E-Paper

নগদ মূল্যে কিনে আনা শিক্ষা

তখন রীতি ছিল, কলেজে ভর্তির সময় অন্যান্য বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছেলেমেয়েদের নম্বরের একটা অংশ কমিয়ে নেওয়া হত। বাংলা মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীরা তখনও প্রথম শ্রেণির নাগরিকের গৌরব অনুভব করত।

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫ ০৬:২০

বিভিন্ন বোর্ডের দশম-দ্বাদশ শ্রেণির ফলাফল, আর হরেক রকম প্রতিযোগিতামূলক প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের এই ঋতুতে আমাদের মতো কারও কারও হয়তো মনে পড়ে সময়ের হিসাবে মাত্র কয়েক দশক আগের— কিন্তু, মানসিক দূরত্বে বহু দূরের— কোনও এক সময়ের কথা। সে সময় শুধু পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিকে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়ের ছবি বেরোত কাগজে। কোন নামী বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছাত্র তারা, কোন বছর কলেজ স্ট্রিটের ঐতিহ্যবাহী ছেলেদের স্কুলকে ছাপিয়ে গেল মেয়েদের সবচেয়ে পুরনো স্কুলের ছাত্রীটি— সে কী খাতির!

তখন রীতি ছিল, কলেজে ভর্তির সময় অন্যান্য বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছেলেমেয়েদের নম্বরের একটা অংশ কমিয়ে নেওয়া হত। বাংলা মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীরা তখনও প্রথম শ্রেণির নাগরিকের গৌরব অনুভব করত। তার পর, বালি-ঘড়ি উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়াল। আমাদের ছেলেমেয়েরা মূলত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ল। তাদের সিলেবাস আমাদের অপরিচিত, অজানা। পড়ানোর ধরন অজানা। কথায় কথায়, প্রোজেক্ট করে আনার বায়নাক্কা অজানা। বাবা মা হয়ে, অভিভাবক হয়ে আমরা সব মেনে নিলাম।

সবচেয়ে বেশি মেনে নিলাম ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের আকাশছোঁয়া মাইনে। বিনা পয়সার সরকারি স্কুলে পড়া, বিনামূল্যে সরকারি স্কুলের বই পাওয়া আমরা প্রত্যেক মাসে বেশ কয়েক হাজার টাকা মাইনে তুলে দিলাম স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে। না পারলে, ধার করলাম। স্কুলের ভিতরের দোকান থেকে খাতা বই মোজা সব কিনলাম— বাজারমূল্যের থেকে অনেক বেশি দাম দিয়ে। নিজেকে বোঝালাম, একটি বা দু’টি মাত্র সন্তান, তার জন্য এতটুকু করতে পারব না?

নিজেও বুঝলাম, সন্তানও বুঝল যে, শিক্ষা জিনিসটা অবশ্যই কিনতে পারা যায়। যত দামি স্কুল, যত দামি কোচিং স্যর, তত ভাল লেখাপড়া। বহু আলোচিত কোচিং ও প্রশ্নপত্রের আঁতাঁত এই বোধকে আরও দৃঢ় করল। খুব নামীদামি স্কুলের ম্যাডাম সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়ান না, কিন্তু বাকিদের তো পড়ান। তাই যে বাবা-মা সন্তানকে সেই নামী স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি, তিনি সেই শিক্ষিকার কাছে প্রাইভেটে পড়ানোর জন্য অর্থ, স্বাস্থ্য, স্বাভাবিক জীবন সব পণ করলেন। সকালে দু’তিন প্রস্থ টিফিন নিয়ে বেরোনোর জীবন শুরু হল। ঘর ভাড়া করে, কাগজ পেতে মা’দের বসে থাকার জীবন, ‘তোর জন্য কত কষ্ট করছি’ এই বলে বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলিকে দুঃখিত করা, নিজ দুঃখিত হওয়ার জীবন শিকড় ছড়িয়ে ফেলতে লাগল সব সামাজিক স্তরে। অসম্ভব প্রতিযোগিতা নিজেদের মধ্যে, তা সন্তানদের মধ্যেও চারিত হল।

আর স্কুল পেরিয়ে যখন সর্বভারতীয় প্রবেশিকায় বসার সময় এল? শিকড় থেকে ডালপালা ছড়িয়ে সেখানে এসে দাঁড়াল বাজার ব্যবস্থা। আর্থিক উদারীকরণ জীবনের সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক দিন। সত্তর বা আশির দশকে জন্ম নেওয়া আমরা তাই নিয়ে দ্বিধায় ভুগেছি, তবু ঝলমলে থাকাটাকেই আঁকড়ে ধরেছি। মা-বাবার জন্য সময় নেই, বন্ধুর জন্য সময় নেই, বই পড়ারও সময় নেই। এতগুলো নেই-কে উন্নতির লক্ষণ বলে মেনে নিয়েছি। প্রথমে ক্লাস টেনে উঠলে ফোন কিনে দেওয়াটাকে স্বাভাবিক বলে গলাধঃকরণ করেছিলাম, এখন ক্লাস টু-তে স্মার্ট ফোন দিয়ে দিতে পারছি। অনলাইন ক্লাসের অজুহাত ব্যবহার করছে সন্তান, আমরাও।

আবারও অভিভাবক হয়ে, বাবা-মা হয়ে মেনে নিচ্ছি সব কিছু। সন্তান দেখছে, আমরা সব কিছু মেনে নিই। সন্তান যা চাইছে, যা বলছে সব মেনে নিচ্ছি— শুধু তার বদলে সন্তানের উপর একটা মোক্ষম শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছি: তোমাকে দারুণ রেজ়াল্ট করতেই হবে। তার বদলে সবেতেই আমাদের সায় আছে। “সামনে এনট্র্যান্স, আরও একটা দামি যন্ত্র যদি লাগে ভুল কিছু না।”

নব্বইয়ের দশকের আমরা জয়েন্টের চাপ দেখেছি। না পেলে তার হতাশা, কলেজে জেনারেল লাইনে পড়া, আবার পরীক্ষা দেওয়া, অপরাধবোধ— এই ছবি আমাদের চেনা। এখন এক অদ্ভুত রং যুক্ত হয়েছে এই ছবিতে। একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সর্বভারতীয় প্রবেশিকার পরীক্ষা কেন্দ্রে পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থাকার দৌলতে সেই করুণ ছবি দেখতে পেলাম। ভয়ঙ্কর লাগে, সতেরো-আঠারো বছরের ছেলেমেয়েগুলির মুখে পাথরের প্রতিচ্ছবি দেখা। ধীরে ধীরে যাচ্ছে, কোনও নির্দেশ শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রত্যেকের নির্দিষ্ট উত্তরপত্র। বার বার বলা সত্ত্বেও সে সম্পূর্ণ ভুল ভাবে উত্তরপত্র পূর্ণ করেছে। আমরা পর্যবেক্ষকরা চিন্তিত— অল্প সময় হাতে আছে, কী করা যাবে? ছেলেটিকে আশ্বাস দেওয়ার জন্য বললাম, চিন্তা কোরো না, দেখি কী করা যায়। কঠিন মুখে হালকা ব্যঙ্গের হাসি হাসল। হাত নাড়িয়ে ভঙ্গি করল— কিছু করার দরকার নেই। মনে পড়ল, একটু আগেই ছেলেটির মা’র সে কী উত্তেজনা। বারণ করা সত্ত্বেও দড়ি পেরিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢুকে পড়ছেন প্রায়।মনে হল, এ কী করলাম আমরা? ছেলেমেয়েগুলো তো কোনও দোষ করেনি। এখনই জীবন সম্পর্কে এত অনিচ্ছা?

প্রতিযোগিতার ফল বেরোল। বিজয়ীদের মুখ দেখলাম। ছেলেটির মতো আরও অনেক মুখ, উৎকণ্ঠিত বাবা-মায়ের মুখ অনেকটা অন্ধকার নিয়ে জেগে রইল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education system Education Sector West Bengal government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy