পানীয় জলের দাবিতে বিক্ষোভরত জনতাকে জলকামান দিয়ে বাগে আনার চেষ্টা দিল্লি পুলিশের। সাম্প্রতিক খবরটিতে রাজধানীতে জলসঙ্কট এবং জলের অপচয় ও উপস্থিত বুদ্ধির অভাব স্পষ্ট। দিল্লিবাসী পথে নেমেছেন বাসনকোসন নিয়ে। আকাশছোঁয়া দামে পানীয় জল কিনছেন। সমস্যার সাময়িক সমাধান হলেও তা আশাপ্রদ নয়।
পুরনো হয়নি চেন্নাইয়ের জলকষ্টের ছবিও। রাজস্থান, গুজরাতের গ্রামগুলির অবস্থাও শোচনীয়। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরে দেশের খরাপ্রবণ রাজ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২২%। কারণ, রোজ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে জল আনতে যায় পড়ুয়ারা। পাছে সেই কাজে বাধা পড়ে, তাই একটু বড় হতেই মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ, জল আনতে যাওয়া শুরু। এই জলকষ্টের মাঝেই এসে হাজির করোনা। ফোনে, রেডিয়োয়, টিভি খুললেই ‘হাত ধোয়ার বিজ্ঞাপন’। যে দেশে পানীয় জল নেই, সে দেশে বারে বারে হাত ধোয়া, সাবানজলে কাপড় কাচার জল পাবে কোথায় মানুষ?
চার সদস্যের পরিবারে রোজ প্রায় ২০০-২৫০ লিটার জল খরচ হয়। এক টয়লেট ফ্লাশেই প্রায় ৯-১১ লিটার জল বেরিয়ে যায়। রয়েছে কাচাকুচি, রান্না, স্নান, ঘর মোছার মতো ঘরকন্না। কৃষিক্ষেত্রেও জলের খরচ কম নয়। ভূগর্ভস্থ জল ফুরিয়ে আসছে। নলকূপ, পাতকুয়ো— পড়ে রয়েছে শুকনো। নিঃশেষিত ‘অ্যাকুইফার’ সেচে জল তুললেও মিলছে আর্সেনিক। জলকষ্ট ছাড়াও, জলাভাবে আনুষঙ্গিক বৃহত্তর সমস্যাও জুটছে। ইউনিসেফের জার্নাল অনুযায়ী, ২০২৫-এই বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ জলসঙ্কটে ভুগতে শুরু করবেন। অর্থাৎ, অতিমারি অতিক্রান্ত হওয়ার অপেক্ষাই শেষ নয়, এর পরে মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা হবে পানীয় জলের অভাব। জল না মিললে সোনার ফসল কি আর ফলবে? আসবে খাদ্যসঙ্কট। দেশের রুজি কৃষিনির্ভর, কৃষিতে টান পড়লে অর্থনৈতিক উন্নতিতেও টান পড়বে। তা হলে উপায়?
উপায় আছে প্রকৃতিতেই। প্রয়োজন সুচারু পরিকল্পনার। ব্যাপক হারে ‘রেনওয়াটার হারভেস্টিং’ শুরু করতে হবে রাজ্যগুলিতে। ক্রান্তীয় অঞ্চলের এই দেশে বৃষ্টির অভাব নেই। প্রায় অর্ধেক বছর ভালই বৃষ্টি পায় মহারাষ্ট্র, কেরল, কর্নাটক থেকে মেঘালয়, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ তথা অন্যান্য রাজ্য। সেই জল ধরে রাখলেই সমস্যা থেকে অনেকটা রেহাই মেলে। বৃষ্টির জল সংগ্রহের মাধ্যমে নিঃশেষিত ভূগর্ভস্থ জল আবার পূর্ণ করা যেতে পারে, বাড়িতেও জল সঞ্চয় করে ঘরকন্নার কাজে লাগানো যায়।
কিন্তু বৃষ্টির জল সংগ্রহ করা বিষয়ে প্রচার ও পরিকল্পনা করলেই তো হবে না, তার প্রয়োগ দরকার। ওড়িশা সরকারের ‘ক্যাচ দ্য রেন’ যোজনায় ৭৫ দিনের মধ্যে ‘মুখ্যমন্ত্রী কর্ম তৎপর অভিযান’-এর সহায়তায় রাজ্যে প্রায় ১০,০০০ ‘রেনওয়াটার হারভেস্টিং স্ট্রাকচার’ তৈরি করা হয়েছে। আরও কাঠামো তৈরি করা চলছে। গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১৪০০-১৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টি পায় ওড়িশা। সেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য রাজ্যের পার্ক, বিভিন্ন সংস্থার ছাদ, পরিত্যক্ত জমিকে ‘ক্যাচমেন্ট এরিয়া’ করেছে ওড়িশা সরকার। দেখা যাচ্ছে, এই বৃষ্টির জলে ১১৪টি শহর উপকৃত হবে। এই প্রক্রিয়ায় যে জল সংগ্রহ হচ্ছে, তা রাজ্যবাসীর কাজে লাগানোর পরে অতিরিক্ত জল ফিরিয়ে দেওয়া হবে ভূগর্ভে। ফলে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর বাড়ানোর চেষ্টাও থাকবে।
রাজ্যগুলি ওড়িশার যোজনাকে মডেল ধরে এগোতে পারে। প্রায় ওড়িশার সমানই বৃষ্টি পায় এ রাজ্য, কিছু ক্ষেত্রে বেশিও। ফলে রাস্তায় জল জমার সমস্যাও লেগে থাকে। বৃষ্টির জল সংগ্রহ করলে তা থেকে অব্যাহতি মেলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যেও বৃষ্টির জল সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সে সংখ্যা কম। শহরের বহুতলগুলিতে সুইমিং পুল ও জিম তৈরির বিপুল খরচের একাংশ ধার্য করলেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা সম্ভব। সেই জল আবাসিকরা দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতে পারবেন, রাস্তায় জল জমার সমস্যাও কমবে। পরিকল্পনা করে এগোলে রাজ্যের বাড়িগুলিতেও প্রকল্পটি চালু করা যায়। কিন্তু, আগে সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো জরুরি।
জলই জীবন— এর চেয়ে বেশি সাদামাটা সত্য পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। সেই জলের অপব্যয় রুখতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর রোগের সঙ্গে যুঝতে হতে পারে। জলাভাবের সঙ্গে বাড়ছে জলদূষণও। জলবাহিত রোগের আশঙ্কাও রয়েছে। রোগবালাই তো নাহয় পরের কথা, শুধুমাত্র পানীয় জলের অভাবই কি যথেষ্ট কষ্টদায়ক নয়? বাড়িতে জল সরবরাহ বন্ধ হলেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে সকলের কপালে। আগে থেকেই জল ভরে রাখা হয় স্বভাববশে। তেমনই পৃথিবীর জলসঙ্কটের সঙ্গে যুঝতে জল ভরে রাখার ব্যবস্থা করলে ক্ষতি কি? প্রতিবেদনের পাতায় জলকষ্ট নথিভুক্ত করে না রেখে তা অক্ষরে অক্ষরে বোঝার চেষ্টা করলে সমূহ ক্ষতি রোখা যেতে পারে। নয়তো, মনুষ্যজাতি ভূগোলেতে গোল পেয়েই হয়তো মুছে যাবে বিশ্বসংসার থেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy