জঙ্গলে হাতির মূল কাজ খাওয়া। যত ক্ষণ জাগবে, ৮০% সময়ই খাবে। তার দেহের জন্য প্রতি দিন ৮০০০০ ক্যালরি খাবার প্রয়োজন। অন্তত ১৫০ কিলোগ্রাম খাবার থেকে এই শক্তি মিলবে। তার জন্য জঙ্গলে ষোলো ঘণ্টা ধরে হেলেদুলে ঘুরে বেড়ায়। এই সময় সে ঠিক কী খায় আর কী খায় না, তা কিন্তু নিশ্চিত নয়। কারণ, বন্যপ্রাণকে কাছাকাছি গিয়ে টানা পর্যবেক্ষণ অসম্ভব। জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘মেগাহার্বিভোরাস’ এই প্রাণী ঝোপঝাড়, ঘাস-পাতা, ফল-মূল, ডালপালা থেকে গাছের বাকলও খেয়ে নেয়। তবে, হাতিদের পাচনতন্ত্র দুর্বল। যা খায় তার মাত্র ৪৪% হজম হয়। ফলে জঙ্গলে হাতির বর্জ্য বিরল নয়। এই বর্জ্যের মধ্য দিয়েই সে বিভিন্ন বীজ জঙ্গলে ছড়িয়ে দেয়, এতে, গাছের বংশবৃদ্ধি হয়, জঙ্গল বাড়ে, ঘন হয়। অর্থাৎ, হাতি কী খাচ্ছে তার উপর বন-বাস্তুতন্ত্র নির্ভরশীল। কেরলের পরম্বিকুলম বাঘবন সংলগ্ন জনজাতি অধ্যুষিত অল্লীমুপান এলাকায় কয়েক দিন ধরেই জঙ্গলের এই ‘আইকনিক স্পিসিজ়’ এসে রেস্তরাঁর ফেলে দেওয়া খাবার খেয়েছে। মুরগি কষা, মশলাদার ডিম, চাপাটি, কেরল পরোটাও মুখে পুরেছে! বিষয়টি কৌতুককর নয়, মর্মান্তিক, বিপজ্জনক।
পর্যটকদের অনুগ্রহে বাঁদর, কাঠবিড়ালী প্রভৃতি ইতিমধ্যেই চিপস, নুডলসে আসক্ত। এদের ফাস্টফুডে রুচির কারণ আমিষভক্তি বা রান্না করা খাবার নয়। বরং, নোনতা স্বাদ, যা বুনোদের খুব প্রিয়। বহু দিন ধরেই এশীয় হাতিদের আবর্জনা খাওয়ার অভ্যাস নিয়ে সংরক্ষণবিদরা উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন পশুর ক্ষেত্রেই এই সমস্যা নিয়ে গবেষণা চলছে ও জানা যাচ্ছে এতে স্বাস্থ্যহানি, আচরণের অবনমন হচ্ছে। দেখা গিয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার বনের কুকুর ডিঙ্গো আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার সংগ্রহ করায় তাদের বড় জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা কমে, অন্তঃপ্রজননের সমস্যা বাড়ে। উত্তর আমেরিকায় ভালুকরা আবর্জনার টানে পথচলতি ভ্যানের দিকে এলে, দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছিল।
হাতির ক্ষেত্রে প্রভাব এখনও অস্পষ্ট, তবে আবর্জনায় খাবার খুঁজতে আসা হাতির কারণে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এই অভ্যাস হাতিদের পাকস্থলীর পক্ষে ক্ষতিকারক, সার্বিক বিকাশকে বাধা দেবে, অসুস্থ করবে। সম্ভাব্য পরিণাম হাতিসংখ্যার সঙ্কোচন। খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিকের পাত্র, প্যাকেট মিশে থাকে, তা হাতির বর্জ্যের মাধ্যমে জঙ্গলে ছড়ালে অন্য জীবদেহেও ঢুকবে। কোভিডের সময় উত্তরাখণ্ডের কোটদ্বারের কাছে হাতির যে বর্জ্য মিলেছিল তার বহুলাংশেই ছিল প্লাস্টিক। পাত্রে, ক্যানে লেগে থাকা খাবারের কণার সন্ধানে সেগুলি গোটাগুটিই গলাধঃকরণ করেছিল পশুরা। প্যাকেট, কাঁটাচামচ তো বটেই, নমুনার মধ্যে কাচের টুকরো, রবার, ছেঁড়া কাপড় পর্যন্ত পেয়ে চিন্তিত হয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা।
শুধু জঙ্গল বৃদ্ধিই নয়, ডালপালা মুড়িয়ে পশু চলাচলের রাস্তাও বানায় হাতি। বনে তাদের গর্ত খুঁড়তে দেখা যায়। সেই গর্তে জমা জল, খনিজ অন্যান্য পশুর জন্যও কার্যকর। এ সব কারণে হাতিকে ‘বাস্তুতন্ত্রের ইঞ্জিনিয়ার’ও বলা হয়। অর্থাৎ, জঙ্গল ও প্রকৃতির ভারসাম্যের স্বার্থেই হাতিদের সুস্থ ভাবে টিকিয়ে রাখা দরকার। বন্যপ্রাণের দেহতন্ত্র মানুষের আহার্য গ্রহণের উপযুক্ত নয়, এতে মানুষ-বন্যপ্রাণ সংসর্গ বাড়ে ও তাতে দু’পক্ষেরই ব্যাক্টিরিয়া ও রোগলাভের সম্ভাবনা। খাদ্যরুচি মিলিয়ে দিলে মানুষ-বন্যপ্রাণের একই খাবারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শিউড়ে ওঠার বিষয়। আর জঙ্গল সংলগ্ন লোকালয়ে হাতি রেস্তরাঁর খাবার খুঁজতে এলে তো মানুষেরই বিপদ। পশুরা যদি বোঝে যে জনবসতির কাছে খাবারের ঢালাও ব্যবস্থা, তা হলে তো তারা সেই এলাকাকেও নিজের বিচরণক্ষেত্রের মধ্যেই গণ্য করবে। এমন নানা কারণে বহু দেশেই বন্যপ্রাণকে মানুষের খাবার দেওয়া নিষেধ। এ দেশে অবশ্য সেই নির্দেশ বহু তথাকথিত ‘জীবপ্রেমী’রই চক্ষুশূল। দীর্ঘদিন খাবার দেওয়ার ফলেই গুজরাতের সিংহগুলি মানুষের সান্নিধ্যে অভ্যস্ত এক বিস্ময়-প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।
এই কুপ্রথা ছাড়াও দেশের জঙ্গলসংলগ্ন এলাকায় বর্জ্য ডাঁই করার অব্যবস্থা ‘স্ক্যাভেঞ্জার’ (প্রাণিজগতের ডোম বা সাফাইকারী) গোষ্ঠীতে আশ্চর্য সব নাম জুড়েছে। যেমন ময়না, কুবো, ঘুঘু, বেঁটে কাঠবিড়ালী, ছাগল, হাঁস। ছোট প্রাণীরা বর্জ্যের দিকে এলে তাদের পিছনে লেপার্ড-বাঘও এসে পড়তে পারে। আর হাতিরা সামাজিক প্রাণী, খাবারের খোঁজ পেলে অন্যদেরও জানিয়ে দেয় বলেই অনেকের বিশ্বাস। এমনিতেই তারা জঙ্গলের বাইরের খেতখামার, চারণভূমির প্রতি দুর্বল। তাই জঙ্গল-লাগোয়া জমিতে আদা-হলুদ বা ঝাঁঝালো মশলার চাষ করে হাতি এড়ানোর পরামর্শ রয়েছে। তার বদলে বড় পাল ঢুকছে বলে আত্মরক্ষার অজুহাতে পাথর, জ্বলন্ত টায়ার ছোড়া বা খাবারে বিস্ফোরক গুঁজে দেওয়ার রীতিই জনপ্রিয়। এতে হাতিরা খেপে যায়, বিপদ বাড়ে বলেই প্রমাণিত।
আপাতত, সংঘাত এড়ানোর উপায় কিন্তু একেবারে সহজ। বনের কাছাকাছি লোকালয়ে রেস্তরাঁর বা বাকি বর্জ্যকে পশুনিরোধক পাত্রে নির্দিষ্ট সুরক্ষিত স্থানে ঢেকে রাখা, প্লাস্টিক এবং কঠিন-তরল পদার্থের পৃথকীকরণ, ময়লার গাড়ি আসার সময়েই সেগুলো বাইরে আনা। কঠিন-তরল বর্জ্য আলাদা করতে অনীহার কারণে মানুষের উগরে দেওয়া বিষগুলি প্রবাহিত হয়ে চলে জলাশয়, নদী-নালা আর সমুদ্রের দিকে।
মানুষ যে পৃথিবীটা চালাচ্ছে— এ আমাদের একটা ধারণামাত্র। যদি কোনও প্রজাতি প্রকৃতির স্বাভাবিক জীবনচক্রে বাধা দেয়, তাকে সে ছুড়ে ফেলবে, নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আর, স্ক্যাভেঞ্জার গোষ্ঠীতে বৃহত্তম জীবিত স্থলচর হাতির দেখা কিন্তু অত্যন্ত অস্বাভাবিক, প্রলয়ের ইঙ্গিত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)