় মাঝারি রকমের— বাধ্য, অনুগত, প্রথানুবর্তী পুরুষ হিসাবে পরিচিত হয়। কিন্তু মনে পুষে রাখে অবরুদ্ধ ক্রোধ, নালিশ— অল্প প্ররোচনাতেই যার বিস্ফোরণ ঘটে। এদের সামাজিক দক্ষতা কম হয়, কারণ অভিজ্ঞতা দিয়ে কিছুই শেখে না, বড় হয় অপরের আজ্ঞাবহ হয়ে। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি অথরিটেটিভ বা কর্তৃত্বময় সন্তানপালন, যেখানে সন্তানপালনে আরোপিত বিধিনিষেধ, প্রত্যাশাগুলি স্পষ্ট, সামঞ্জস্যপূর্ণ; কিন্তু অন্য দিকে আছে নমনীয়তা, প্রশংসা, শাস্তির বদলে ক্ষমার জায়গা, শিশুদের সম্ভাবনা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিকাশের সুযোগ। এই ধরনের লালনের ফল শুভ। সুখী, সংবেদনশীল, সামাজিক ভাবে পরিপক্ব, পরিপূর্ণ, স্বাধীন, স্বাবলম্বী শিশুর গড়ে ওঠার সুযোগ ঘটে। বমরিন্ড বর্ণিত তৃতীয় পদ্ধতিটি পারমিসিভ বা সম্মতিমূলক সন্তানপালন। শিশুর কাছে প্রত্যাশা নামমাত্র, দাবিও নেই, নেই বিধিনিষেধের আগড়। এমন প্রতিপালনের ফলে শিশু বড় হয় অসংযত, ভোগপরায়ণ, অসহিষ্ণু, হতাশাগ্রস্ত যুবক হিসাবে। বমরিন্ডের এই ত্রিবিধ শিশু-প্রতিপালনের ধারণার সঙ্গে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এলেনর ম্যাকবি এবং জন মার্টিন যোগ করেছেন উদাসীন শিশু প্রতিপালনের ধারণা— যেখানে শিশুর কাছে অভিভাবকের কোনও দাবিদাওয়া নেই, তার প্রতি মনোযোগও নেই।

মনোবিদরা মানছেন, সন্তান যে ভাবেই মানুষ করুন, বৃহত্তর সমাজের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধই শেষ কথা বলে। মনোবিদ জুডিথ হ্যারিস-এর মত, পিতা-মাতা নয়, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ শিশুরা শেখে সমবয়সিদের থেকে। শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে পিতা-মাতার ভূমিকা নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করা হয়। একটা বয়সের পর শিশুর জীবন গঠনে বাবা-মা নয়, সমবয়সিরাই নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। বাবা-মা’র রুচি ও নির্দেশ তারা শেষ পর্যন্ত সমবয়সিদের পরামর্শেই গ্রহণ বা বর্জন করে। দেখা গিয়েছে, বিবাহবিচ্ছিন্না মা যেখানে একাই সন্তান পালন করেন, সেখানে সন্তানের অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের ঝুঁকি অনেক বেশি। সন্তান প্রতিপালনে গলদের জন্য নয়— একার রোজগারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মা সাধারণত যেখানে বসবাসে বাধ্য হন, সেখানে স্বল্প-আয় পরিবারের শিষ্টাচারহীন বাচ্চা বেশি। তাদের অপভাষা রপ্ত করে শিশু বড় হয়। এই বক্তব্য মনোবিদ মহলে একই সঙ্গে নিন্দা এবং প্রশংসার ঝড় তুলেছিল। বলা হয়েছিল, জুডিথ বাবা-মায়ের ভূমিকা লঘু করছেন। তবে এখন শিশু-মনোবিদরা মানেন, জীবনগঠনে সমবয়সি বন্ধুদের প্রভাবও কম নয়।

বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা, খেলাধুলা সামাজিক যোগ্যতা বৃদ্ধি করে। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক, মানসিক, জ্ঞানীয় এবং আচরণগত দক্ষতা, যা সামাজিক অভিযোজনে প্রয়োজনীয়। ইতিহাসবিদ জোহান হুইজ়িঙ্গা মানুষকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন ‘হোমো লুডেন্স’ (খেলার মানুষ) বলে। মানুষ খেলার মাধ্যমে বিশ্বকে বুঝতে চায়। তার সাংস্কৃতিক ক্ষমতার বিকাশ ঘটে প্রধানত খেলার মাধ্যমে। আমাদের যাবতীয় ‘সোশ্যাল ন্যারেটিভ’, সংগঠনমূলক কাজ, প্রকৃতপক্ষে ‘খেলারই অংশ, যা মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে নতুন অর্থ দেয়। তাই খেলাধুলাটা জরুরি। এতে ক্যালরি ব্যয় হয়, খেলাধুলার সূত্রেই পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়। ফলে শিশুর সাংস্কৃতিক বোধও প্রসারিত হয়। পাড়ার চার পাশে কি নোংরা আবর্জনা ছড়িয়ে; আশপাশে কোনও বাড়ি কি জরাজীর্ণ; পার্কগুলো কি নিরাপদ; পাড়ায় ধর্মসভার কথা হচ্ছে, না কি শহিদ স্মরণে কোথাও সভা হচ্ছে, অভাবীদের জন্য খাদ্য-বস্ত্র বিতরণের আয়োজন হচ্ছে— এ সব কিছুই তাকে তার পারিপার্শ্বিক সমাজ-বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন করে। সে সমাজমনস্ক হয়ে ওঠে।

মোবাইল, ট্যাব ধরিয়ে চার দেওয়ালে আটকে রাখা নয়, বাবা-মা যদি এই ধরনের যৌথ, সমষ্টিগত সামাজিক আখ্যানের সঙ্গে শিশুকে সংযুক্ত করেন, তা হলে সে দায়িত্বশীল সুস্থ নাগরিক হিসাবে বড় হয়ে উঠতে পারে, আমাদেরও ‘সামাজিক অবক্ষয়’ নিয়ে হা-হুতাশ করতে হয় না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Children Society

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy