আধুনিক নার্সিং-এর প্রবক্তা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল-এর ২০৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে এ বছর। তাঁর জন্মদিনটি (১২ মে) সারা বিশ্বে নার্স দিবস হিসেবে পালিত হয়। যদিও তার উদ্যাপন সাধারণত সীমিত থাকে নার্সদের স্কুল-কলেজ, আর কয়েকটি হাসপাতালে। পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসক দিবসে (১ জুলাই) চিকিৎসকদের অভিনন্দন, কৃতজ্ঞতা জানানোর যে প্রথা দেখা যায়, নার্স দিবসে তা কোথায়? অথচ কঠিন রোগাক্রান্তকে সুস্থ করে তুললে চিকিৎসক প্রশংসা পান, নার্স-দিদিরা রয়ে যান আড়ালে।
নার্সরা খবরে আসেন যখন তাঁরা আক্রান্ত হন। গত বছর ১৪ অগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তারদের পাশাপাশি নার্সরাও দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের শিকার হয়েছিলেন। পুলিশ কর্মরত নার্সদের কোনও নিরাপত্তা দিতে পারল না। এই ঘটনার পর থেকে রাজ্যের নার্সরা নিজেদের অসুরক্ষিত মনে করছেন, বিশেষ করে নাইট ডিউটিতে। সেই রাতে উন্মত্ত জনতার হামলার সময়ে আর জি কর হাসপাতালে ডিউটিরত নার্স বলেছিলেন, “হিংস্র জনতা আমাদের দিকে আসছিল আর আমরা প্রাণভয়ে পালাচ্ছিলাম। এক জন সিনিয়র দিদি ছিলেন, তাই আমরা পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে কোনও রকমে বেঁচেছি।”
সে দিনের আতঙ্ককে ওই নার্স আর তাঁদের পরিবার এখনও বহন করে চলেছেন। “আগে যখন ডিউটিতে আসতাম ফোনে মা-বাবা জানতে চাইতেন হাসপাতালে ঢুকে গিয়েছি কি না! এখন ডিউটি শেষে ফোন আসতে থাকে, হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছি কি না। তবেই তাঁরা নিশ্চিন্ত হন,” বললেন ওই নার্স। আর এক জনের বক্তব্য, “ডিউটিতে আসছি ঠিকই কিন্তু সব সময় খুব ভয়ে থাকি। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না, বিশেষ করে নাইট ডিউটিতে সব সময় মনে হচ্ছে পিছনে কেউ আসছে না তো! কোনও পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে বসে কথা বলা, বা কিছু খাবার দিলে খাওয়া, এ সব এখন চিন্তার বাইরে।”
অভয়া আন্দোলন শুরুর মুহূর্ত থেকে নার্সরা ডাক্তারদের পাশে ছিলেন। সাত-আট ঘণ্টা ডিউটি, জুনিয়র ডাক্তারদের অনুপস্থিতিতে বাড়তি কাজের চাপ সামলেও নার্সরা লাগাতার মিছিলে হেঁটেছেন। তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ-হত্যার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করা, স্বাস্থ্যভবনে অবস্থান বিক্ষোভে প্রথম সারিতে থাকা— সরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত নার্সদের জন্য এগুলো কম সাহসের কথা নয়। সর্বোপরি, নার্সদের নিজেদের কর্মজীবনে, নানাবিধ নির্যাতনের চালচিত্রে তাঁদের কে কতটা সাহায্য করে, কতটুকু পাশে দাঁড়ায়, সেই হিসেব না করেই নার্সরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু আন্দোলনে নার্সদের অবদানের দৃশ্যমানতা ছিল কতটুকু, সে প্রশ্নটাও রয়ে গিয়েছে। “জুনিয়র ডাক্তারদের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ডাক্তারদের আমরাই সাহায্য করছি। রোগীদের চ্যানেল করা, স্যালাইন এবং রক্ত চালানো, ক্যাথিটার পরানো, সিসিইউ-আইটিইউতে সঙ্কটাপন্ন রোগীর অবস্থা বোঝার জন্য সব যন্ত্রের উপর নজরদারি, এ সবই আমরা করেছি,” বললেন নার্সরা। তবু অভয়া আন্দোলনের মুখগুলির মধ্যে কোনও নার্সের মুখ কেউ মনে করতে পারবেন কি? সরকারি ব্যবস্থা, আর সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন, দু’ক্ষেত্রেই নার্সরা থেকে যান পিছনে, অলক্ষ্যে।
এই আন্দোলনের নানা পর্যায়ে নার্সদের নিরাপত্তা, কাজের চাপ নিয়ে কিছু কিছু কথা উঠেছে, কিন্তু কাঠামোগত সমস্যাগুলির কোনও সুরাহা হল না। অথচ, নার্সদের কর্ম-পরিবেশের সুরক্ষাহীনতা তীব্র এবং বহুমাত্রিক। তাঁরা রোগী ও তাঁর আত্মীয়দের থেকে অসুরক্ষিত, পুরুষ সহকর্মীদের থেকেও অসুরক্ষিত। সর্বোপরি রোগী-নার্স আদর্শ অনুপাতের (৫:১) থেকে নার্সদের সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় তাতে রোগী পরিষেবার কাজগুলো সম্পন্ন করা কার্যত অসম্ভব। ওয়র্ডে একা ডিউটি করার সময়ে ইমার্জেন্সি ম্যানেজ করা, ওয়র্ড বয়ের অনুপস্থিতিতে দৌড়ে ডাক্তার ডাকতে যাওয়া, নাইট ডিউটিতে সারা হাসপাতাল রাউন্ড দেওয়া, এমন অনেক কাজ করতে গিয়ে বড় বড় হাসপাতালেও নার্সরা বিপন্ন হয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যন্ত এলাকার ছোট হাসপাতালগুলিতে তাঁদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
কেবল হিংসা নয়, পে-স্কেল থেকে সুযোগ-সুবিধা, সর্বত্র নার্সরা লিঙ্গবৈষম্যের সহজ শিকার। প্রতিবাদ করলে তাঁরা কাউকে পাশে পান না, তাই চুপ করে থাকতে বাধ্য হন। স্বাস্থ্য পরিষেবায় নিযুক্ত যে কোনও ব্যক্তি নার্সের কাছে কৈফিয়ত তলব করতে পারেন, যে কোনও ধরনের কাজ করতে বলতে পারেন, অসম্মান করতেও পারেন। এই অবমাননা থেকে বেরোনোর রাস্তা দেখাতে পারেনি নার্সদের নানা সংগঠন। অভয়া আন্দোলনে যুক্ত হয়ে নার্সরা ধীরে ধীরে বল-ভরসা গড়ে তুলছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন যে, এই সুযোগে ডাক্তারদের আন্দোলনের সঙ্গে নার্সদের আন্দোলন দানা বাঁধবে।
কিন্তু দেখা গেল, এক দিকে নারী-আন্দোলনের রাত দখল কার্যসূচি মানুষের দৃষ্টি ও সমর্থন আদায় করল, অন্য দিকে জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনগুলি তাদের সমস্যা ও বক্তব্যের সমর্থন পেল। চিকিৎসকদের শক্তি বোঝা গেল, যখন প্রশাসন তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হল। নার্সদের সে ভাবে খুঁজে পাওয়া গেল না, মিডিয়াও তাঁদের প্রতি আগ্রহ দেখাল না। নার্সরা যে ‘থ্রেট কালচার’ সহ্য করেন, সেই নির্মাণটাকে যেন এখনও অবধি স্পর্শই করা গেল না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)