E-Paper

দেওয়ালের অমোঘ লিখন

ট্রাম্পীয় আমদানি শুল্কের ফল কী হতে পারে? সমালোচকরা বলছেন, আমদানি শুল্ক বাড়ালে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হন, কেননা পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বিষয়টা কিন্তু এত সহজ নয়।

দেবর্ষি দাস

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ ০৭:২৪

আমেরিকান প্রেসিডেন্টের গদিতে পুনরধিষ্ঠিত হওয়া ইস্তক ডোনাল্ড ট্রাম্প আক্ষরিক অর্থেই যুগান্তকারী সব ঘোষণা করে চলেছেন। কী লক্ষণ এই যুগের, যা ট্রাম্প সাহেব সযত্নে উপড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কেনই বা তিনি এমন খড়্গহস্ত? তাঁর কার্যকলাপের সমালোচনা চলছে দুনিয়া জুড়ে— চড়া আমদানি শুল্ক নাকি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে সাধারণ আমেরিকানদের বিপদে ফেলবে। তা হলে ট্রাম্প নীতিগুলো চাপাচ্ছেন কেন?

বৃহত্তর আঙ্গিকে দেখলে, ট্রাম্পের নীতি দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চে আমেরিকার কর্তৃত্বের যুগকে গুটিয়ে আনছে। প্রায় একশো বছর আগেই— প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে— পরিষ্কার হয়ে আসছিল, গ্রেট ব্রিটেন আর পুঁজিবাদী দুনিয়ার শক্তিশালীতম দেশ নয়। অর্থব্যবস্থার বহর হোক বা নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ব্রিটেনের ক্ষমতার রাশ ক্রমশ শিথিল হচ্ছিল। ব্রিটেনের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য তখনও অটুট, কিন্তু নতুন উঠতি সাম্রাজ্যবাদীরাও হেলাফেলা করার মতো নয়। দুটো বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বোঝা গেল যে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রই অবিসংবাদী নতুন নায়ক। এ দিকে দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে নতুন দুশমন— সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া। বিশ্ব রাজনীতিতে এক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হল, যার পুঁজিবাদী পক্ষের শীর্ষে আসীন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।

দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানটা ছিল আর্থিক অব্যবস্থার সময়। দেশগুলোর মধ্যে কোন্দল বাড়ে, আমদানি শুল্ক লাগিয়ে পড়শি দেশকে পঙ্গু বানানোর ছক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯২৯ সাল থেকে আরম্ভ হল চরম আর্থিক মন্দা, যা চলল দীর্ঘ দশ বছর। বিশ শতকের প্রথম ভাগের দোলাচলের প্রভাব পড়ে দ্বিতীয় ভাগে আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপরে। ব্রেটন উডস চুক্তি মারফত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সচল রাখার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ আরম্ভ হল।

এর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ— ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার; বিশ্ব ব্যাঙ্ক; এবং জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড বা গ্যাট। সব ক’টিই বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান। উদ্দেশ্য, বিশ্ব অর্থনীতিকে সুস্থির, সচল রাখা, যাতে দেশগুলো বাণিজ্য কাজিয়ায় জড়িয়ে না পড়ে— বাণিজ্য অবাধ হোক, দেশগুলো আন্তর্জাতিক আঙিনায় ব্যক্তিগত পুঁজির গতিবিধিকে অবাধ ছাড় দিক, আমদানি শুল্ক কম রাখুক, রফতানি ভর্তুকি লোপ করুক। লক্ষ্য হাসিল করার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি করানো গ্যাট-এর কাজ। প্রতিষ্ঠানগুলোর পান্ডা হল আমেরিকা ও ইউরোপীয় বন্ধু দেশগুলো। ইতিমধ্যে, আমেরিকা মার্শাল প্ল্যান মারফত যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে বিপুল পরিমাণে অর্থসাহায্য দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক সম্পর্কে আমেরিকার ভাবমূর্তি চকচকে করায় এই বদান্যতাগুলো যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। সমাজবাদী হামলা থেকে বন্ধুদের বাঁচাতে আমেরিকান সেনার দুনিয়া জোড়া অতন্দ্র প্রহরা তো ছিলই।

পূর্ব ইউরোপের সমাজবাদী মোর্চার পতনের পরও এই কাঠামো বহাল তবিয়তে টিকে থাকে। সোভিয়েট ইউনিয়ন নেই মানেই যে পুঁজির ঘোড়া দুনিয়াময় ছুটতে পারবে, তা তো নয়। অনেক দেশে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বহুলাংশ সরকারের হাতে। ভারতের মতো একদা উপনিবেশগুলি প্ল্যানিং কমিশন বসিয়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পথে হেঁটেছে। উদ্দেশ্য, রাষ্ট্রের তৈরি অর্থনৈতিক নকশা অনুসরণ করে জনতার আর্থিক উন্নয়ন। আবার চিন, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ইসলামি সন্ত্রাসবাদী— এদের সামলানোর জন্য সামরিক পেশিশক্তিও চাই বইকি।

পুঁজিবাদী দুনিয়ার নেতার শিরোপা অতএব আমেরিকার মাথাতেই রইল, আমেরিকান ডলার রইল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাধারণ মুদ্রা। গ্যাটের কাজকর্ম আরও মজবুত, ব্যাপক, সুদূরগামী করার উদ্দেশ্যে তার জায়গায় এল ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। চিনও এই পুঁজিবাদী প্রকল্পে ঢুকে পড়ল। গত আশি বছরে পুঁজিবাদী দুনিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় কিছু অদলবদল হলেও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পুঁজির লেনদেন, উৎপাদন, রুজি-রোজগার, রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস এই কাঠামোর চার পাশে আবর্তিত হচ্ছে। এই আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর গোড়ায় এখন কুঠারাঘাত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন ‘মুক্ত দুনিয়ার সর্বোচ্চ নেতা’— আমেরিকান প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। দুনিয়াময় গেল-গেল রব তাই উচ্চগ্রামে।

ট্রাম্পের কুঠারাঘাতের অনেকগুলো দিক আছে। এই লেখায় দেখব শুধু আমদানি শুল্কের প্রসঙ্গটি। অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, কোনও দেশ যদি শুল্ক কমায় তা হলে দেশের ক্রেতারা বিদেশি পণ্য তুলনায় সস্তা দরে কিনতে পারবেন। সবার কল্যাণ হবে। কেউ উল্টো সওয়াল করতে পারেন, দেশের শ্রমিকরা পণ্য তৈরি করছিলেন, শুল্ক কমলে লোকেরা সস্তা বিদেশি জিনিস কিনবেন। দেশের শ্রমিকেরা ছাঁটাই হবেন। ক্রেতার কল্যাণ হল, কিন্তু শ্রমিকের পকেটে টাকা না থাকলে তাঁরা ক্রেতা হতে পারলেন না। তাঁদের কী কল্যাণ হল?

প্রত্যুত্তরে পণ্ডিতদের দুটো যুক্তি আছে। এক, তাঁরা ধরে নেন যে, দেশে বেকার শ্রমিক নেই— সাময়িক ভাবে যদি বা থাকে, তবু প্রত্যেকেই শেষ অবধি কাজ পেয়ে যায়। ধরুন, আমেরিকা ইস্পাত তৈরি করে, কিন্তু চিন তা তৈরি করে তুলনায় কম দামে। আমেরিকায় আমদানি শুল্কমুক্ত হল, আমেরিকানরা চিনা ইস্পাত কিনতে লাগলেন, আমেরিকান শ্রমিক ছাঁটাই হল। আবার, ব্যাঙ্ক পরিষেবা আমেরিকা সস্তায় দেয়। আমেরিকা চিনে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা রফতানি করল। আমেরিকান ইস্পাত শ্রমিক ব্যাঙ্কে চাকরি পেলেন। সবাই খুশি। পণ্ডিতদের এই যুক্তির সমস্যা হল, এত সহজে চাকরি বদলানো যায় না, বা পাওয়াও যায় না। ক্লাস বারো পাশ আমেরিকান ইস্পাত শ্রমিক রাতারাতি ব্যাঙ্কার হয়ে যাবেন কোন জাদুবলে?

দুই নম্বর যুক্তি, সরকার কর্মচ্যুতদের ক্ষতিপূরণ দেবে। মুক্ত বাণিজ্যের লাভ এত বিপুল যে, বেকারদের ক্ষতিপূরণ দিয়েও পুষিয়ে যাবে। এই যুক্তির সমস্যা হল, বিশ্বায়িত দুনিয়ায় সরকারের ভূমিকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকার রাস্ট বেল্টে ছাঁটাই সাদা শ্রমিকদের কোন সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে? মুক্ত বাণিজ্য থেকে মুনাফা পুঁজিপতি ও ক্রেতারা পকেটে পুরেছেন। কোটিপতিদের থেকে কর তুলে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা কেউ বলেনি, উল্টে শ্রমিক ইউনিয়ন দুর্বল করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি দেখিয়েছেন যে, ১৯৭০-২০১০ সালে ঘণ্টাপ্রতি নিম্নতম মজুরি, যা সরকার স্থির করে, ১০ ডলার থেকে কমে ৭.৫০ ডলার হয়েছে। আর্থিক অসাম্য বেড়েছে।

অতঃপর, কোটিপতিদের বন্ধু ট্রাম্প ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন। শ্রমিকদের আর্থিক বিপর্যয়ে বহিরাগতবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী রং মাখিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়া গণতন্ত্র— এই দুইয়ের টানাপড়েন কি ট্রাম্পের উত্থানের জন্য দায়ী? যত দিন পুঁজিবাদ আমেরিকান শ্রমিকদের জন্য কাজ তৈরি করেছে, দেশে গণতন্ত্র গড়গড়িয়ে চলেছে। আজ পুঁজিবাদ যথেষ্ট রোজগার তৈরি করতে পারছে না, আর গণতন্ত্র এমন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছে, যাঁর বিশ্বপুঁজির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা দেশের গণতন্ত্র, কোনওটির প্রতিই শ্রদ্ধা নেই।

ট্রাম্পীয় আমদানি শুল্কের ফল কী হতে পারে? সমালোচকরা বলছেন, আমদানি শুল্ক বাড়ালে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হন, কেননা পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বিষয়টা কিন্তু এত সহজ নয়। এক, কোনও বড় দেশ শুল্ক বসালে উৎপাদক দেশের উপরেও প্রভাব পড়ে, তার বিক্রি কমে যায়। চাহিদা কমার ফলে দাম কমে। দুই, আমদানি দ্রব্যের মূল্যে বিদেশি মুদ্রার ভূমিকাও আছে। আমেরিকা চিনা পণ্য কম কিনলে, চিনের মুদ্রা ইউয়ানের দাম ডলারের তুলনায় কমে যাবে। কাজেই, আমেরিকান ক্রেতার কাছে চিনা পণ্যের দাম শেষ অবধি কমতেও পারে।

অন্য দিকে, শুল্কের ফলে আমদানির দাম বাড়লে আমেরিকান ক্রেতারা নিজের দেশের পণ্য কিনবেন। পুঁজিপতিরা বিদেশের বদলে আমেরিকার মাটিতে কারখানা খুলতে আগ্রহী হবেন। আমেরিকার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হলে আমেরিকার কল্যাণ হয় বইকি। ট্রাম্প নিজের পাটোয়ারি বুদ্ধিতে রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতি আনছেন— এবং, তা করছেন বিচিত্র সব ট্রাম্পীয় স্টাইলে। তার মানে এই নয় যে, নীতিগুলোর অর্থনৈতিক যুক্তিকে এক কথায় নস্যাৎ করা যায়।

নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় দেওয়াল লিখন দেখা যেত, ডাঙ্কেল চুক্তি বাতিল করো, গ্যাট মুর্দাবাদ। টুপিওয়ালা স্যাম চাচার ছবি থাকত, আর উদ্যত আমেরিকান ইগল। যাঁরা লিখতেন, তাঁদের মনে বিশ্বায়ন, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির দৌরাত্ম্য নিয়ে আশঙ্কা ছিল। ত্রিশ বছর পর স্যাম চাচা এখন আলাদা রাস্তায় এগোচ্ছেন। ইতিহাসের পরিহাস এই, বিশ্বায়ন নিয়ে যে দক্ষিণপন্থী অবিশ্বাস আমেরিকার নীতিকে বদলাচ্ছে, তাকে বোঝার একটা উপায় হতে পারে ত্রিশ বছর আগের কলকাতার বামপন্থী দেওয়াল লেখকদের আশঙ্কাকে বোঝা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Donald Trump america

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy