E-Paper

দুই পারে দুই অর্থদর্শন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথাই ধরুন। ২০২৪-এর অগস্টে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম সর্বাঙ্গীণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রক নীতি প্রণয়ন করল।

রঘুরাম রাজন

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫৫

কিছু দিন আগে এক জার্মান বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের সমস্যা হল, যে কোনও নতুন জিনিসের ক্ষেত্রেই তাঁরা সম্ভাব্য বিপদ এবং ক্ষতি সম্বন্ধে বড্ড বেশি মাথা ঘামান। তাঁরা ক্ষেত্রটিকে বেঁধে ফেলতে চান হরেক আইন এবং নিয়মের নিয়ন্ত্রণে। এবং, সেই কারণেই, এই নতুন ক্ষেত্র থেকে লাভের যে সম্ভাবনা ছিল, তার বারোটা বেজে যায়। অন্য দিকে, আমেরিকান নীতিনির্ধারকরা যে কোনও নতুন জিনিসের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য লাভের কথা অনেক বেশি ভাবেন। যত ক্ষণ না তাঁরা কোনও নিয়ন্ত্রক নীতির ফলাফল সম্বন্ধে নিশ্চিত না হচ্ছেন, তত ক্ষণ অবধি তেমন কোনও নীতি আরোপ করতে চান না। “কাজেই, উদ্ভাবনী চিন্তার গুরুত্ব আছে, এমন যে কোনও শিল্পই আমেরিকায় অনেক বেশি বিস্তার লাভ করে,” ভদ্রলোক বললেন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথাই ধরুন। ২০২৪-এর অগস্টে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম সর্বাঙ্গীণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রক নীতি প্রণয়ন করল। কোনও বিশেষ পরিচিতির ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ, ভ্রান্ত তথ্য প্রদান, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, বা এমন কোনও কৃত্রিম মেধা ব্যবস্থা যা মানুষের জীবন বা সামাজিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণ হতে পারে— এমন প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেই নীতিতে রক্ষাকবচ রয়েছে। এই আইনে বিভিন্ন কৃত্রিম মেধা-ব্যবস্থাকে ঝুঁকির বিভিন্ন ধাপে সাজানো হয়েছে, এবং প্রতিটি ধাপের জন্য নিয়মবিধি পৃথক। কৃত্রিম মেধা-চালিত ‘সোশ্যাল স্কোরিং সিস্টেম’ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যে কৃত্রিম মেধা-ব্যবস্থায় ঝুঁকি বেশি, সেখানে নজরদারি কঠোরতর, এবং নিয়ম না-মানলে বিভিন্ন ধরনের জরিমানারও ব্যবস্থা রয়েছে।

কিন্তু, কৃত্রিম মেধা-শিল্পের ক্রমবর্ধমান দুনিয়ায় ইউরোপের উপস্থিতি তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বিশেষত আমেরিকা বা চিনের তুলনায়। আজকের জেনারেটিভ এআই-এর দুনিয়ায় যে সংস্থাগুলি শীর্ষস্থানীয়, তার সবই আমেরিকান— ওপেনএআই, অ্যানথ্রপিক, গুগল; কোনও ইউরোপীয় সংস্থাই এই স্তরে পৌঁছতে পারেনি। ইউরোপীয় নীতির সমস্যা হল, কোনও নতুন প্রযুক্তি থেকে কতখানি লাভ হতে পারে, তা স্পষ্ট হওয়ার আগেই সেই প্রযুক্তির উপরে বিবিধ নিয়মকানুনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, যার আর্থিক চাপ পড়ে সংস্থার উপরে। এ কথা স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন যে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ায় অথবা মিথ্যা তথ্য দেয়, এমন কোনও চ্যাটবট আদৌ কাম্য নয়— কিন্তু, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একেবারে গোড়ার দিকে খানিক সহনশীল হতেই হয়, যাতে সংস্থাগুলি ধাপে ধাপে নিজেদের ভুলত্রুটি শুধরে নিতে পারে। তা ছাড়াও, প্রযুক্তির উদ্ভাবকরা যখন কোনও বাধানিষেধ ছাড়াই তাঁদের প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে কাজ করতে পারেন, তখন তাঁদের হাতে সাধারণত যথেষ্ট সময় (এবং, সম্ভবত অর্থও) উদ্বৃত্ত থাকে, যা ব্যবহার করে তাঁরা সেই প্রযুক্তির গোলমেলে দিকগুলো মেরামত করার দিকে নজর দিতে পারেন, যাতে সেই প্রযুক্তি আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। প্রথম দিন থেকেই যদি নিখুঁত প্রযুক্তি দাবি করা হয়, তা কিন্তু সমাজকে সেই নিখুঁত প্রযুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না— বরং, ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে ভুলত্রুটি শুধরে নিতে নিতে অগ্রসর হওয়া ভাল।

যে চ্যাটবট কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে কথা বলে, তা যদি বর্ণবৈষম্যবাদী হয়, তবে তার পরিণতি যে ভয়ঙ্কর হতে পারে, সে কথা অনস্বীকার্য। এমন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে কিছু দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে কোনও নতুন প্রযুক্তিকে প্রথমে অতি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে যাচাই করে নিতে চায়। সীমিতসংখ্যক ব্যবহারকারীর হাতে এই নতুন প্রযুক্তি তুলে দিতে পারে সংস্থাটি, তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে তথ্য আহরণ করতে পারে— এবং, পুরো ঘটনাটিই ঘটে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারিতে। নতুন প্রযুক্তির কোনও কুপ্রভাব যাতে বিনা বাধায় বৃহত্তর জনসমাজে ছড়িয়ে না পড়ে— ইউরোপের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির মূল আশঙ্কা যেখানে— তা নিশ্চিত করতেই এমন ব্যবস্থা। চলতি কথায়, এই ব্যবস্থাকে বলা হয় ‘স্যান্ডবক্স ট্রায়াল’।

এই ব্যবস্থায় প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু তার ইতিবাচক দিকটিও আটকা পড়ে সেই বাধায়। নতুন প্রযুক্তিকে সীমিতসংখ্যক গ্রাহকের মধ্যে ছাড়া হলে ‘নেটওয়ার্ক এফেক্ট’-এর সুফল পাওয়া যায় না। যত বেশি মানুষ কোনও প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, ততই তাঁদের কাছে সেই প্রযুক্তি আরও বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে— একে বলে নেটওয়ার্ক এফেক্ট। আবার, বহু ক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে যে, ‘ভুল’ লোকের হাতে পড়েই প্রযুক্তির অগ্রগতি হয়েছে দ্রুততর হারে— যেমন, ওয়েব প্রযুক্তির আদি পর্বে অনলাইন পর্নোগ্রাফির দৌলতে প্রযুক্তিটির বিপুল উন্নতি ঘটেছিল। ‘স্যান্ডবক্স ট্রায়াল’ এই সম্ভাবনাগুলোর পথ রোধ করে।

আমেরিকার ‘উদার নীতি’র সবচেয়ে বড় বিপদটি হল, কোনও একটি অনিয়ন্ত্রিত পণ্য হঠাৎ কোনও গোটা অর্থব্যবস্থাকে বিধ্বস্ত করতে পারে। ২০০৮ সালের সাবপ্রাইম মর্টগেজ-এর ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল। এখন জেনারেটিভ এআই এবং ক্রিপ্টো কারেন্সি নিয়ে এমন আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে।ঐতিহাসিক ভাবে আমেরিকা নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তুলনায় বেশি ঝুঁকি নিতে পেরেছিল,কারণ ইউরোপের তুলনায় আমেরিকার সরকারের হাতে এক দিকে টাকা বেশি, অন্য দিকে সেই টাকা খরচ করার ইচ্ছাও বেশি ছিল। আজকের আমেরিকায় এই পরিসরটি ক্রমে সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফলে, অদূর ভবিষ্যতে সে দেশও নতুন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্ক হওয়ার নীতির পথে হাঁটলে অবাক হব না।

প্রশ্ন হল, আমেরিকা যদি চায়ও, তার পক্ষে কি অধিকতর নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটা সম্ভব? সে দেশে দস্তুর হল, কোনও একটি শিল্প যত ক্ষণ না যথেষ্ট বড়সড় হয়ে উঠছে, তত ক্ষণ অবধি তাকে নিয়ে মাথা ঘামানো হয় না। কিন্তু, সরকার যখন কোনও শিল্প বিষয়ে মাথা ঘামাতে চায়, তত ক্ষণে সেই শিল্পক্ষেত্রটি আর্থিক সামর্থ্যে এবং রাজনৈতিক প্রভাবে এমন জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া আইনকে তারা নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে গড়েপিটে নিতে পারে। ক্রিপ্টোর কথাই ধরুন। এই শিল্পক্ষেত্রে বিপুল টাকা, বহু রাজনৈতিক লবিস্ট তাদের হাতে— দেখা যাচ্ছে, ক্রিপ্টো শিল্প রাজনীতিকদের, এবং বৃহত্তর জনমতকে, নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে ঘুরিয়ে নিতে খুব বেশি রকম পটু। তার অবধারিত পরিণতি হল প্রয়োজনের তুলনায় কম নিয়ন্ত্রণ— এবং, জনগণের পক্ষে বিপুল ঝুঁকি।

ঝুঁকি-বিমুখ ইউরোপ এর ঠিক উল্টো পথে হাঁটে। কোনও শিল্প যখন একেবারেই নতুন, তাদের প্রভাব অতি সীমিত, ইউরোপ তখনই তার উপরে বিপুল নিয়ন্ত্রণের বোঝা চাপিয়ে দেয়। তার ফলে, পুরনো শিল্পক্ষেত্রগুলি এই বিতর্কের পরিসরটিকে নিয়ন্ত্রণ করে— ক্রিপ্টোর ক্ষেত্রে যেমন সনাতন ব্যাঙ্কগুলির মতামতই সবচেয়ে প্রবল ভাবে শোনা যাচ্ছে। আমেরিকায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক দেরিতে এবং অনেক কম নিয়ন্ত্রণ; আর ইউরোপে সাততাড়াতাড়ি প্রবল নিয়ন্ত্রণ— দুটোর কোনওটাই যথাযথ নীতি হতে পারে না।

কেউ বলতে পারেন, আজকের বিশ্বায়িত দুনিয়ায় কোনও নিয়ন্ত্রণই দেশের ভৌগোলিক সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়। ধরা যাক, আমেরিকায় তৈরি হওয়া চ্যাটবট সেখানকার নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে দ্রুত উন্নত হয়ে উঠল; উদ্ভাবকরা সুযোগ পেলেন বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা এবং স্কেলিং-এর মাধ্যমে সেই প্রযুক্তির ভুলভ্রান্তি শুধরে নেওয়ার। এর পর, সেই পণ্যটি যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছবে, তখন তাকে সম্মুখীন হতে হবে ইউরোপের কঠোরতর নিয়মকানুনের। কিন্তু, তত দিনে যেহেতু উদ্ভাবক সংস্থার হাতে যথেষ্ট টাকা থাকবে, এবং ইউরোপের বাজারে ঢোকার প্রণোদনাও যথেষ্ট হবে— তারা ইউরোপের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ম মানার জন্য তুলনায় কম খরচসাপেক্ষ পথ খুঁজবে। সেই প্রযুক্তি শেষ পর্যন্ত ফেরত যাবে আমেরিকাতেও— সেখানেও এই পণ্যটি শেষ পর্যন্ত নিরাপদতর হয়ে উঠবে।

আদর্শ পরিস্থিতিতে এমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু, বাস্তব এর চেয়ে জটিলতর। হতেই পারে যে, ইউরোপের নিয়ন্ত্রকরা নাগাল পাওয়ার আগেই আমেরিকার অনিয়ন্ত্রিত সংস্থা আন্তর্জাতিক বাজারে বিপুল ক্ষতি করল। আবার এমনটাও হতে পারে যে, ইউরোপের নিয়ন্ত্রণের চাপে উদ্ভাবনী পণ্যের বাজারটিই সঙ্কুচিত হয়ে গেল, ফলে বিশ্বের মোট চাহিদার অনুপাতে যথেষ্ট জোগান থাকল না। কিন্তু, সবচেয়ে বড় বিপদ ঘটতে পারে তখন, যখন ইউরোপ এবং আমেরিকা একে অন্যের উপরে চাপিয়ে দিতে চাইবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের দর্শন। মহাসাগরের দু’পারের দুই অর্থনৈতিক মহাশক্তির নিয়ন্ত্রণের দর্শন পৃথক থাকলেই দুনিয়ার মঙ্গল।

(প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

america European union

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy