এক বড় বেসরকারি ব্যাঙ্কের ঋণ বিভাগে পাঁচ বছর চাকরি করছেন সুরজিৎ। আগে আরও দু’টি ব্যাঙ্কে কাজ করেছেন প্রায় চার বছর। এক দশকেও তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়নি, চুক্তির ভিত্তিতে কাজ। বললেন, প্রতি বছরই চাকরির নবীকরণের সময় এক অনিশ্চয়তা গ্রাস করে। “যে ক’জন স্থায়ী-কর্মী রয়েছেন, তাঁদের থেকে আমার কাজ তো আলাদা নয়, দায়িত্বও কম নয়। অথচ মাইনে কম,” আক্ষেপ সুরজিতের।
প্রায় একই অবস্থা তারাতলা-বেহালা শিল্পতালুক বা সেক্টর ফাইভের প্রযুক্তি তালুকের বড় বড় সংস্থার বেশির ভাগ কর্মীর। সর্বত্রই স্থায়ী-কর্মী হাতেগোনা, বাকিরা চুক্তিতে নিযুক্ত। সংস্থার হাতে বড় কাজের বরাত এলে কর্মী-শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ে, কাজ কমলে ছাঁটাই। এই চুক্তি-কর্মীদের কাজের সঙ্গে স্থায়ী শ্রমিকদের কাজের বিশেষ কোনও পার্থক্য কিন্তু নেই, দক্ষতা বা শ্রমের নিরিখে।
গত তিন দশকে প্রায় সব পেশাতেই চুক্তি-কর্মীদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে, আর স্থায়ী কর্মচারীদের সংখ্যা কমেছে। সংগঠিত এবং অসংগঠিত, উভয় ক্ষেত্রেই। ভারতের ৯০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক রয়েছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে, মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন। সংগঠিত ক্ষেত্রের সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার ভিতরেও ‘অসংগঠিত ক্ষেত্র’ ক্রমশ বাড়ছে— চুক্তির মাধ্যমে অস্থায়ী কর্মীর নিয়োগ বাড়ছে বলে। এই চুক্তি-কর্মীদের বেতন কম, কাজের নিশ্চয়তা নেই, সামাজিক সুরক্ষা শূন্য বা সামান্য। ২০১৯-২০ সালে পাশ-করা চারটি নতুন শ্রম বিধি কি এই কর্মীদের জন্য কোনও আশ্বাস বয়ে আনতে পারল?
চার বছরেও কেন শ্রম বিধি কার্যকর হল না, সেটা প্রথম প্রশ্ন। কিন্তু কার্যকর হলেও চারটি শ্রম বিধি থেকে চুক্তি-ভিত্তিক কর্মী বা শ্রমিকদের তেমন কোনও লাভ হবে না। তাঁরা আইনি সুরক্ষা পেতেন, যদি মজুরি বিধি (২০১৯) ‘সমান কাজের জন্য সমান বেতন’ নীতিকে প্রত্যক্ষ ভাবে স্বীকৃতি দিত। দুর্ভাগ্য, মজুরি বিধিতে এই নীতিকে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখই করা হয়নি, স্বীকৃতি দেওয়া তো পরের কথা। অথচ, গত এক দশকে বেশ কিছু মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ‘সমান কাজের জন্য সমান বেতন’ নীতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতি যদি শ্রম বিধি দিত, তা হলে চুক্তি কর্মচারীরা আশ্বস্ত হতেন।
১৯৮২ সালের রণধীর সিংহ বনাম ভারত সরকার মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, সমান কাজের জন্য সমান মজুরি নীতি প্রত্যক্ষ ভাবে মৌলিক অধিকার না হলেও, সংবিধানের ১৪ এবং ১৬ ধারা থেকে তা আহরণ করা যায়। অযৌক্তিক কোনও বিভাজনের ভিত্তিতে মজুরির হেরফের করা যাবে না। ২০২২ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকার বনাম আর ডি শর্মা মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সম-কাজে সম-মজুরিকে ‘সংবিধানের লক্ষ্য’ জানিয়ে বলে, সমান মজুরি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
‘সমান কাজের জন্য সমান বেতন’ নীতি অনুসারে, দু’জন কর্মী বা শ্রমিক যদি একই কাজ করেন, তা হলে তাঁরা একই মজুরি এবং অন্যান্য সুবিধা পাবেন। সেখানে কর্মীর জাত, লিঙ্গ, ভাষা প্রভৃতি যেমন বিবেচনার বিষয় নয়, তেমনই তাঁর নিয়োগ স্থায়ী না স্বল্পমেয়াদি, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই নীতি সর্বজনীন হলে চুক্তি-কর্মী রাখার একটিই সুবিধে পাবেন নিয়োগকারী, তা হল নমনীয়তা— প্রয়োজন অনুসারে কর্মী নিয়োগ বা ছাঁটাই। কিন্তু, কম বেতন দেওয়ার সুযোগ পাবেন না। চুক্তি-কর্মী যে ক’দিন কাজ করবেন, সে দিনগুলো ইপিএফ-ও দিতে হবে। এর ফলে নিয়মিত কাজের জন্য স্থায়ী কর্মী নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারত। বর্তমান বিধি দ্রুত, বেশি সংখ্যায় কাজ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করছে, কিন্তু কর্মীর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
আমাদের দেশের বেশ কিছু শ্রম আইন তৈরি হয় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। তখন মালিক বা সংস্থাগুলি সরাসরি কর্মী নিয়োগ করত। কর্মচারী বলতে স্থায়ী কর্মচারী বোঝাত। ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে ক্রমশ শ্রমিক আর মালিকের মাঝে ঠিকাদার এসে পড়ে। নব্বইয়ের দশকে ঠিকাদারদের প্রভাব বাড়ে, স্থায়ী-কর্মীর কাজের জন্য চুক্তি-কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। চুক্তিতে নিযুক্ত অস্থায়ী কর্মী-শ্রমিক শ্রম আইনের সুরক্ষার বাইরে, তাই অসুরক্ষিত কর্মী-শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। গত বছর প্রকাশিত কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৩ সালে প্রধান ন’টি সংগঠিত ক্ষেত্রে (কল-কারখানা, নির্মাণ, পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, হোটেল-রেস্তরাঁ, ব্যবসা, তথ্যপ্রযুক্তি, আর্থিক পরিষেবা) ১৮% কর্মী চুক্তিতে নিযুক্ত।
ভারতে শ্রমের বাজারে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ রয়েছেন। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বেকারত্ব ৩.৫%, যার অর্থ ৫৮ কোটি মানুষ কাজ পেয়েছেন। তাঁদের মাত্র ৭-৮% সংগঠিত ক্ষেত্রের স্থায়ী শ্রমিক। পঞ্চাশ কোটিরও বেশি মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। এঁদের একটা বড় অংশ সংগঠিত ক্ষেত্রে চুক্তিতে দক্ষ শ্রম, বা কায়িক শ্রমের কাজ করেন। এঁদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ছাড়া আর কোনও আশ্বাস শ্রম বিধিগুলি দিচ্ছে না। সামান্য বেতন, সবেতন ছুটি বা মাতৃত্বের ছুটি না পাওয়া, পিএফ-পেনশন থেকে বঞ্চনা, এ সব রয়েই গেল। তাই বেশির ভাগ কর্মী-শ্রমিকদের মধ্যে শ্রম বিধি নিয়ে বিতর্কে কোনও উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। চারটি শ্রম বিধি পাশ হওয়ার পর থেকেই প্রায় সমস্ত বড় ট্রেড ইউনিয়ন লাগাতার সেগুলির বিরোধিতা করছে, সর্বভারতীয় ধর্মঘটের ডাকও দিয়েছে। কিন্তু তৃণমূল স্তরে তেমন কোনও হেলদোল নেই।
গত সাড়ে তিন দশকে কাজের বাজারে যে পরিবর্তন এসেছে, যে ভাবে সব ধরনের পেশায়, সব রকম সংস্থায়, ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ বেড়েছে, তার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না চারটি শ্রম বিধিতে। বাস্তব এই যে, অধিকাংশ ঠিকাদার আইন মেনে লাইসেন্স নেন না, তাঁর অধীনে নিযুক্ত কর্মী বা শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করান না। ফলে ওই স্বীকৃতিহীন কর্মী ও শ্রমিকরা দুর্ঘটনা বিমা থেকে ন্যায্য মজুরি, কিছুই পান না। আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের আইনটি (১৯৭৯) শ্রম বিধির অধীনে এসেছে। স্বীকৃতিহীন পরিযায়ী শ্রমিকরা কতখানি নিরাপত্তাহীন, তা কোভিড লকডাউনে দেখেছিল দেশ। অথচ, নতুন আইন ঠিকাদারদের নথিভুক্তির শর্ত শিথিল করেছে— আগে ২০ জন শ্রমিক সরবরাহ করলেই লাইসেন্স লাগত। এখন ৫০ জন শ্রমিক সরবরাহ করলে তবে লাইসেন্স নিতে হবে।
ব্যাঙ্ক অথবা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় উচ্চশিক্ষিত, সুদক্ষ কর্মী থেকে সাফাই-কর্মী, পাহারাদার, ক্যান্টিন-কর্মী, সকলেই এখন চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের জন্য আইনকে প্রাসঙ্গিক করা যেত, যদি শ্রম বিধিতে ‘সমান কাজের জন্য সমান বেতন’-এর মতো কয়েকটি আবশ্যক নীতির স্পষ্ট উল্লেখ থাকত। সে ক্ষেত্রে চুক্তি-কর্মীরা সম্মানের সঙ্গে বাঁচার একটা পথ খুঁজে পেতেন; একই সঙ্গে, শ্রম আইনকে দেশের অধিকাংশ শ্রমিকের জন্য প্রাসঙ্গিক করা যেত। আক্ষেপ, সেই সুযোগ হাতছাড়া হল। সুরজিতের মতো লক্ষ লক্ষ চুক্তি-কর্মীকে চাকরির নবীকরণের চিঠির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে বিষণ্ণ, সন্ত্রস্ত মনে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)