E-Paper

এই পদ্ধতি অগণতান্ত্রিক

ভোটপ্রচারে প্রার্থীরা জনতার প্রতি অগাধ আনুগত্য দেখান, অথচ আজ সেই জনতাকেই রাষ্ট্র সন্দেহের চোখে দেখছে। রাষ্ট্র তার নাগরিকের ভাল-মন্দের দেখশোনা করবে, এটাই স্বাভাবিক।

সাবির আহমেদ

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:০০
সংঘাত: বিহারে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের প্রতিবাদে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পোস্টার, ১ অগস্ট, নয়াদিল্লি।

সংঘাত: বিহারে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের প্রতিবাদে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পোস্টার, ১ অগস্ট, নয়াদিল্লি। ছবি: পিটিআই।

শারদোৎসব শেষ হলেই পশ্চিমবঙ্গে ‘এসআইআর’ প্রক্রিয়া চালু হতে চলেছে। সংবিধান ও ‘জনপ্রতিনিধি আইন’ অনুসারে এই প্রক্রিয়া চালানো নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব। বিহারে এসআইআর-এর কাজ শেষ হয়েছে, চূড়ান্ত ভোটার তালিকা থেকে ৪৭ লক্ষ ভোটার বাদ পড়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই কিছু নাম বাদ পড়তেই পারে, বিশেষত যখন কোভিডকালে মৃত্যুহার বেশি ছিল। কিন্তু প্রায় আধ কোটি মানুষ কী ভাবে বাদ পড়লেন, এবং সাধারণ নাগরিকরা কেন বিনা কারণে হেনস্থার শিকার হলেন, তাও ভাবা জরুরি।

ভোটপ্রচারে প্রার্থীরা জনতার প্রতি অগাধ আনুগত্য দেখান, অথচ আজ সেই জনতাকেই রাষ্ট্র সন্দেহের চোখে দেখছে। রাষ্ট্র তার নাগরিকের ভাল-মন্দের দেখশোনা করবে, এটাই স্বাভাবিক। অথচ রাষ্ট্র এখন নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে নাগরিকের উপরেই চাপ দেওয়ার নানা কৌশল নিচ্ছে। এমন নয় যে নির্বাচন কমিশনের তরফে প্রথম বার ভোটার তালিকা সংশোধন হচ্ছে, বার্ষিক প্রক্রিয়াতেই তা করা সম্ভব। তা হলে এ বার এত ঢাকঢোল পেটানো কেন? কেন এই প্রক্রিয়ায় এত বিপুল অর্থব্যয়?

যদি ২০২১ সালের জনগণনা যথাসময়ে সম্পন্ন হত, তা হলে ভোটার তালিকা সংশোধন অনেক সহজ হত। ভোটদানের যোগ্য নাগরিক নির্ধারণ ও তালিকা যাচাই— সবই নির্ভর করে তথ্যের উপর। কোভিডের অজুহাতে জনগণনা পিছিয়ে দেওয়া হলেও, তখনও নির্বাচন-সহ অন্যান্য কার্যক্রম চলেছে। তা হলে সেন্সাস হয়নি কেন? বরাদ্দ কমে গেল কেন? এ সব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই।

তথ্য সংগ্রহ ও এর ব্যবহার শাসনব্যবস্থার সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত। এ দেশে জনগণনার সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশদের হাত ধরে, শাসন ও নিয়ন্ত্রণের উপকরণ হিসেবে। আজও নির্বাচন কমিশনের এই রুটিন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক অভিসন্ধি। সীমান্তবর্তী রাজ্য যেমন অসম ও পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ঘণ্টা বাজলেই দিল্লির নেতাদের গলায় অনুপ্রবেশের আষাঢ়ে গল্প উচ্চগ্রামে ধ্বনিত হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বলেছেন, অনুপ্রবেশকারীদের নাম বাদ দেওয়ার লক্ষ্যের কথা। কিন্তু তথ্য ও যুক্তির নিরিখে অনুপ্রবেশের দাবি টেকে কি?

কেন্দ্রীয় সরকারই দেশের সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্বে থাকে। সরকার দাবি করছে, পরিকাঠামো ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, যেখানে কাঁটাতার নেই, সেখানে লেসার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। তা হলে কিসের ভিত্তিতে সেই সরকারই বলছে, দেশে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমানরা অবাধে অনুপ্রবেশ করে এ দেশে অবৈধ ভাবে বসবাস করছে? এ নিয়ে কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে কি? পার্লামেন্টে একাধিক বার স্বীকার করা হয়েছে, কত জন বাংলাদেশি বেআইনি ভাবে ভারতে আছে, তা সরকার জানে না। ‘পুশব্যাক’-এর সংখ্যাও অজানা।

যদি সত্যিই কোটি কোটি বাংলাদেশি ভারতে এসে থাকে, তা হলে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু ২০০১-২০১১’র সেন্সাস অনুযায়ী,জাতীয় গড় ছিল ১৭.৭%, অথচ পশ্চিমবঙ্গে তা মাত্র ১৩.৮%। একই ভাবে, জাল পরিচয়পত্র তৈরির অভিযোগও ভিত্তিহীন। ২০১১ সালের জনগণনায় পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ছিল ভারতের ৭.৫৫%, আর আধার (৭.৪১%), রেশন (৭.৪৬%) ও ভোটার (৭.৭৭%) কার্ডের হারও প্রায় সমানুপাতিক। ভোটার সংখ্যা সামান্য বেশি হওয়ার কারণ হল রাজ্যে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার অনুপাত তুলনামূলক ভাবে বেশি।

সিদ্ধান্ত করা কঠিন নয় যে, অনুপ্রবেশের আতঙ্ক ও জাল পরিচয়পত্রের অভিযোগ— দু’টিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন। বাংলাদেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীক্ষমতায়নে অনেকটাই এগিয়ে, ফলে সেখান থেকে ভারতে বসবাসের প্রবণতা এমনিতে কমে আসছে। অথচ অনুপ্রবেশ নিয়ে উচ্চগ্রামে প্রচার চলছে।

কবির মতো ‘নামে কী আসে যায়’, এই বিলাসিতা আজকের ভারতের নাগরিকদের জন্য আর সহজলভ্য নয়, বিশেষ করে আপনি যদি কোনও বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হন। যে কোনও ভাবে আপনাকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলবেই। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, বিশেষত সংখ্যালঘু, জনজাতি ও দলিত গোষ্ঠীর মানুষের নাগরিকত্ব প্রমাণের দলিল ও শংসাপত্র নানা কারণে অবিন্যস্ত।

দুই দশক আগেও গ্রামের সচ্ছল পরিবারে জন্ম-শংসাপত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতনতা ছিল না। অধিকাংশ শিশুর জন্ম বাড়িতেই হত, বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় শিক্ষক— প্রধানত উচ্চবর্গীয়— নিজের মতো করে নাম ও বাবার নাম খাতায় লিখে দিতেন। কোথাও ‘মহঃ’, কোথাও ‘মহাম্মদ’ বা ‘মোহাম্মদ’ লেখা হত। বাঙালি মুসলমানদের পদবির বানানেও চিরকাল নানা রকমফের— মণ্ডল, মিদ্যা, মল্লিক, লস্কর— যা বাংলা ও ইংরেজিতে ভিন্ন ভাবে লেখা হয়ে থাকে।

এই বিভ্রাট যে মধ্যবয়সে এসে নাগরিকদের এতটা ভোগাবে, কেউ কল্পনাও করেননি। বাংলার প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু মানুষদের এক বড় অংশ গ্রামে থাকেন, যাঁরা বার বার বন্যায় সর্বস্ব হারান। মুর্শিদাবাদ বা মালদহে নদীভাঙনে পুরো গ্রামই নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে এ বারও। এই বাস্তব অগ্রাহ্য করে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের নামে তাঁদের উপর সন্দেহের ছায়া ফেলা এক নির্মম রাজনৈতিক কৌশল।

চাচির হাত ধরে প্রাণে বাঁচলেও, চাচার এক ছটাক জমির দলিল আর আধার কার্ড বন্যায় ভেসে গেছে। চাচার ছেলে কেরল থেকে ফিরে পনেরো দিন ধরে নতুন কাগজের জন্য দৌড়ঝাঁপ করে কিছু না পেয়ে আবার কাজের খোঁজে পাড়ি দিয়েছে। এসআইআর হলে কী কাগজ জমা দেবেন, তা নিয়ে চাচার ঘুম নেই, কারণ ভোটার তালিকায় কলিম চাচার নাম এখনও ‘কালু মিয়াঁ’ রয়ে গেছে। জীবনের অনেক বছর তিনি ভোট দিয়েছেন, কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। বরং ভোটের দিন পাড়ার নেতারা ভ্যানে করে নিয়ে গেছেন, ফিরতে মুড়ি-শসা সহযোগে দুপুরের খাবারও মিলেছে। আজ তাঁকেই আবার প্রমাণ দিতে হবে, তিনি সত্যিই ভোটার কি না।

বিহারের এসআইআর অভিজ্ঞতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ভোটারদের জন্য নির্ধারিত যোগ্যতার শর্ত পূরণ করতে না পারায় সংখ্যালঘু, নারী, দরিদ্র, তফসিলি জাতি, জনজাতি ও পরিযায়ী শ্রমিক ভোটাররাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কেরল বিধানসভা সর্বসম্মত ভাবে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত এসআইআর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আপত্তিজানিয়েছে। বিধানসভা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, এই প্রক্রিয়া জনগণের ভোটাধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই প্রস্তাবের মতো এই রাজ্যের শাসক দল রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাব গ্রহণ করে দাবি জানাক, ভোটার তালিকা যেন ন্যায়সঙ্গত ও স্বচ্ছ ভাবে প্রকাশ করা হয়।

অর্থাৎ, এই পদ্ধতি যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কার্যকর করার একটি পরোক্ষ উপায়, তা রাজ্যের শাসক দল এবং দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষদের বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে। নাগরিকদের সুবিধার কথা ভেবে যে এগারোটি নথির উল্লেখ ছিল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তার সঙ্গে আধারও যুক্ত হয়েছে, এই নিয়ম যেন পশ্চিমবঙ্গেও বলবৎ হয়।

এ ছাড়া নামের ভুলের ক্ষেত্রে যে নামটি সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়েছে, তা গ্রহণ করতে হবে। যাঁদের পুরনো বা বিকল্প নথির হদিস রয়েছে, তাঁদের নিজের ঘোষণাকেও মান্যতা দিতে হবে। এই ন্যায্যতা ও মানবিকতা ছাড়া ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া নাগরিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হবে।

তথ্য-যুগে নাগরিক নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত। আধার, এনআরসি, এসআইআর— সবই নাগরিককে তথ্যের জালে আবদ্ধ করছে। রেলটিকিট, ব্যাঙ্ক, সরকারি প্রকল্প, সব জায়গায় আধার বাধ্যতামূলক, অথচ নাগরিককে বার বার প্রমাণ দিতে হচ্ছে, তিনি এই দেশেরই মানুষ।

সোজা কথাটা সোজা করে বলা দরকার। এসআইআর ও জনগণনার বিলম্ব মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, ভারতীয় রাষ্ট্র আজ প্রকাশ্যে নাগরিককে হেনস্থা করছে, যা গণতন্ত্রের সরাসরি পরিপন্থী।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Election Commission Citizenship

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy