E-Paper

দলাই লামা নিয়ে মরিয়া চিন

অষ্টাদশ শতকে চিং সম্রাট চানলোং প্রবর্তিত ‘সোনার কলস’ প্রথা ফিরিয়ে এনে পরবর্তী দলাই লামার নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি সারতে চায় চিন সরকার। এই প্রথায়, পবিত্র বিগ্রহের সামনে রাখা ‘সোনার কলস’ থেকে এক জন প্রার্থীর নাম লটারিতে বেছে নেওয়া হয়।

পার্থপ্রতিম মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৫২

নবতিপর বর্তমান (চতুর্দশ) দলাই (তিব্বতি বনানে ‘দালেই’) লামার পরে পঞ্চদশ দলাই লামা কে হবেন, তা নিয়ন্ত্রণ করতে কমিউনিস্ট, ধর্মনিরপেক্ষ চিন সরকার সম্প্রতি যে ভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছে তা বেশ অবাক করার মতো। এই ধর্মীয় পদের উত্তরাধিকার নিয়ে চিনের এই উদ্বেগ কেন?

অষ্টাদশ শতকে চিং সম্রাট চানলোং প্রবর্তিত ‘সোনার কলস’ প্রথা ফিরিয়ে এনে পরবর্তী দলাই লামার নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি সারতে চায় চিন সরকার। এই প্রথায়, পবিত্র বিগ্রহের সামনে রাখা ‘সোনার কলস’ থেকে এক জন প্রার্থীর নাম লটারিতে বেছে নেওয়া হয়। অন্য দিকে, দলাই লামা-সহ তিব্বতি বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মীয় পদাধিকারীদের মনোনয়ন এত কাল হয়ে আসছে— তিব্বতি ভাষায় যাকে ‘টুল-কু’ বলে সেই ‘পুনরায় দেহধারণ’-এর বিশ্বাস অনুযায়ী। এই ‘টুল-কু’র তিব্বতি ভাষায় অর্থ, বুদ্ধের পবিত্র তিন শরীরের অন্যতম শরীর, ‘নির্মাণকায়’।

১৯৯৫-এর মার্চ মাসে চিন সরকার একাদশ পাঞ্চেন লামা নির্বাচনের সময়ও একই পদক্ষেপ করেছিল। চানলোং-এর চালু করা প্রথা সঙ্ঘের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখানে চানলোং সম্পর্কে একটা কথা স্মরণে রাখা জরুরি। চানলোং নিজে বৌদ্ধধর্মের অনুগামী ছিলেন। এই বন্দোবস্ত তিনি করেছিলেন পদ্ধতিগত সুবিধার কারণে ও কিছুটা গোষ্ঠীগত সমস্যা সমাধানের জন্যে— সে এক জটিল ও দীর্ঘ ইতিহাস। লটারির ব্যাপারটা ছিল নিছকই বাহ্যিক একটা অনুষ্ঠান, বাস্তবে তিব্বতি ঐতিহ্য অনুযায়ী ‘টুল-কু’ প্রথা মেনেই প্রার্থীদের মনোনয়ন করা হত।

দলাই লামা ও টাশি হ্লুনপো মনাস্ট্রি উভয়ে একত্রে যাঁকে একাদশতম পাঞ্চেন লামা মনোনীত করেছিলেন, মাত্র ছ’বছর বয়সের সেই গেন্দুন ছোয়েকি নিমা-কে ১৯৯৫-এ চিন সরকার গ্রেফতার করে। আজ পর্যন্ত সেই শিশুর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। চিনের কমিউনিস্ট ইতিহাসে গেন্দুন ছোয়েকি-ই বোধ হয় সর্বকনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্দি। এর পর চিনের কর্তৃপক্ষ যাঁকে এই পদে বহাল করে সেই ছোয়েকি গ্যালপো-র মা-বাবা দু’জনেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। সাধারণ তিব্বতিরা তাঁকে এখনও ‘নকল পাঞ্চেন লামা’ বলেই উল্লেখ করে থাকেন।

পঞ্চদশ দলাই লামার মনোনয়ন নিয়ে বিতর্ক ঠিক এইখানেই। মনে রাখা জরুরি, সপ্তদশ শতাব্দীতে পঞ্চম দলাই লামার সময় থেকেই দলাই লামা ও পাঞ্চেন লামা পরস্পরের নির্বাচনের ব্যাপারে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে এসেছেন। ফলে একাদশ পাঞ্চেন লামা নির্বাচনের বিষয়ে চিন সরকারের সক্রিয়তার কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না।

প্রশ্ন হল, রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে তিব্বতকে জয় করার পরেও দলাই লামার নির্বাচন নিয়ে চিনের এত মাথাব্যথার কারণ কী? ১৯৫১ সাল থেকেই তিব্বত কার্যত চিনের অংশ। ১৯৫৯ সালে বর্তমান দলাই লামা তিব্বত ছেড়ে ভারতে চলে আসার পর থেকে তিব্বত দলাই লামার কর্তৃত্বমুক্ত। চিনের ভাষ্য অনুযায়ী, মধ্যযুগীয় তিব্বতে আধুনিকতার জয়যাত্রার শুরু। দলাই লামার ধর্মীয় পদ কমিউনিস্ট চিন সরকারের কাছে এখনও এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? আসলে, চিন তিব্বতকে রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে জয় করতে পারলেও সাংস্কৃতিক ভাবে আজও তিব্বত অপরাজিত। বিশ্ববাসীর মন ও মনন থেকেও তিব্বতের স্বাধীন অস্তিত্বের স্মৃতি ও কল্পনা মুছে দিতে ব্যর্থ হয়েছে চিন সরকার।

তিব্বতের ভূখণ্ডে চিন ‘আধুনিকীকরণ’-কে ত্বরান্বিত করতে চিনের সাধারণ অধিবাসীদের সেখানে স্থানান্তরিত করে তিব্বতিদের কার্যত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পর্যবসিত করেছে। মান্দারিন-চিনাকে সেখানকার নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভাষা করে তিব্বতি ভাষাকে অনেকটাই গৌণ করে তুলেছে। তবু কী আশ্চর্য, বিগত অর্ধশতকে বিশ্ব জুড়ে তিব্বতি ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ, তিব্বতবিদ্যার চর্চা বেড়েছে অনেক। তার সঙ্গে বিশ্বায়িত হয়েছে তিব্বতের স্বাধীনতার দাবিও। এই সবের প্রধান অনুঘটক একটি পদে আসীন এক জন— চতুর্দশ দলাই লামা।

১৯৫৯ সালে পূর্ব তিব্বতের খাম প্রদেশ-সহ অনত্র চিনের সংগঠিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক অসম যুদ্ধে তিব্বতি যোদ্ধারা যখন লড়ছেন, তখন বর্তমান দলাই লামার ভারতে চলে আসা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু দলাই লামা যদি তিব্বতেই থেকে যেতেন তা হলে চিনের পক্ষে তিব্বতের সার্বিক জয় যে অনেক সহজ হত, সে কথা আজ স্পষ্ট। তিব্বতের কথা আমরা হয়তো এত দিনে ভুলেই যেতাম। ভারতে দীর্ঘ নির্বাসনে থেকে তিব্বতের স্বাধীনতা বা পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জিইয়ে রাখাই শুধু নয়— তিব্বতের ভাষা-সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে সফল ভাবে পৌঁছে দিয়ে তিনি এক বিরল সাংস্কৃতিক যুদ্ধে তাঁর নৈতিক জয় প্রমাণ করেছেন।

চিন এখনও চায় আদর্শগত ভাবে তিব্বতকে বদলে দিতে। চিনা রাষ্ট্রের মূল সাংস্কৃতিক ধারায় তিব্বতকে মিশিয়ে দিতে। ঘোষিত ভাবে ধর্মে অবিশ্বাসী রাষ্ট্র হয়েও তাই তার নতুন নীতি ধর্মকে অস্বীকার করা নয়, বরং তা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে ফেলা। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের এক চৈনিক বিকল্পকে প্রতিষ্ঠিত করা। যাতে চিনের মাটিতে তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম বলে পৃথক বৌদ্ধধর্মের কোনও অস্তিত্বই না থাকে, চৈনিক বৌদ্ধধর্মের মধ্যে তা বিলীন হয়ে যায়। দলাই লামার প্রতিরোধ সেখানেই। স্বাধীন তিব্বতের স্মৃতির গণহত্যাকে তিনি রুখে দিয়েছেন। কাজেই পরবর্তী দলাই লামার পদে নিজস্ব প্রতিনিধি মনোনীত করে সেই স্মৃতির গণহত্যা সুনিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে চিন সরকার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India China Dalai Lama Tibet

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy