E-Paper

কাঁটাতারে ভাষা ভাঙে না

বৈচিত্রই ভাষার জান। ‘গান শেষ আর জান শেষ তো একই হইল, রাজামশাই’, হীরক রাজার দেশ-এ চরণদাসের এই উক্তি থেকে ‘জান’ কেড়ে নিলে তো বাক্যটাই মরে যায়। আহরণেই ভাষার বৃদ্ধি এবং ঋদ্ধি।

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৫ ০৬:৪৩

করিমন বেওয়ার বয়স সত্তরের মতো। শরীরটা এ বয়সে যতটা শক্ত থাকার কথা তা নেই অনেকদিন থেকেই। কি এক অসুখ হয়েছে। একদম খেতে ইচ্ছে করে না। শরীর দুর্বল। পাড়ার ডাক্তার কাসেম আলী করিমন বেওয়াকে জানিয়েছে, ‘অসুখ খুব শক্ত। লিভারের অসুখ। মানবদেহের আসল নিয়ন্ত্রক হচ্ছে লিভার। লিভার ভালো থাকলে সবকিছুই ভালো। হার্ট ফার্ট কিছু না।’— করিমন বেওয়া কাসেমের কথা মন দিয়ে শোনেন। কি করবেন বুঝতে পারেন না। তবে কি মৃত্যু খুব কাছে? আর ভাল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নাই? করিমন বেওয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে গোরস্থানের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। ওই গোরস্থানই তার আসল ঠিকানা।”

এই অংশটি দিয়ে শুরু হচ্ছে শফিকুল ইসলামের উপন্যাস, করিমন বেওয়ার চিকিৎসা সংবাদ। লেখকের জন্ম ১৯৫৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানাধীন ধিতপুর গ্রামে। বইটি ২০২১-এ ঢাকা থেকে প্রকাশিত। তাঁর লেখা আগে পড়িনি। কিন্তু সম্প্রতি দিল্লি পুলিশের অনুকরণে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে বলা ও লেখা বাংলা আসলে বাংলা নয়, ‘বাংলাদেশি ভাষা’; কলকাতার পরিচিত কবি সুবোধ সরকার ও বাংলাদেশের কোনও এক শফিকুল ইসলামের লেখা পড়লেই বোঝা সম্ভব, কোনটা বাংলা আর কোনটা ‘বাংলাদেশি’— তার পরেই উৎসাহের বশে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বেশ কিছু শফিকুল ইসলাম নামধারী লেখকের লেখা পড়ে ফেলি।

আর এক শফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৫৪-এই, তবে দিনাজপুরে। গত বছর ঢাকার ‘অনার্য পাবলিকেশনস’ থেকে প্রকাশিত তাঁর বই, ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা শুরু হচ্ছে এই ভাবে: “গভীর এক জঙ্গল। এলোমেলো পায়ে চলা পথ যার শুরু ও শেষ হঠাৎ। জঙ্গলের মাঝে মাঝে কিছু গাছ কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে, বোঝা যায় অতি সম্প্রতি। কোনো কোনো গাছের উচ্চতা এত বেশি আগে কখনো দেখিনি। জঙ্গল পেরিয়ে হঠাৎ যেন সমতল বেশ নিচে নেমে গেছে। এতক্ষণের শব্দের রহস্য বোঝা গেল চোখের সামনে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী দেখে। প্রবল বেগে বয়ে চলেছে ছোট বড় বিশাল আকৃতির পাথরের মাঝ দিয়ে।”

অন্য আর এক শফিকুল ইসলামের লেখালিখি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে। তাঁর ২০০৩-এ প্রকাশিত সমকালের বাংলাদেশ নামে গদ্যসংগ্রহের প্রথম রচনা ‘আগামী দিনের রাজনীতি: আরো কিছু বিকল্প প্রস্তাব।’ সেটা এই ভাবে শুরু হচ্ছে: “এ কথা সত্যি যে, একদিনে বা ছক বাঁধা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। নানা চড়াই-উত্রাই, ঘাত-প্রতিঘাত, সংঘাত-অভিজ্ঞতা এবং দীর্ঘ সময়ের নিরবচ্ছিন্ন আপোসহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গণতন্ত্রের যে সূতিকাগার যুক্তরাজ্য, সেখানেই গণতন্ত্র বর্তমান অবস্থায় উন্নীত হতে কয়েক শতক সময় লেগেছে।”

যে কোনও বইয়ের যে কোনও জায়গা থেকেই উদাহরণ দেওয়া যেত, কিন্তু সমতার স্বার্থে আমি শুধু একবারে শুরুর অংশটুকুই তুলে ধরেছি। শফিকুল ইসলামদের বাংলা কেন আলাদা ভাষা, এর থেকে সেটা আমার বোধগম্য হয়নি। শমীকবাবু বোঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের মুসলমান লেখক ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু লেখকের কথা। এতে পূর্ব পাড়ের নির্মলেন্দু গুণ আর পশ্চিমের আবুল বাশারের কী হবে, সেও এক প্রশ্ন। আবার এও একটি প্রশ্ন যে, পূর্ব বাংলার শাহ আবদুল করিম যখন গান, “বাংলা মায়ের মুখের হাসি/ প্রাণের চেয়ে ভালবাসি,/ মায়ের হাসি পূর্ণ শশী/ রত্নমানিক জ্বলে,” আর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের কাজী নজরুল ইসলাম যখন লেখেন ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’, তখন কে, কোন ভাষায় লিখছিলেন?

প্রিয় পাঠিকা/পাঠক, এ বার আমি পর পর পাঁচটি উদাহরণ দিচ্ছি। দেখুন তো, শুধু পড়ে বুঝতে পারেন কি না, কোনটা বাংলা, আর কোনটা ‘বাংলাদেশি’?

১) জবাব ছাড়া সাওয়াল যহন/ চাইয়া রইসে চাইয়া,/ ঘরের দাওয়াত উড়াল দিয়া আইল/ শীতলপাটি, কুন যুগের শীতলপাটি,/ তার মুখে পরস্তাব— বন্ধু হাওয়াত/ বানছে মাচা, বানছে কেরাসিনের/ বাতির পিঠে ধুরা সাপের পেট,/ সূর্য হইল সরল খাচা।/ কি বন্ধু,/ হাওয়াত বানছো মাচা?

২) “তু ফকির কব সে হই গেলিন বেটা!”, জাঁতায় আরেক মুঠ কলাই দিয়ে, গলায় এক আশমান অবিশ্বাস নিয়ে তার আম্মা তাকে পুছেই ফেলল। জিজ্ঞাসা করার মতো এবং তার চেয়েও বেশি অবাক হওয়ার মতো বিষয় এটি আলবাৎ। তার মতো বহুত জোয়ান মর্দ এই খানকাহতে থাকত তালিব হিসেবে। তালিম-শেষে বেশিরভাগই ঘর গেরস্থালির কাজে যুতে যেত। পীর দূরের কথা, ঠিকঠাকও মুরিদও বেরোয়নি এই খানকাহ থেকে।

৩) আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ ইতিহাসের সামনে/ আমার কাঁধে দিয়েছ স্টেনগান, কোমরবন্দে কার্তুজ,/ আঙ্গুল ভর্তি ট্রিগার,/ বারুদে বিস্ফোরণে উৎকর্ণ আমার শ্রতি/ আমার দৃষ্টিতে ভবিষ্যত/ আমি সেই ভবিষ্যতের দিকে নিশানা তাক করে উঠে দাঁড়িয়েছি/ আমার গন্তব্য ফুটে উঠেছে প্রতিটি রাস্তায়/ প্রতিটি রাজপথে/ প্রতিটি আয়ল্যান্ডে।

৪) যা বলেছে তাই। বিলিতি কূমড়োর খোসায় গানহী বাওয়ার মূরত আঁকা হয়ে গিয়েছে। সবুজের মধ্যে সাদা রঙের মুখের জায়গাটায় মোচের মতনও দেখা যাচ্ছে। আর কোনো ভুল নেই। এখন কী করা যায়? এরকম করে তো গানহী বাওয়াকে হিমে রোদ্দুরে ফেলে রাখা যায় না। ঠাকুর দেবতার ব্যাপার। মহতো নায়েবরা বৌকা বাওয়াকেই সালিশ মানে।

৫) ‘মিছিল ত তুলিবেন, নেকচার করিবেন কায়?’ গয়ানাথের এমন প্রশ্নের জবাবে সেই চ্যাংড়া নেতারা কথাবার্তা বলে ঠিক করে যে অন্তত সাতটা হাটে তারা কেউ এসে ‘বক্তব্য রাখিবেন।’ ‘আখিবেন ত আখিবেন, আর তেরডা হাটত কি বলদ দিয়া হাম্বা ডাকাম?’ গয়ানাথের এমন চড়া প্রশ্নে আবার এক দফা আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয় যে এই এলাকার দুজনকেই জোগাড় করে নেওয়া হবে।

চেনা গেল? প্রথমটি আগরতলার তনুজ সরকারের, যিনি ত্রিপুরায় প্রচলিত কথ্য বাংলার প্রয়োগ করেছেন এই লেখায়। দ্বিতীয়টি উত্তরবঙ্গের অভিষেক ঝা-র, যিনি এখানে প্রয়োগ করেছেন মালদহে প্রচলিত খোট্টা ভাষার, যাকে তিনি বাংলারই প্রকারভেদ মনে করেন। তৃতীয়টি আদতে নোয়াখালি, পরে ঢাকার ফরহাদ মজহারের কবিতা। চতুর্থ ও পঞ্চমটি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রতন পর্যায়ভুক্ত, পূর্ণিয়ায় জীবন-কাটানো সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস ঢোঁড়াই চরিত মানস ও উত্তরবঙ্গের দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত।

তনুজ বলেন, আগরতলার প্রচলিত ভাষা কলকাতার থেকে বাংলাদেশের বাংলার কাছাকাছি, কিন্তু এর মধ্যেও সিলেট, নোয়াখালি, কুমিল্লার বাংলার প্রভাব বেশি। অভিষেকের মতে, মালদহ যে হেতু উত্তর ভারতের সঙ্গে বঙ্গের মিলনস্থল, এখানকার কথ্যভাষায় প্রমিত বাংলার সঙ্গে খোট্টা, বাদিয়া, সুরজাপুরির যেমন মিশ্রণ আছে, তেমনই আছে পদ্মাপারের চাঁপাই-নবাবগঞ্জের ভাষার।

সাহিত্যে ভাষার কোনও একটি মূল ধারা নির্ণয় করা মুশকিল, কারণ সাহিত্যিকরা অনেকেই ভাষা, ভঙ্গি, বাক্যগঠন নিয়ে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। কথ্য ভাষাসাহিত্যে উঠে এলে তা স্থানীয় বৈচিত্রের প্রতিবিম্বও হয়ে ওঠে। এ ভাবেই সতীনাথের ‘ঢোঁড়াই’তে স্বাভাবিক আগমন হয়েছে ‘মাস মছলী থেকে পরহেজ’ বা ‘আলবৎ পচ্ছিমের পানির গুণ’ জাতীয় বাক্যের। ধানবাদের বাঙালি সাহিত্যিক অজিত রায়ের লেখায় যেমন ‘খুঁখার’, ‘হারগিজ’, ‘মওকা’, ‘নাজুক’, ‘নসীবের ফের’ জাতীয় শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার।

মূল ধারার বাংলার প্রধান উদাহরণ হল সংবাদপত্রের বাংলা। সংবাদপত্রের ভাষা আবার অধিকাংশ সাহিত্যকেও প্রভাবিত করে। তাতে এ-পার ও-পারে পার্থক্য কতটা, সেটা ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা আর বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলো-র ভাষা দেখলে পাঠক নিজেই বুঝতে পারবেন। এই বৈচিত্রের আলোকে দেখলে, ঢাকা-কলকাতার ভাষায় ততটা ফারাক নেই, যতটা মানভূম-মালবাজারে।

বৈচিত্রই ভাষার জান। ‘গান শেষ আর জান শেষ তো একই হইল, রাজামশাই’, হীরক রাজার দেশ-এ চরণদাসের এই উক্তি থেকে ‘জান’ কেড়ে নিলে তো বাক্যটাই মরে যায়। আহরণেই তার বৃদ্ধি এবং ঋদ্ধি। যে ভাবে ‘লাঠিচার্জ’, ‘গুরু’, ‘পণ্ডিত’, ‘অবতার’ ইংরেজি ডিকশনারির অংশ হয়ে গিয়েছে, সে ভাবেই ‘ফেরেশতা’, ‘গোস্ত’, ‘গোসল’ বাংলা অভিধানের। ভাষার বৈচিত্রের উপর হামলা মানে সেই ভাষার বিরুদ্ধেই খতম অভিযান। কাঁটাতারে মাটি ভাগ হয়, ভাষা ভাঙে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP Bengali Bengali Culture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy