Advertisement
E-Paper

রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন চাণক্যকে: ‘এ সব আপনি পছন্দ করেন?’

সত্যিকারের সাম্রাজ্য এক, সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখা আর এক।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২১ ০৫:১৬

আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের ’পর... ভোরবেলায় নিচু স্বরে আবৃত্তি করতে করতে মিউজ়িয়ামের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমনিতেই লকডাউনে রাস্তাটা আজকাল বেশির ভাগ সময় থম মেরে থাকে, দালাল ও রিকশাওয়ালারা কেউ ইশারায় ডাকে না, অফিসবাবুরা টিফিনের ভিড় জমায় না। রেস্তরাঁগুলি আর রাত জাগে না, মিউজ়িয়ামের চাতালটা মরা সরীসৃপের মতো সারা দিন নিঃসঙ্গ শুয়ে থাকে।

রবীন্দ্রনাথ এ সব জানেন। জানেন, দশ নম্বর সদর স্ট্রিটে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ও বৌদি জ্ঞানদানন্দিনীর সেই বাড়ি অনেক আগেই ভাঙা পড়ে গিয়েছে। তবু অভ্যাসবশে মাঝে মাঝে কাক-ডাকা ভোরের আগে এই রাস্তায় হেঁটে যান। ওই তো দমকলের বাড়িটা, আর একটু এগিয়ে গেলে বন্ধ যমুনা সিনেমা। ‘কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত-পাখির গান’, আপনমনে বলছিলেন তিনি। এখানেই এক সকালে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে ভাবের বশে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ নামে একটি কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন। তখন এখানে অনেক গাছ ছিল, ফাঁকা জায়গা ছিল, বাবামশায় মাসে দেড়শো টাকা মাসোহারা দিতেন। ‘মাতিয়া যখন উঠেছে পরান, কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!’ ভাইঝি বিবি তাঁর গলায় কবিতার এই জায়গাটা শুনতে পছন্দ করত।

নস্ট্যালজিয়ার চটকা হঠাৎ ভেঙে গেল। টিকিওয়ালা এক বেঁটে লোক তাঁর আবৃত্তিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে উল্টো কথা বকবক করছে, ‘প্রভাতের সর্বাঙ্গে ঘা। পুঁজ পড়ছে। হে সুন্দরী বীভৎসতা, তুমি এত সুন্দরী!’ রবীন্দ্রনাথ জানেন, এই পাড়ায় রিকশাওয়ালাদের দুই-এক জনের টিকি আছে, দুপুরে কলাই-করা থালায় তারা দশ টাকার ছাতু জল দিয়ে চটকে পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে খায়। কিন্তু তাঁর উল্টো কথা বলার সাহস তাদের কারও হয়নি।

একটু এগোতেই লোকটাকে চিনতে পারলেন তিনি। মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী চাণক্য! এখানে, এই জায়গায় ওঁর থাকার কথা নয়। কিন্তু মাঝে মাঝে অভাবিত অনেক কিছু ঘটে! চাণক্য তাঁকে দেখে অল্প হাসলেন, “কেমন আছ রবি?”

রবি: সকাল-সকাল দ্বিজেন্দ্রবাবুর চন্দ্রগুপ্ত নাটকের ওই থিয়েটারি ডায়লগটা থামাবেন, প্লিজ়?

চাণক্য: থিয়েটারি নয়, ভায়া। এ হল মন কি বাত! কেউ শুনুক আর না শুনুক, আপনমনে বলে যাই।

রবি: এত আনন্দের কী হয়েছে?

চাণক্য: হবে না? দেশে আবার প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শুনলাম, ‘পেগাসাস’ নামে একটা সফটওয়্যার গোপনে রাজপুরুষ, মন্ত্রী থেকে সাংবাদিক, প্রতিবাদী সকলের ফোন ট্যাপ করছে। অর্থশাস্ত্র-তে এটাই তো লিখেছিলাম। গোপনে গূঢ়পুরুষরা সব সংগ্রহ করে রাজাকে জানাবেন।

রবি: অভয় দেন তো বলি। এখানে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমবাবু থেকে আমি অনেক কষ্টে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যটাকে আধুনিক রূপ দিয়েছিলাম। তার পর ভাষাটা বহু দূর এগিয়ে গিয়েছে। এখন ওই সব সংস্কৃত ‘গূঢ়পুরুষ’ চলে না, ‘গুপ্তচর’ বললেই হয়।

চাণক্য: কিঁউ কি যান্ত্রিক গুপ্তচর! বেশ, ক্ষতি নেই।

রবি: ওই কিঁউ কি-টাও কিন্তু বাংলা নয়।

চাণক্য: আমাদের আধুনিক পাটলিপুত্রের ভাষাই তো দেখছি এখানে চলছে। তুমি বড় তক্কো করো বাপু। আচ্ছা, যান্ত্রিক গুপ্তচরের পাশাপাশি রাজন্যবর্গ চর হিসেবে বিষকন্যাও নিয়োগ করেন তো?

রবি: বিষকন্যা!

চাণক্য: হ্যাঁ, মনে পড়ছে না? রাজা নন্দের মন্ত্রী রাক্ষস পরে মহারাজ চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার জন্য বিষকন্যা পাঠিয়েছিল। আমি জানতে পেরে সেই কন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের বদলে উল্টে রাক্ষসের নতুন বন্ধু পর্বতকেশ্বরের কাছে পাঠিয়ে দিই। ব্যস, সেই কন্যাকে চুম্বন ও মৃত্যু। সবই বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস নাটকে আছে। ভুলে গেলে?

রবি: এখন ও সব হয় না। আপনি গুরুজন, তবু বলি, সক্কাল-সক্কাল স্পাইওয়্যার আর বিষকন্যার আলোচনা ভাল লাগছে না। যে দেশ তার নাগরিক সকলকে সম্ভাব্য রাষ্ট্রদ্রোহী ভাবে, রাজনৈতিক নেতা থেকে সাংবাদিক, আইনজীবী সকলের ফোনে গোপনে আড়ি পাতে... ছি ছি!

চাণক্য: ছিছিক্কারের কী আছে? অর্থশাস্ত্রে যে কত রকম গুপ্তচরের কথা লিখেছি! ছাত্রের বেশে থাকবে কাপটিক ব্যঞ্জন, গৃহস্থের বেশে গৃহপতিক ব্যঞ্জন, তপস্বীর বেশে তাপস ব্যঞ্জন। পরিব্রাজিকা এবং ভিক্ষুকীর বেশে আর এক দল। মনে আছে তো?

রবি: হ্যাঁ, আপনার নীতিতে পুরো মৌর্য সাম্রাজ্যই গুপ্তচরে ভরে গিয়েছিল।

চাণক্য: সাম্রাজ্য নিষ্কণ্টক রাখতে গেলে ওটাই করতে হয়, বাপু। তোমার মতো গীতাঞ্জলি লিখলে চলে না। এমন করছ যেন ফোন ট্যাপিং এ দেশে প্রথম। রাজীব গাঁধীর আমলে কে সি পন্থ, আরিফ মহম্মদ খানের ফোনে আড়ি পাতা হয়নি? মহারাষ্ট্রের আন্তুলে বিরোধী নেতাদের ফোন ট্যাপ করেননি? ক্ষমতা রাখতে গেলে এই সব করতে হয়।

রবি: ফোন ট্যাপিং অন্য গল্প। ক্ষমতায় বলশালী ছোট ইংরেজ আর উদার বড় ইংরেজ আমার সময়েও ছিল। কিন্তু ‘পেগাসাস’ অন্য গল্প। নাগরিকের করের টাকায় ইজ়রায়েলের স্পাইওয়্যার কিনে তাদেরই ফোনে আড়ি পাতা, তাদের দেশদ্রোহী প্রতিপন্ন করা।

চাণক্য: কিন্তু দেশের কথাও ভাবতে হবে। পাকিস্তান, চিন। দেশের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার জন্য বিদেশি ষড়যন্ত্র। ভিতরে আরবান নকশাল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা ভাববে না, কবি?

রবি: দেশের নিরাপত্তা? না শুধু রাষ্ট্রের আর রাজার নিরাপত্তা? আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল সবাইকে নিয়ে জীবন্ত একটা সমাজ আছে। বহু আগে বঙ্গদর্শন-এ লিখেছিলাম, ‘নেশন’ শব্দ আমাদের দেশে ছিল না। “আমরা যদি মনে করি, য়ুরোপের ছাঁদে নেশন গড়িয়া তোলাই সভ্যতার একমাত্র প্রকৃতি এবং মনুষ্যত্বের একমাত্র লক্ষ্য, তবে আমরা ভুল বুঝিব।” মহামতি চাণক্য, দেশ কোনও ভৌগোলিক ধারণা নয়। জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রেম দিয়ে দেশ সৃষ্টি করতে হয়। মানুষে মানুষে হৃদয়ের সম্বন্ধ হলেই তো আত্মশক্তি গড়ে উঠবে।

চাণক্য: মানুষ? হাসালে কবি। যে কোনও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যের পিছনে থাকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং বিধিনিষেধই মানুষকে ন্যায্যতার ধারণা দেয়, বুঝলে? মানুষ-টানুষ নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় ঠিক নীতির দরকার।

রবি: আপনার সেই নীতি জানি। অর্থশাস্ত্রে লিখেছেন, বেচাকেনার বিষয়ে বণিকদের সঙ্গে গোলমাল হলে এক দিনে মিটিয়ে ফেলতে হবে। চাষিদের ক্ষেত্রে তিন দিন, উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে সাত দিন দিতে হবে। এক-এক জন নাগরিকের জন্য এক-এক রকম নিয়ম। এটাই তো আপনার নীতি, না কৌটিল্য?

কৌটিল্য: চাষি আর বণিকের ক্ষেত্রে এক নিয়ম চলে? আর্য আর ম্লেচ্ছের জন্য এক নীতি! হা হা, ভিন্‌দেশি নোবেল পুরস্কার না কী একটা পেয়ে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, বাছা।

রবি: মাথা ঠিকই আছে, কিন্তু এ ভাবে চাষি-বণিক ভেদ করলে আপনি বুঝবেন না। সভ্যতার দাবিতে গণতন্ত্র এল, আর গণতন্ত্রের আসল কথাটাই “এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা— এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা—”

কৌটিল্য: ওই আশা জাগাতে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হবে। অর্থশাস্ত্রের নিয়মে বাঁধতে হবে।

রবি: আমার বিশ্বাস রাষ্ট্রে নয়, দেশে। “হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।”

কৌটিল্য: অসংবদ্ধ প্রলাপ। এর পর বলবে, ভারাভারা রাও, স্ট্যান স্বামীর অপমানেও তাঁদের সমান হতে হবে। কবি, এত সম্মান পেয়েছ। কিন্তু তুমি অকৃতজ্ঞ, রাষ্ট্রকে ভালবাস না।

রবি: রাষ্ট্রক্ষমতাকে যারা দেশ ভাবে, তাদের ভালবাসি না। বিষ্ণুগুপ্ত, আমার ঘরে বাইরে উপন্যাসের নিখিলেশ আগেই বলে দিয়েছে, “কোনও উত্তেজক কড়া মদ খেয়ে দেশের কাজে লাগব না।... দেশকে সাদাভাবে, সত্যভাবে দেশ বলেই জেনে যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না, চিৎকার করে মা বলে দেবী বলে মন্ত্র পড়ে, তাদের সেই ভালবাসা দেশের প্রতি তেমন নয় যেমন নেশার প্রতি।”

চাণক্য: বুঝলাম। তুমি ধর্মত্যাগী ব্রাহ্ম সন্তান। দেশমাতৃকা তো বটেই, দেবদ্বিজেও ভক্তি নেই।

রবি: আমি আপনার মতো ‘জাতীয়তাবাদী’ ছিলাম না, হবও না। হিরের বদলে ঠুনকো কাচ কিনতে আমি নারাজ। এই জাতীয়তাবাদের কী মানে, চাণক্য? শুধুই গোপনে চরবৃত্তি, হিংসা আর ভেদাভেদ। কেউ বলছে, ‘গোলি মারো সালো কো’, কেউ ভাবছে, নাগরিকপঞ্জি বানাও, গরুখোরদের পিটিয়ে মারো। সত্যি বলুন তো, এ সব আপনি পছন্দ করেন?

পুবে অরুণ আভা। নিউ মার্কেট, জানবাজারের রাস্তায় আনাজ-ম্যাটাডোরের আনাগোনা। চাণক্য রবীন্দ্রনাথের কাছে মুখ নামিয়ে আনলেন,

চাণক্য: সত্যি কথা বলব রবি? পাটলিপুত্র থেকে গান্ধার, পুষ্কল অবধি বিস্তৃত মৌর্য সাম্রাজ্যে আমরা দৃঢ় হাতে শাসন চালিয়েছি ঠিকই, কিন্তু প্রজাদের মধ্যে বিভেদ ঘটাইনি। তুমি তো জানো, ‘গোলি মারো সালো কো’ গোছের কথা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বাক্পারুষ্য। সে জন্য জরিমানা বিধেয় ছিল। মগধে তখন শুধু হিন্দুরাই ছিল না রবি, বৌদ্ধ, জৈন, আজীবক সব সম্প্রদায় শান্তিতে বাস করত।

রবি: মানে, আজকের ভারত শুধু আপনার গুপ্তচরের নিদানটুকুই নিয়েছে, বাকিটা নয়!

চাণক্য: হ্যাঁ। সত্যিকারের সাম্রাজ্য এক, সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখা আর এক। তুমি একটা গান লিখেছিলে না, ‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল...’ আমার অবস্থা সে রকম।

রবি: দুঃখ করবেন না। ভক্তের উপদ্রব আমাকেও কি কম সইতে হয়? চলুন, এ বার যেতে হবে।

অনন্তর শ্মশ্রুগুম্ফশোভিত ও শিখাধারী— দুই পুরুষ কিড স্ট্রিটের দিকে মিলাইয়া গেলেন। তাঁহাদের আর দেখা গেল না।

Rabindranath Tagore Chanakya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy