উত্তরবঙ্গের অখ্যাত সেই মফস্সলে তখন বন্যা হত বছরে দু’বার। বর্ষার শুরুতে এক বার, আর শেষ বর্ষায় ঠিক পুজোর আগের সময়টিতে এক বার। হামেশাই বর্ষাশেষের বন্যাটি হত প্রবলতর। পাহাড়ের জোরালো বৃষ্টির জল নেমে তিস্তা, মহানন্দার পাশাপাশি সমতলের অন্য নদীগুলিকেও টইটম্বুর করে তুলত। উপচে পড়া পুনর্ভবা, টাঙ্গনের জল বয়ে এসে ভাসিয়ে দিত বাড়ির উঠোন, সামনের রাস্তা। হাটের মাঠ আর পাশের দিঘি ঘোলা জলে মিলেমিশে একাকার। সাদামাঠা আলু-পেঁয়াজের তরকারি আর খিচুড়িময় দিনগুলিতে বছর সাত-আটের মেয়েটির কিন্তু ভারী আনন্দ হত। ঘোলা জল নামতে শুরু করার দিনকয়েকের মধ্যেই উঁকি দেবে বৃষ্টিধোয়া আকাশ। বাজারের সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকানটিতে যাওয়া-আসার ব্যস্ততা বাড়বে মা-বাবার। তার পরেই আগমনী সুর মেখে মা দুর্গার সঙ্গেই তারও আসবে বাড়ি ফেরার পালা। সারা বছরের একলাযাপনকে মাসখানেকের জন্য বিদায় জানিয়ে কলকাতার ঠিকানায় তার একান্নবর্তী পরিবারটির কোলে আশ্রয় নেওয়ার পালা। ওই বয়সে ঠাকুর দেখা, নতুন জামার চেয়েও সম্পদময় ছিল ডজনখানেক কাকা-পিসি-মাসি-দাদু-দিদার অপর্যাপ্ত স্নেহস্পর্শ, সারাবছর যেটুকুর জন্য একমনে ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টানো চলত।
সেই প্রতীক্ষা আজও একই রকম থেকে যায়নি কি? প্রতীক্ষা তো শুধুমাত্র চারটি জাঁকজমকপূর্ণ পুজো-দিনের জন্য নয়, রাত জেগে, রোদে পুড়ে ক’টি ঠাকুর দেখা হল— তার জন্যও নয়। এই প্রতীক্ষা আসলে ‘দুর্গাপুজো’ নামধারী মাসাধিক কাল ব্যাপী এক সম্মিলিত যাপনের, এক অন্য রকম সামাজিক বন্ধনেরও। দুর্গাপুজো কোনও দিনই শুধুমাত্র আচার-নিয়ম সর্বস্বতার ধরাবাঁধা গণ্ডিতে আটকে পড়ে থাকেনি। বরং নিয়মরীতির অনুশাসনটিকে ঠাকুরদালানের চৌহদ্দিতেই আবদ্ধ রেখে বাকিটুকু কখন যেন এক আদ্যন্ত মিলনোৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা শুধুই বাঙালির নিজস্ব নয়, ‘অন্য’দেরও বটে।
মনে পড়ে যায়, এক আবাসনের পুজোর ঘটনাবলি। পুজো শুরুর দিনকয়েক আগে খোঁজ পড়ল হাতে আঁকা ছবির। কম বাজেটের পুজোয় এই আঁকা ছবি দিয়েই হবে মণ্ডপসজ্জা। ছোট আবাসন। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আঁকা যা জোগাড় হল, তা নেহাতই কম, খানিক অপটু হাতেরও। হঠাৎই কচিকাঁচা দলের মধ্য থেকে দু’জন জানাল কয়েক মাস আগে বিহার থেকে আসা এক পরিবারের কথা, যাদের ছোট ছেলেটি নাকি ভাল আঁকে। অতঃপর তাঁদের ফ্ল্যাটে যাওয়া এবং দিনতিনেকের মধ্যে ছেলেটির অপূর্ব তুলির টানে আঁকা খানছয়েক ছবির মণ্ডপসজ্জায় জায়গা করে নেওয়া। ভিন রাজ্যের যে পরিবারটিকে সরাসরি দুর্গাপুজোয় শামিল করার ভাবনা আসেনি কারও মাথায়, সেই পরিবারের ছেলের হাতে আঁকা ছবি ছাড়া এখন মণ্ডপসজ্জা, ঠাকুরের পায়ের সামনের আলপনা সম্পূর্ণ হয় না। তার মায়ের হাতে বানানো ঠেকুয়া, লিট্টি-চোখা ছাড়া ‘আনন্দমেলা’র আয়োজনও আজ ফিকে লাগে। পুজোর ছুটিতে বিহারের বাড়ি যাওয়া কখন থেকে যেন তাদের বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
মিলনোৎসবের এই সুরটি সব বয়সের মানুষকে ছুঁয়ে যায় ঠিকই, তবে ছোটদের কাছে একটু যেন বেশি করেই ধরা দেয়, বছরের বাকি দিনগুলোয় এক সীমাহীন নিঃসঙ্গতার মাঝে একটু-একটু করে তাদের বেড়ে ওঠার মুহূর্তগুলিকে দিনকয়েকের ছুটিতে পাঠিয়ে। ছোটদের পুজো মানে এখন শুধু নতুন জামার গন্ধ নয়, পুজোবার্ষিকীর আনন্দও নয়। জামা, বই, গ্যাজেটস তাদের হাতে বছরভরই আসতে থাকে। পুজোর বিরতিটুকু বরং তার চেয়েও মূল্যবান কিছুর সন্ধান এনে দেয়— আপনজনের সঙ্গলাভ। এক অতিব্যস্ত জগৎসংসারে, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর পারিবারিক গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে থাকা জীবনে এই কিছু দিনই তাদের কাছে ব্যতিক্রম হয়ে থাকে।
তাদের নিঃসঙ্গতা কতখানি? এই বছর গরমের ছুটি পড়ার পর জানা গিয়েছিল, কলকাতার বেশ কিছু স্কুল শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের মা-বাবাকেও গরমের ছুটির কাজের অংশ করেছে। সে কাজ নিছক পড়াশোনা সম্পর্কিত নয়। তাতে ছিল মা-বাবার সঙ্গে রাতের শহর দেখা, দাদু-দিদার মুখ থেকে গল্প শোনা, পরিবারের সকলের সঙ্গে সিনেমা দেখা, বেড়াতে যাওয়ার মতো বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে কাজগুলি অতি সাধারণ। কিন্তু বাস্তবের অণু পরিবারে এই মুহূর্তগুলিকেই জড়ো করা এখন দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড়দের সময়ের অভাবে শিশু ছুটির আনন্দ কাটাতে স্ক্রিনটাইম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই প্রবণতা ঠেকাতেই এমন অভিনব ভাবনা।
শিশুদের একাকিত্বের সবটুকুকে অবশ্য একমাত্র এই যুগের খোপে বসিয়ে দেওয়া অনুচিত। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের ছবি জয় বাবা ফেলুনাথ-এর রুকু ঠিক এখনকার প্রজন্মের নয়। কিন্তু তার জগৎটিও ছিল একান্ত নিজের। রাশভারী বাবা, মা কেউ-ই সেই দুনিয়ার নাগাল পায়নি। একাকী রুকু চিলেকোঠার ঘরের কোণে, রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ়ের পাতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। কাশীর পৈতৃক বাড়িতে এসে তার রহস্যপ্রিয় মন দাদুকে বানিয়ে নেয় ‘পার্টনার ইন ক্রাইম’। বাকিটা ইতিহাস। সে-ও এক দুর্গাপুজোরই গল্প।
পুজোর মতো উৎসবই বোধ হয় পারে হরেক অ-প্রাপ্তির যন্ত্রণাকে ভুলিয়ে দিতে। বছরকয়েক আগের এক আবাসনে দুর্গাপুজোর অষ্টমী। পুজো-শেষে খিচুড়ি খাওয়ার ভিড়। বয়স্ক মহিলারা এক তরুণীকে খানিক জোর করেই খেতে বসিয়ে দিলেন। কোলে তার বছরখানেকের কন্যা। দেখা গেল, গরম খিচুড়িতে ফুঁ দিয়ে মা নিজে এক চামচ খাচ্ছে, মেয়েকেও এক চামচ খাওয়াচ্ছে। দুরন্ত মেয়ের লাফালাফিতে খিচুড়ি কখনও ছিটকে পড়ছে মায়ের শাড়িতে, কখনও মেয়ের জামায়। তা মুছিয়ে ফের চলছে খাওয়া, মা-মেয়ের খুনসুটিও। এমন অপার্থিব এক দৃশ্যে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে শিশুটির ঠাকুমার প্রবেশ। তাঁর নাতনির দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মা-মেয়ের সেই আলোমাখা দৃশ্য দেখে তিনিও থমকালেন। এগোলেন না এক পা-ও। জানা গেল, শিশুটির মা বড় চাকরি করে। সপ্তাহে ছ’দিনই তার সঙ্গে মেয়ের দেখা হয় না। মেয়ে বড় হয়ে ওঠে ঠাকুমা আর আয়ার কোলে। এই ক’দিনের ছুটি একরত্তির মা’কে কাছে না পাওয়ার ফাঁকটুকুকে পূরণ করে দিয়েছে অনায়াসে।
বছরখানেকের শিশুর নিঃসঙ্গতা অনুভবের বয়স হয়নি। পারিবারিক ঘেরাটোপও তখনও তার সঙ্গ ছাড়েনি। কিন্তু তার পরের ধাপটি? কেমন কাটে এই প্রজন্মের শিশুদের পুজো? ‘প্যান্ডেল হপিং’, বেড়াতে যাওয়া, আত্মীয়-পরিজনের বাড়ি যাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— এই সব চেনা ছবির বাইরে একটি বছর দশ-এগারোর মেয়ের কথা ভারী অন্য রকম ঠেকে। সে পুজোর দিনকয়েক কাটাতে চায় হ্যারি পটার পড়ে। পুজো তার ভাল লাগে না। কেন? বছর দুয়েক আগে অন্য রাজ্য থেকে তারা কলকাতায় স্থায়ী ভাবে থাকতে এসেছে। ছেড়ে এসেছে বন্ধুবান্ধব সমেত আস্ত এক ছেলেবেলা। ভারী মনমরা থাকে সে। বইপড়ুয়া মেয়ে স্বস্তি খুঁজতে চায় বইয়ের পাতায়। সেখানেও এক অন্য উপদ্রব। তার বাঙালি মা অবসর সময়ে জোর করে বাংলা পড়াতে চায়। পুজোর দিনে মা ব্যস্ত থাকবে পাড়ার পুজোর কাজে, সেই মুহূর্তগুলি একেবারে তার নিজের। পুজো তাকে আনন্দ দিতে না পারুক, স্বস্তিটুকু অন্তত এনে দেবে।
বিভিন্ন গবেষণায় স্পষ্ট, এখনকার শিশুরা অত্যধিক একাকিত্বে ভোগে। আজকের জেন-জ়ি মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাবলেটে তুখড়। ক্রমশ তারা সরে যাচ্ছে সামাজিকীকরণের আলোকবৃত্তটি থেকে। প্রবল প্রতিযোগিতার যুগে মুখোমুখি বসার, ঘণ্টাখানেক গল্প করার মতো আবহের সঙ্গে পরিচিত হয় না তারা। অলক্ষ্যে সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে চলে ডিজিটাল দুনিয়া। বহু বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, এমনটাই চলতে থাকলে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতেও ভুলে যাবে তারা।
এই যান্ত্রিক একুশ শতকের বঙ্গে দুর্গাপুজোর আগমন কি এখনও এক রাশ টাটকা অক্সিজেন? কে জানে! তবে এমনটাই ভাবতে ইচ্ছে করে। কেমন হয় যদি ছোটখাটো পুজোর উদ্যোক্তারা চাঁদা তোলার দায়িত্বটি তুলে দেন অল্পবয়সিদের হাতেই? হিসাব বোঝা, কাজ ভাগ করে নেওয়া, বাজেট করা— কে বলে ছোটরা পারে না? যদি আরও কিছু দায়িত্ব দেন তাদের, শিখেও যেতে পারে ওরা! যেমন ভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দীর্ঘ প্রস্তুতি সারা দিন স্কুল-টিউশন-হোমওয়ার্কে আচ্ছন্ন রুটিন ভেঙে তাদের বার করে আনে— তেমনই কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব পেলে তারা হয়তো খুশি হত, বাড়ির বাইরের অন্যদের সঙ্গে আরও একটু সম্পর্ক তৈরি হত। ধৈর্য ধরা, এক সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করা, অন্যের অসুবিধায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া— এগুলো কি স্কুল-কলেজের পরীক্ষার চেয়ে কিছু কম গুরুতর? শিশুকিশোর মনে এই মানবিক, সামাজিক গুণগুলির চর্চার কথা আমরা বড়রা পুজোর সময় আর একটু ভাবতে পারি। উৎসবকে কেন্দ্র করে একটু অন্য কিছু শেখাতে পারি। ছিদ্রান্বেষী, বিদ্বেষদীর্ণ, হিংসায় ভরপুর এই দুনিয়ায় আর একটু মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে পারি— সবাই মিলে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)