Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Saree

‘চিনে’ সুতোয় তাঁতের শাড়ি

জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ ব্লকের শুভ্রা ঝা-এর কাছে উপহার এসেছে অন্ধ্র থেকে, এক অনুপম তাঁতের শাড়ি। সেই শাড়ির গায়ে বাঁধা একটি ‘ট্যাগ’।

তাঁত।

তাঁত।

শৈবাল বসু
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৪১
Share: Save:

শরতের রোদ হেসে উঠলেই বাঁধা রিকশায় পেল্লায় পুঁটুলি নিয়ে এসে পড়তেন বসাকমামা। সেই আশ্চর্য পুঁটুলি থেকে বেরোত হাজার বুটির কলকা-পাড় নীলাম্বরী, চিরুনি ডুরে লাল-সবুজ গঙ্গাযমুনা পাড়ের শাড়ি, দিদিমার জন্য মনে করে নিয়ে-আসা কোরা জমির উপর কালো নরুনপেড়ে কাপড়। গোটা হলুদ, পান, কচি কলাপাতা, নিকোনো মাটির মতো রং হত সে সব শাড়ির— উজ্জ্বল, কিন্তু ক্যাটকেটে নয়। মিলের শাড়ি বলতে ছিল মিলের ছাপা শাড়ি। ‘পাওয়ারলুম’ শব্দটি সাধারণ বাঙালি ক্রেতার অভিধানে ছিলই না চার দশক আগে, যদিও ইতিহাস বলে, এ দেশে প্রথম যন্ত্রচালিত তাঁত বসেছে ১৯০৪ সালে, বাংলায় বিলিতি কাপড় বর্জন আন্দোলনের ঠিক এক বছর আগে। কিন্তু এই সে দিন অবধি যন্ত্রে বোনা হত প্রধানত থান, জামা-ট্রাউজ়ারস, পর্দা, এ সবের জন্য। শাড়ি ছিল ‘হ্যান্ডলুম’ বা হস্তচালিত তাঁতের আওতায়।

তার পর বদলেছে সরকারি নীতি, সুতির শাড়ি নির্মাণের জগৎ , কিন্তু বদলায়নি ক্রেতার ধারণা। জামদানি, বালুচরি, টাঙ্গাইল, ধনেখালি শাড়ি দেখে এখনও অধিকাংশ ক্রেতা ভাবেন, এ বুঝি হাতে-চালানো তাঁতে তৈরি। হ্যান্ডলুম বাঁচানো যাঁর জীবনের ব্রত, ও-পার বাংলার সেই লড়াকু মুখ বিবি রাসেল সখেদে বললেন, “পাওয়ারলুমের জামদানি দেখে আমার চোখে জল আসে। জামদানির বুনন পাওয়ারলুমে সম্ভবই নয়।” যেমন সম্ভব নয় ধনেখালির কোল আঁচলের বিশেষ বয়নের ধানের শিষের নকশা। হাতে-বোনা শাড়ির জমিতে হাত বুলিয়ে অনুভব করা যায় বুটি বা কল্কা, যা সম্ভব নয় যন্ত্রচালিত তাঁতে। ক’জনই বা সে খবর রাখেন?

তাঁতে বোনা সুতির শাড়ির জগতে আর এক নতুন বিপদ— বাম্পার সুতো। এ হল এক রকম কৃত্রিম সুতো, ‘চিনে সুতো’ বলেও তার পরিচয়। দাম নাগালের মধ্যে, কিন্তু সুতির কাপড়ে মিশেছে সিন্থেটিকের ভেজাল। রং চকচকে, সুতির স্নিগ্ধতা তাতে নেই। অনেক ক্রেতাই মননশীল— বাংলার ঐতিহ্য ভালবেসে হ্যান্ডলুম চান। অনেকে পরিবেশ-সচেতন বলে সুতির কাপড় বেছে নেন। অনেকে কিছু বেশি টাকা দিয়েও এমন কাপড় কেনেন, যাতে টাকা পৌঁছোয় গ্রামের বয়নশিল্পী, সূচিশিল্পীদের কাছে।

জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ ব্লকের শুভ্রা ঝা-এর কাছে উপহার এসেছে অন্ধ্র থেকে, এক অনুপম তাঁতের শাড়ি। সেই শাড়ির গায়ে বাঁধা একটি ‘ট্যাগ’। তাতে লেখা, শাড়িটি বুনেছেন গ্রামের বয়নশিল্পী পি আর রমেশ। বয়স পঞ্চান্ন বছর। লেখা আছে, এই শাড়িটি বুনতে রমেশের হাত মাকু টেনেছে ১৮,৪০০ বার। সরকারি বিপণন সংস্থা ‘অ্যাপকো’-র তরফে সেই ট্যাগে ছাপা রয়েছে ‘হ্যান্ডলুম মার্ক’। আর লেখা রয়েছে, শাড়িটি কিনে এক বয়নশিল্পীর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ‘অ্যাপকো’ ধন্যবাদ জানাচ্ছে। শুভ্রা এই তথ্য পোস্ট করেছেন সমাজমাধ্যমে। কিন্তু এখনও এটা ব্যতিক্রম।

হাতে একটি শাড়ি বুনতে যে সময় এবং শ্রম লাগে, সেই সময়ে তিনটি থেকে পাঁচটি শাড়ি বোনা হয়ে যায় পাওয়ারলুমে। যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে উচিত দাম না পেয়ে বহু তাঁতি হস্তচালিত তাঁত বেচে দিয়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। সম্ভবত সেই জন্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকার পাওয়ারলুম কেনার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। তাঁতশিল্পীদের সমবায় ‘তন্তুজ’-এর মাধ্যমে সুতো সরবরাহ করা হবে, এবং উৎপাদিত বস্ত্র কিনেও নেবে সংস্থা, বলছে প্রকল্প।

এ হয়তো সময়ের দাবি। কিন্তু বেদনা থেকে যায় সেই সব অনামা, অদেখা শিল্পীদের জন্য, যাঁরা বাংলার চিরায়ত বসনের শরীরে বাংলার গ্রাম, নদী, কৃষি সংস্কৃতির চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছেন কত যুগ ধরে। শাড়ির মূল দেহটি তাই বাংলা ভাষায় ‘জমি’ বা ‘জমিন’, নদীর অনুষঙ্গে বাংলার শাড়ির দু’পাশের রঙিন প্রান্তের নাম ‘পাড়’। বাংলার তন্তুবায় সমাজই ছিল ‘ডিজ়াইনার’— তাঁরা নকশা খুঁজে নিতেন পারিপার্শ্বিক ভুবন থেকে, জীবনযাত্রা থেকে। বসন, আভরণ, শস্য সব কিছুতে একে অপরের পরিচয় লেখা থাকত। তাই বাংলায় খইয়ের নাম ‘কনকচূড়’, হাতের বালার নকশার নাম ‘লিচুকাটা,’ ধনেখালি শাড়ি চেনা যায় ধানের শিষের নকশা দিয়ে। এই আমাদের সৌন্দর্যের উত্তরাধিকার, যা এত দিন নানা আঘাত সহ্য করেও বেঁচে থেকেছে। হস্তচালিত তাঁত থেকে যন্ত্রচালিত তাঁতে গিয়ে শিল্পী যদি হয়ে যান শ্রমিক, যদি কেবলই কোনও এক অদেখা-অচেনা ‘ডিজ়াইনার’-এর ছক অনুসারে কাপড় বুনে চলেন, তাকে কি উন্নয়ন বলা চলে?

আজকের ক্রেতার একটি বড় অংশ পরিধানের মান সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন, অনেক বেশি দাম দিয়েও তাঁরা পছন্দের ‘ব্র্যান্ড’-এর জামাকাপড় কেনেন। বাংলার তাঁতের শাড়ির সমস্যা এখানেই যে, তার বৃহত্তম অংশই কোনও বিশেষ ‘ব্র্যান্ড’-নামে বিপণন হয় না, ফলে খাঁটি না ভেজাল, ধরার উপায় থাকে না ক্রেতার। কী করে সম্পূর্ণ সুতি এবং হস্তচালিত তাঁতে তৈরি কাপড়ের অভিজ্ঞান নির্ধারণ করা যায়, সে সম্পর্কে সকলকে অবহিত করা যায়, তা স্থির করতে না পারলে হারিয়ে যাবে আমাদের আত্মপরিচয়। তাঁতির সঙ্গে তাঁতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হারিয়ে গেলে উৎপাদন হয়তো বাড়বে, হারিয়ে যাবে বাংলার সংস্কৃতির এক মৌলিক উপাদান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Saree Cotton Thread
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE