Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সৃষ্টির নিহিত প্রতিবাদ
Literature

বিশ্বময় শিল্প-সাহিত্যে প্রতিরোধ আর নৈঃশব্দ্যের রাজনীতি

বাংলার বৈষ্ণব পদকর্তারা কালো রংকে যে ভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন, ভারতের আর কোথাও সে ভাবে দেওয়া হয়নি।

বিপ্লব: ফ্রান্সে রাজতন্ত্রী ও শ্রমিকের দ্বৈরথ। জুলাই, ১৮৩০।

বিপ্লব: ফ্রান্সে রাজতন্ত্রী ও শ্রমিকের দ্বৈরথ। জুলাই, ১৮৩০। গেটি ইমেজেস।

তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৪:৩৭
Share: Save:

ইদানীং বিশ্ববিদ্যা বা গ্লোবাল স্টাডিজ় বিদ্যাচর্চার খুব জনপ্রিয় একটি শাখা হয়ে উঠেছে। বিশেষত ভারতের মতো বিশ্বের পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব গোলার্ধের ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে। এর উদ্দেশ্য পশ্চিমি জ্ঞানচর্চায় এই সব দেশের প্রান্তিক ও উপেক্ষিত জ্ঞানভান্ডার বা অভিজ্ঞতা-পরম্পরাকে বিশ্বের দরবারে পেশ করা ও সমগোত্রীয় মূলধারার জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত করা। তার ফলে প্রান্তিক জ্ঞানচর্চা তো উপকৃত হবেই, একমাত্রিকতার দোষে দুষ্ট মূলস্রোতের বিদ্যাক্ষেত্রও কলঙ্কমুক্ত হবে। পরিশেষে প্রান্ত ও মূলস্রোতের মধ্যে বিভেদ মুছবে।

ফরাসি দার্শনিক জিল দ্যল্যোজ় ১৯৮৪-র মার্চে তাঁর এক বক্তৃতায় নান্দনিক কর্মের স্বরূপ প্রসঙ্গে বলেন, যে কোনও সৃষ্টিকর্ম আসলে এক ধরনের প্রতিরোধ— ক্ষমতার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, নান্দনিক ক্রিয়া মানেই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে যেখানেই রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, সেখানেই চিন্তাশীলদের নান্দনিক বা বৌদ্ধিক প্রতিরোধ। ধর্ষকামী রাষ্ট্র তাই বহু ক্ষেত্রে ‘শহুরে নকশাল’-এর মতো অসার শূন্যগর্ভ অভিধা গায়ে দাগিয়ে, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বা হুমকি দিয়ে এঁদের মুখ বেঁধে রাখার বৃথা চেষ্টা করেন।

এর ভূরি উদাহরণ এ কালের মতো সে কালেও ছিল। এ ব্যাপারে ‘উন্নত’ ইউরোপ ও ‘অনুন্নত’ মধ্যযুগীয় বাংলার মধ্যে বিশেষ কোনও তফাত নেই।

আগেই উল্লিখিত হয়েছে সৃষ্টিকর্মে নিহিত প্রতিরোধ-প্রবণতার কথা। এই প্রবণতার দু’টি উদাহরণ পেশ করব এখানে। পূর্বের ও প্রতীচ্যের দুই অন্ধকারের মধ্যে আলো বিনিময় করব। একটির কালখণ্ড ১৮৪৮-এর পরবর্তী সময়, অকুস্থল ইউরোপের মূল ভূখণ্ড, তথাকথিত এক ‘উন্নত’ সমাজ। অন্য ‘ঘটনার’ কালখণ্ড বাংলার মধ্যযুগ। উল্লেখ্য, এই ‘ঘটনা’ শব্দটি আমরা দুই অর্থেই ব্যবহার করছি। একটি সাধারণ ঘটনা অর্থে, আর একটি ‘অসাধারণ’ ঘটনা অর্থে, অর্থাৎ সৃষ্টির বা নতুনের আবিষ্কার ও উদ্বোধনের ঘটনা অর্থে।

উনিশ শতকের প্রথমাংশ জুড়ে ফ্রান্স শ্রেণিসংগ্রামে উত্তাল হয়েছিল। ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লবের ছায়ায় ১৮৩০-এর জুলাই মাসে ফ্রান্সে তিন দিন ব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে ব্যবসায়ী ও কলকারখানার মালিকদের পাশে ও নেতৃত্বে শামিল হন শ্রমিকেরা। রাজার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার নতুন এক উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয় মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া জনগণের মনে। এই বিপ্লবের ফলে পুরনো জমানা, ‘রেস্টোরেশন’-এর অবসান হয় এবং সূচনা হয় জুলাই রাজতন্ত্রের নয়া যুগ। তার পর ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর আবার পটপরিবর্তন। জুলাই রাজতন্ত্রের অবসান ও দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের সূচনা। তার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মালুম হয়, শ্রমিক শ্রেণির ঘাড়ে চেপে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসে তাঁদের সঙ্গেই বেইমানি করেছে। শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে সমাজবাদীরা আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁদের উপর নামিয়ে আনল ভয়াবহ সন্ত্রাস। শুরু হল এক নয়া শাসনব্যবস্থা, ‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য’ নামে ইতিহাসের বইয়ে যার খ্যাতি। কার্ল মার্ক্সের দি এইট্টিন ব্রুমেয়ার বইতে এই পর্বের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। নেপোলিয়ঁ বোনাপার্তের ভ্রাতুষ্পুত্র লুই বোনাপার্তের এই আমলে বাক্‌স্বাধীনতার উপর আঘাত নেমে এল, সংবাদপত্রের উপর নেমে এল নিষেধাজ্ঞা, রাজরোষে ভিক্তর উগো-র মতো জাতীয় কবিকে নির্বাসিত হতে হল। ১৮৪৮-এর জুনের সেই ভয়াবহ গণহত্যা, মানব-ইতিহাসে নিষ্ঠুরতার নিরিখে বিরলতম ঘটনার একটি। যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে একমাত্র অউশভিৎজ়-এর।

মজার কথা হল, এই হিংস্রতার অভিঘাতে সাহিত্যে শিল্পে জ্ঞানচর্চায় এক নতুন যুগ প্রবর্তিত হল। পুরনো জমানার মৃত্যু হল। গুস্তাভ ফ্লব্যের, শার্ল বোদল্যের, কুরবে প্রমুখ ঔপন্যাসিক, কবি ও শিল্পীরা উঠে এলেন নতুন এক ভাষা ভাবনা ও কল্পনা নিয়ে। সংস্কৃতিতে এমন এক যুগের সূচনা হল যাকে নাম দিতে পারি ‘আধুনিক’ যুগ। শিল্প-সাহিত্য-কাব্যে যার জের বোধ হয় আজও অব্যাহত। ফ্লব্যের-এর উপর তাঁর যুগান্তকারী কাজে জঁ পল সার্ত্র বলছেন, ১৮৪৮ জুন-পরবর্তী সময়ে “যে ভাবজগতের সূত্রপাত হবে, তা শুধু কিছু বিমূর্ত ধারণা দিয়ে তৈরি না। ঐতিহাসিক এক গণহত্যা থেকে তার জন্ম। ওই গণহত্যাকে নিজের ভিতর ধারণ করেছে সে, নিজের মধ্যে তাকে আত্তীকৃত করেছে।”

ক্ষমতাকে সমালোচনা করলেই রাজরোষ। তাই ১৮৪৮-এর সাহিত্য ও শিল্প আগাপাছতলা অরাজনৈতিক হয়ে পড়ল। রোম্যান্টিকদের মতো সমাজমুখী না, নব্য সৃষ্টিশীলেরা কলাকৈবল্যবাদের ভক্ত হয়ে উঠলেন। অথচ, তাঁদের সৃষ্টিকর্মের নীচে শতধারায় প্রবাহিত হতে লাগল এক অবদমিত রাজনৈতিক বয়ান— যাকে বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। এই ভাবে কাব্যে সাহিত্যে গূঢ় ইঙ্গিতে কথা বলার চল শুরু হল। আজকের আধুনিক কবিতার ভাষায় যে গূঢ় অনচ্ছতা, তার সূত্রপাত সেই থেকে।

ফ্লব্যের-এর মাদাম বোভারি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার উপসংহারে বোদল্যের বলছেন, “আমি সর্বোপরি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই আগাগোড়া এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে যা বয়ে গিয়েছে সেই মর্ষকামী ক্ষমতার দিকে, অন্তঃসলিলা, বিদ্রোহী, সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন খনি যা আলো দেয়— ইংরেজরা যাকে ‘সাবকারেন্ট’ বলে— তালগোল পাকানো একাকিত্বের বিশৃঙ্খলা ভেদ করে যা আমাদের পথ দেখাবে।” এই ‘সাবকারেন্ট’-এ ভর করেই এই ‘ঘটনা’র প্রায় হুবহু প্রতিধ্বনি খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলার মধ্যযুগে, বৈষ্ণব সাহিত্যে। “কালো জল ঢাল্‌তে সই কালো পড়ে মনে,/ দিবানিশি দেখি কালা শয়নে স্বপনে/ কালো চুল এলাইয়া বেশ নাহি করি,/ কালো অঞ্জন আমি নয়নে না পরি।”(চণ্ডীদাস)

কৃষ্ণের গাত্রবর্ণ ভারতের সর্বত্রই সুপরিচিত। কিন্তু বাংলার বৈষ্ণব পদকর্তারা কালো রংকে যে ভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন, ভারতের আর কোথাও সে ভাবে দেওয়া হয়নি। এর পিছনে এক ঐতিহাসিক কারণের কথা বলেছেন দীনেশচন্দ্র সেন। সেও এক নৈঃশব্দ্যের রাজনীতি।

মধ্যযুগে বৈষ্ণবধর্মের উপর নেমে আসে নৃশংস আক্রমণ, হিংস্র রাজরোষ। কোনও বৈষ্ণব সন্দর্ভ উচ্চৈঃস্বরে সেই নির্যাতনের ইতিবৃত্ত নথিভুক্ত করেনি। কিন্তু সময়ের পদচিহ্ন এড়ায় কে! পরবর্তী কালে বৈষ্ণব উপাসকরা মূর্তিকে বাদ দিয়ে এই কালো রংটিকেই পুজো করতে শুরু করলেন মূর্তিজ্ঞানে। কালো র‌ং হয়ে উঠল বিষ্ণুর প্রতীক। “বস্তুতঃ যদিও কৃষ্ণের কালোবর্ণের কথা অনেক পুরাণে উল্লিখিত আছে কিন্তু বাঙ্গলায় এই বর্ণটি বিশেষ ভাবে ভগবানের স্মারক হইয়া পড়িয়াছিল। চৈতন্যের পূর্ব্বে মাধবেন্দ্র পুরী কালোমেঘ দেখিলে মূর্চ্ছিত হইতেন। কৃষ্ণপ্রস্তরনির্ম্মিত শত শত বাসুদেব মূর্ত্তি অত্যাচারীর কুঠারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়াছিল, প্রাণপণ করিয়াও এই সকল বিগ্রহ পূজারীরা রক্ষা করিতে পারেন নাই। বাঙ্গলার এক পুকুরে দেখা গিয়াছিল— এক ভগ্ন কৃষ্ণ প্রস্তরের বাসুদেবকে কতকগুলি নরকঙ্কাল জড়াইয়া ছিল, অত্যাচারীরা বিগ্রহরক্ষাকল্পে যে সকল পুজারী প্রাণান্ত চেষ্টা করিয়াছিল, তাঁহাদের শবদেহ সহ মূর্ত্তি পুকুরে ফেলিয়া দিয়াছিল। মন্দির শ্রীবিগ্রহশূন্য হইলে কৃষ্ণ-মূর্ত্তি জগতের সর্ব্বস্থান হইতে ভক্তদের চোখে ধাঁধাঁ দিয়া তাঁহাদিগকে মুগ্ধ করিল, তাঁহাদের প্রাণের দরদে আঁকা কৃষ্ণমূর্ত্তি নব মেঘে বিরাজিত হইতেন, নীলাঞ্চলেও সেই রূপ প্রতিভাত হইত, কালো যমুনার জলে সে রূপ ঝলমল করিয়া উঠিত। ভক্ত-প্রাণে তাঁহাদের মন্দিরের আরাধ্য দেবমূর্ত্তি বড় দাগা দিয়া গিয়াছিল; এজন্য জগতের যেখানে কালো বর্ণ দেখিতেন, সেইখানে তাঁহারা প্রিয়তম দেবতাটিকে মনে করিতেন”। (পদাবলী-মাধুর্য্য/ দশম পরিচ্ছেদ/ দীনেশচন্দ্র সেন)

ফ্রয়েড বলেছেন, অবদমনের ফলে নানাবিধ উপসর্গের প্রাদুর্ভাব। উপসর্গ মানে অবদমিত মনের কথা অন্য ভাষায় প্রকাশ পাওয়া। ঘটনা হল, প্রান্তিক বৈষ্ণব পদাবলির এই অবদমন এবং সেই অবদমনজাত আনুসঙ্গিক উপসর্গ (কালো রং) আমাদের সামনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন সে প্রতীচ্যের মূলধারায় আর এক অবদমনের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।

এবং আমরা, বাঙালিরা, বাংলাভাষীরা, হয়তো বৈষ্ণব সাহিত্যের এক খিড়কি দিয়ে পৌঁছে যেতে পারি ইউরোপীয় আধুনিকতার প্রধান ফটকের সামনে। নতুন করে বুঝে নিতে পারি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত প্রতিরোধের ভাষাবিশ্বকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Literature Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE