বইমেলা যাচ্ছেন? যাচ্ছি বইকি। কত বন্ধুর সঙ্গে দেখা, কত হাসি-গল্প — “মাস্ক পরে আছিস তো কী, ঠিক বুঝেছি ওটা তুই!” দেখা না হলে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের যোগ হবে কী করে। দেখছি, যে আত্মীয়-বন্ধুরা পুজোর মণ্ডপ এড়িয়ে চলেছেন, বড়দিনের ভিড় দেখে ভুরু কুঁচকেছেন, তাঁরাও বইমেলায় আসছেন। চা খাওয়ার সময়ে মাস্ক নেমে যাচ্ছে, গল্প থামছে না। সমাজের সেরা বুদ্ধিজীবীরাও ‘সামাজিক দূরত্ব’ আপাতত মুলতুবি রেখেছেন বলেই মনে হচ্ছে।
এই ভিড়ে তাঁরা কোথায়, যাঁরা সেন্ট্রাল পার্কের বইমেলায় ছিলেন ২০২০ সালের বসন্তেও, এ বার আর নেই? মফস্সল থেকে যাঁরা ট্রেন ধরে আসতেন, বাসের ঠাসাঠাসি ভিড় অগ্রাহ্য করে বইয়ের প্যাকেট নিয়ে ফিরতেন বাড়িতে, কিংবা নিজের গাড়িতে সপরিবারে আসতেন বইয়ের উৎসবে, তাঁরা অনেকে অকালে খেলা শেষ করে বিদায় নিয়েছেন। তাঁদের প্যাকেটবন্দি দেখিয়েই সকলে বলাবলি করেছি, “বেরিয়ো না যেন, অন্যের থেকে দূরে থাকো।” দু’বছর আমাদের মৃত্যুর সঙ্গে সহবাস চলছে। একদম সুস্থ মানুষ যে কিনা সকালেও বাজার করে এল, রাত থেকে ঘুষঘুষে জ্বরের সঙ্গে খুকখুক সর্দিকাশি। দু’দিন পর বেমালুম স্বাদ গন্ধ বেপাত্তা। হঠাৎ করে প্রাণবায়ুতে টান। ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফটাতে ছটফটাতে মারা যাচ্ছে লোকজন। একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার পেতে মানুষ তখন সর্বস্ব দিয়ে দিতে রাজি। আত্মীয়-পরিজন, স্বল্প পরিচিতদের মৃত্যুর খবর আসছিল একের পর এক। টিভির খবর শুনতে, কাগজ খুলতে আতঙ্ক।
অচেনা কিছু মানুষ যেন মৃত্যুর সূত্রে আপন হয়ে উঠল, বুকের ভিতর চিরকালের জন্য সেঁধিয়ে গেল। যেমন বারো বছরের মেয়ে জামেলা, যে তেলঙ্গানা থেকে ছত্তীসগঢ় হেঁটে এসে বাড়ি থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে মারা যায়। কলকাতার বইমেলায় সে হয়তো কোনও দিন পৌঁছত না, কিন্তু মেলার স্টলে কফিতে চুমুক দিয়ে মনে হয়, কেমন আছে এখন জামেলার পরিবার? তার বাবা, মা এখনও কি বুক চাপড়ে কাঁদেন! না কি এই দেড়-দু’বছরে কন্যাশোকের থেকে আরও কঠিন কোনও কষ্টের মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা?
ছাবু মণ্ডল লকডাউন শুরু হওয়ার পর বেকার হয়ে যান। বিহারের মাধোপুরা ফিরে এসেছিলেন এই পরিযায়ী শ্রমিক। কাঠবেকার হয়ে যাওয়ার পর সম্পত্তি বলতে ছিল শুধু একটা মোবাইল ফোন। আড়াই হাজার টাকায় সেটি বিক্রি করে বৌয়ের হাতে টাকাটা দিয়ে ঘরে গিয়ে গলায় ফাঁস দেন। সেই আড়াই হাজার টাকা থেকে সুরতহাল, দাহকার্য সব সেরে ছাবুর স্ত্রীর হাতে আর কত টাকা ছিল! ছোট ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে তাঁর কী হল, কোনও পত্রিকার বইমেলা সংখ্যায় সে খবর নেই।
খুব মনে পড়ছে বীরভূম সদর হাসপাতালের ডাক্তারবাবু অমল রায়ের কথা। গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে সারা দিনরাত হাসপাতালে ঘুরতেন, ডিউটি সময়ের বাইরেও। কোনও পেশেন্ট কাতরাচ্ছে দেখলেই ছুটে যেতেন তাঁর কাছে, ‘নিজের পেশেন্ট’ না হলেও। সেই ‘গরিবের ভগবান’ ডাক্তারবাবু কোভিডের বলি হলেন। তাঁর পরিবারের মানুষগুলো কেমন আছেন, আমরা কি জানি! তাঁরা কি নতুন বইয়ের পাতায় মন দেওয়ার মতো মনের জোর ফিরে পেয়েছেন?
তবুও জীবনের নিয়ম— যে নেই, তার জন্য কেউ থেমে থাকে না। এক দুঃখের উপর প্রলেপ দেয় আনন্দ, আবার তার উপর আসে নতুন দুঃখ। মৃত্যুভয়ের মধ্যেও কোথাও একটা সেই অনিবার্যতার বোধ কাজ করে, তাই শোক-আতঙ্ক ঠেলে এগিয়ে যেতে চায় মানুষ। কোভিডের প্রথম, দ্বিতীয় ঢেউয়ের করাল রূপ দেখেও আমরা দেখি পুজো, বড়দিনের উৎসবে মানুষের ঢল, গঙ্গাসাগরে স্নানযাত্রায় বিপুল লোকসমাগম। সুযোগ পেলেই একটু উৎসব যাপন করে বাঁচার আনন্দ পাওয়ার আকুল বাসনা।
মনে খচখচ করে এই চিন্তাটা— যাঁদের ‘কোভিড শহিদ’ বলে এত সম্মান জানাল এই শহর, এই দেশ, তাঁদের পরিবার বইমেলার ভিড় দেখে কী ভাবছেন? বিশেষত সবাই যখন জানি, করোনাভাইরাস যাওয়ার নয়, বার বার তার ঢেউ আসবে। মারি নিয়ে ঘর করছি আমরা, আক্ষরিক অর্থেই। বহু দিন পরে যাকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরছি, হয়তো তারই মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে দায়ী হয়ে যাচ্ছি। আমার দেহ আমার অলক্ষে কত পরিচিত-অপরিচিতকে বিপন্ন করছে। তা হলে মেলায় আসা কেন?
আবার ভাবি, সবার থেকে দূরে থাকা, ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকাও কি এক রকম মৃত্যু নয়? যাঁরা আমাদের বাঁচাতে প্রাণ দিলেন, সেই ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, পরিবহণকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, তাঁরা কি আমাদের আনন্দহীন, সম্পর্ক-বিচ্ছিন্ন জীবন চেয়েছিলেন? বইমেলায় এসে নতুন, রঙিন বই হাতে পেয়ে শিশুর হাসিমুখ, প্রতিবাদী রাজনীতির বইয়ের উদ্বোধনে উত্তেজনা, সাহিত্য-সঙ্গীত-সুস্বাদু খাবারের উদ্যাপন, এগুলোও তাঁদের আত্মত্যাগের সার্থকতা কোথাও বহন করে নিশ্চয়ই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy