বাড়িতে মাটি নেই, ঘাস নেই। পিসিমণিও নেই। ঘাসের ডগা থেকে শিশির জমিয়ে তাতে তালের ফোঁপরা, আখ দিয়ে গণ্ডূষ ভরে দেবে কে? মাথায় রুমাল বেঁধে ফুলঝুরি ধরানোর দরকার নেই এখন আর। হিম পড়ে না মাথায়, পুজোর রাতে। উগ্র গন্ধে দম বন্ধ করে ছাতিম ফুটল, আবার ঝরেও পড়ল। মাটিতে পড়ে থাকে শুকনো ছাতিম ফুল, খয়েরি। আধা শূন্য ছাতিম গাছের মাথায় পূর্ণচন্দ্র। না কি গৃহত্যাগী জোছনাডাক দেয়?
এই জোছনা দেখলেই কেন সন্ন্যাস জাগে? কেন এত বিষাদজল হেমন্তে? নাহ্, ফুটফুটে শরৎকালে পুজোর মণ্ডপে দাঁড়িয়েও তো বিষাদ আক্রান্ত করে, সে তো সুখের সঙ্গেই মেশা বেদনা, সেই তো শুরু। শীতকালে দুপুর-ঘুমের পর আকস্মিক দ্রুত সন্ধ্যায় মন খারাপ হয় না কার? তবে কি হেমন্তই থাকে সকলের মনে? সে তো শুধু ঋতু নয়, যাকে দেখতে পাই না বলে এই গ্রীষ্ম-নিম্নচাপের অর্ধে আমাদের আক্ষেপ। সে আলাদা অস্তিত্ব। তবে স্কুলে তো কেউ প্রিয় ঋতু বলে হেমন্ত লেখে না খাতার পাতায়, যত দিন না জীবনানন্দ দাশ আমাদের অধিকার করেন। তার তো প্রখর রোদ নেই, শস্য ফলানো বারিধারা নেই, মেঘদূত নেই, সাদা মেঘ, সোনার মতো রং, লাল ফড়িং নেই শরৎকালের মতো, উপচে পড়া ফুল আর ভুল প্রেম নেই বসন্তের মতো, কিন্তু আমাদের বর্ষা, শরৎ, বসন্ত শুষে নিয়ে মনের কোণে পড়ে থাকে এক বিষাদ।
হেমন্ত এসে তাকে কুয়াশায় মেলে দেয়।হয়তো আমরা বিষাদ মাখি, কুয়াশার মতো, হিমের মতো। আমরা তাকে ভাবি— কবিরা, দ্রষ্টারা তাকে দেখতে পান।
কী দেখেন?
“জীবন যে নশ্বর, তা-ই শুধু নয়, একে শেষ করে দিতে হয়। নিঃশেষ হয়ে যাওয়াটাও একটা শর্ত!” একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন গণেশ পাইন। পরে এক ডিসেম্বরে তাঁর মহাভারতের ছবির প্রদর্শনীতে প্রবেশপথের পরেই কথাগুলো লেখা ছিল বড় বড় অক্ষরে। ছাতিমের উপরে চাঁদের মতোই সে আকর্ষণ করে সন্ন্যাসের দিকে। সে তো হেমন্তকাল ছিল না। এক পড়ন্ত রোদে শহরের জনবহুল রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে মনে পড়েছিল সুজাতা গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা কবিতা, “দীর্ঘ, বড় দীর্ঘ ছিলো শীত, রুক্ষ, বড়ো রুক্ষ ছিলো পথ-ও, তবুও তোকে আনতে গিয়ে একা, সয়েছি বুকে রক্তঝরা ক্ষত।”
সে-ও হেমন্তকাল ছিল না।
কিসের সেই সন্ন্যাস, সেই বহুজনতার মাঝে একা হয়ে যাওয়া? কবিতা সিংহ লিখেছিলেন, “একা হতে চেয়েছিলে,/ তবু কেউ রুমাল নাড়েনি বলে দিল্লী কালকার—/ ট্রেন থেকে নেমে গেল পার্বতী মিত্তির...।” লিখেছিলেন, ‘যূথবদ্ধতার গন্ধ বড় গাঢ়’, কিন্তু ছাতিম কি তার থেকেই টেনে বার করে ফেলে দেয় এক গহ্বরে?
হেমন্ত তবে কী? বিষাদ, কুয়াশা, ঋতুবদলের যন্ত্রণা? যা মাথা, হৃদয়, শরীরে হঠাৎ, কোন মুহূর্তে নড়েচড়ে উঠে অধিকার করে নেয়।
আর মানুষ টিকিট কেটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে জনতার মধ্যে থেকে ঝাঁপ দেয় মেট্রোর লাইনে?
‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম— অবিরাম ভার
সহিবে না আর—’
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে— অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।’
(‘আট বছর আগের এক দিন’, মহাপৃথিবী (১৯৪৪), জীবনানন্দ দাশ)
সে তো ছিল ফাল্গুনের রাত। “যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হল তার সাধ।”
সাধ!
ট্রেনের চাকার শব্দ টানে, জলপ্রপাতের ঝাঁপিয়ে পড়া টানে, পা কাঁপে, সবই কি মৃত্যু— না কি অসীমের সঙ্গে, না-দেখার নিজেকে মিলিয়ে দেওয়ার দুর্মর টান। মনে কি পড়ে না তখন, চতুরঙ্গ-এ শচীশ বলছে, “বন্ধন আমার নয় বলিয়াই কোনো বন্ধনকে ধরিয়া রাখিতে পারি না, আর বন্ধন তোমারই বলিয়াই অনন্ত কালে তুমি সৃষ্টির বাঁধন ছাড়াইতে পারিলে না। থাকো, আমার রূপ লইয়া তুমি থাকো, আমি তোমার অরূপের মধ্যে ডুব মারিলাম।”
“‘অসীম, তুমি আমার, তুমি আমার’ এই বলিতে বলিতে শচীশ উঠিয়া অন্ধকারে নদীর পাড়ির দিকে চলিয়া গেল।”
তবে হেমন্ত কি শুধুই বিষাদ, কুয়াশা? মন কেমন, অস্তিত্ব রোধ করা উগ্র ঘ্রাণ ছাতিমের? এক দিন সহসা ভরা সংসার ফেলে চলে যাওয়ার উদগ্র আকিঞ্চন?
নাহ্।
কোন পূর্বপুরুষ ও নারীকে ঘরের পথ দেখানোর জন্য আকাশপ্রদীপ আজও জ্বেলে দেন মফস্সলের মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘যাক অবসাদ, বিষাদ কালো’, লিখেছেন, “দেবতারা আজ আছে চেয়ে— জাগো ধরার ছেলে মেয়ে,/ আলোয় জাগাও যামিনীরে।”
কী আশ্চর্য, এক হেমন্তসন্ধ্যায় শীর্ণ মোমবাতি সাজিয়ে জ্বলে ওঠে ‘দ্রোহের আলো’।
আমরা যারা আকাশপ্রদীপ জ্বালালাম না কোনও দিন, তারা দেখে আকাশ কাটিয়ে দিলাম, উত্তরাধিকারসূত্রে সন্তানকে বলে গেলাম, আমি চলে গেলেও থাকব ওই আকাশে— তারা দেখে দেখে বললাম, ওই যে সপ্তর্ষি, ওই কালপুরুষ, পায়ের কাছে লুব্ধক, ওই যে মা, ওই দিদা, ঠাকুমা, পিসিমণি, ওই যে আমার ভাই, আমার কন্যা। আমাদের জন্য সারা আকাশই তো হেমন্তকাল। অনন্ত আকাশপ্রদীপ। যে প্রদীপ নেবে না কখনও। শুধু তাকিয়ে থাকতে হয় আর সমুদ্রের মতো কান্না এসে ভাঙে ভিতরে।
কিন্তু তারারও তো মৃত্যু হয়।
হয়, আমাদের জীবৎকাল তা বুঝতে দেয় না।
পাতা তো ঝরেই, ঝরে না? প্রিয়জনের যে ভস্ম তুমি তুলে এনে ছড়িয়ে দিয়েছিলে বাগানে, তার উপর ফুটে ওঠে শুভ্র ম্যাগনোলিয়া। সে যেখানে যেতে চেয়েছিল, সেখানে সেই ছাই ছড়িয়ে গেল। কে যেন লিখেছিলেন, ধুলো সরাব কোথায়? এ তো আমারই পূর্বজনের। ‘ডাস্ট টু ডাস্ট’। সেই তো পুনরুত্থান। হয়তো বা। পুরো পৃথিবীই বেঁচে থাকে সেই পুনরুত্থানে।
মেট্রোর সিঁড়ি দিয়ে যারা নেমে যায়, কোনও কোনও হাত তাদের ফিরিয়ে আনে। মিট জো ব্ল্যাক ছবির মতো মৃত্যু প্রেমে পড়ে মানুষীর, মানুষ হয়ে ফিরে আসে। আস্বাদন করে জীবনের।
হেমন্তের রেলগাড়ি চলে যায় বুকের ভিতর,
ঝরা পাতার স্তূপ নিয়ে
ফিরে আসবে বলে।
যাকে লোকে বসন্ত বলে। যে এক আশ্চর্য হেমন্তকাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy