Advertisement
২২ মার্চ ২০২৩
Lost Homes

হারানো ভিটার খোঁজ

এই খোঁজ অবশ্যই একমাত্রিক নয়। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, হুগলি থেকে ওপার বাংলায় চলে যাওয়া কিছু মানুষের অতীতের মোহাচ্ছন্নতায় ডুবে থাকাও আছে।

village.

রাষ্ট্র-রাজনীতির খেয়াল-খুশিতে হাজার বছরের চেনা ভূখণ্ড মুহূর্তে অচেনা হয়ে যেতে পারে। প্রতীকী ছবি।

সেবন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৩ ০৫:৫৯
Share: Save:

এখনও আমরা দেশভাগ বিষয়ে বিখ্যাত লেখক, শিল্পী, ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক নেতাদের দিনলিপি ও অভিজ্ঞতার কথাই বেশি শুনি। শুনি কম সেই সব সাধারণ মানুষের কথা, যাঁরা সাদাকালো, ঝাপসা হয়ে-যাওয়া গ্রুপ ছবিতে নিজের ঠাকুরদা, দিদা, দাদুদের পরিচয় দিয়ে, কিংবা স্থানীয় স্কুল বা মন্দির, পুকুরের উল্লেখ, বিবর্ণ স্কুল সার্টিফিকেট দিয়ে পারিবারিক কাহিনির টুকরো-টাকরা জুড়ে এক স্মৃতির গল্পমালা রচনা করছেন।

Advertisement

কিছু দিন আগে দুই বাংলার উদ্বাস্তুদের হারিয়ে যাওয়া গৃহের খোঁজের জন্যে তৈরি হয়েছে একটি সোশাল নেটওয়ার্কিং গ্রুপ। তৈরি হতেই সাড়া ফেলে দেয় গ্রুপটি। বাঙালির ভিটার সন্ধানে সেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত, আন্দামান থেকে মধ্য ভারত, ঝড়ের মতো আর্তি আছড়ে পড়ে। ভুল বানানে আবেগদীপ্ত চিঠি, ভাঙা পালঙ্ক, এমনকি কানের দুল, চুড়ির ছবি দিয়ে দেশকে খোঁজার, শিকড়ের সন্ধানের আকুতি দেখে মনে হয়, বস্তুবিশ্বের চেয়ে মানুষের কল্পনার বাস্তবতা কিছু কম নয়, বরং বেশি। কেউ লিখছেন, “আগামী রাষ্ট্রপতি আমার বাবার ছাত্র”, সঙ্গে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির শৈশবের ছবি। ঠাকুমার মুখে শোনা স্থানীয় কোনও চাঞ্চল্যকর ঘটনা, বা প্রবাদের উল্লেখ করছেন কেউ। উল্লেখযোগ্য বিষয় এই, গ্রুপে বয়স্কদের সঙ্গে যুবক-যুবতীরাও দু’হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের স্থানীয়দের সাহায্যে পূর্বজদের ভিটা দেখতে রওনা দিয়েছেন অনেকে। তাঁদের বেশির ভাগই অভূতপূর্ব আতিথেয়তা পেয়ে আপ্লুত। একখানি ভাঙা পাঁচিল বা শেওলা-ধরা পুকুর ঘাট, বটের ঝুরি-নামা কৃষ্ণ মন্দিরের সামনে সগর্বে, হৃষ্টচিত্তে ফেলে-আসা গল্প খুঁজে পেয়েছেন। এক জন ঝাপসাপ্রায় ছবিতে এক বৃদ্ধকে দেখিয়ে লিখেছেন, শেষ জীবনে শয্যাশায়ী মানুষটি হার্টের ডাক্তারকে বলেছেন, “এই সব ঔষধে রোগ সারব না, দ্যাশে নিয়া গেলেই সুস্থ হমু।” কেউ এক জন সরাসরি না লিখে কাল্পনিক কাহিনির ঢঙে লেখার চেষ্টা করেছেন, আন্দামান থেকে অমুক সরকার, তাঁর ঠাকুরদা জাতে কৈবর্ত, কাজে সর্দার, পূর্ব পাড়ার মৈনুদ্দির সঙ্গে এক জমিদারের জিম্মাদার ছিলেন। সম্পত্তি আগলানোর জন্য লাঠিয়াল জীবনের কত যৌথ স্মৃতি, ফিরে আবার সেই মৈনুদ্দিকে দেখতে চাইছেন।

এই খোঁজ অবশ্যই একমাত্রিক নয়। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, হুগলি থেকে ওপার বাংলায় চলে যাওয়া কিছু মানুষের অতীতের মোহাচ্ছন্নতায় ডুবে থাকাও আছে। শুধু ইট-মাটির ভিটার নয়, শৈশবের বন্ধুদের খোঁজও করছেন অনেকে। ওপার বাংলা থেকে জনৈক জাহানারা লিখছেন, তাঁর বান্ধবী ছিল মণিকা বিশ্বাস। লিখছেন, “সে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছে, তাকে আমার খুব মনে পড়ে, তুই যদি কখনও এ লেখা পড়ে থাকিস তবে মনে রাখিস, আমি তোকে এখনও অনেক মিস করি।” কেউ লিখছেন, প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন শেখা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত এমন ভাবে মাথায় গেঁথে গিয়েছে যে, যখন পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে হল তখন আর নতুন জাতীয় সঙ্গীত মুখস্থ হল না।

নব ভূখণ্ডে গৃহে থিতু হওয়া পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ঠাকুমা-ঠাকুরদার বলা তুচ্ছাতিতু্চ্ছ কাহিনি নিছকই গল্পে পরিণত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আদতে তা ঘটল না। গুমোট ভাব কেটে হাওয়া চলাচল শুরু হল। এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে খোলাখুলি কথা শুরু হলে খানিক বিতর্কিত মন্তব্য চালাচালি হবেই। এ ক্ষেত্রেও হচ্ছে। কিন্তু মরমি কথার ভিড় এতই যে, সীমা অতিক্রমের আগেই কুকথা গৌণ হয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

গৃহ মানুষের বুকেই থাকে। রাষ্ট্র-রাজনীতির খেয়াল-খুশিতে হাজার বছরের চেনা ভূখণ্ড মুহূর্তে অচেনা হয়ে যেতে পারে। এই যেমন বছরখানেক আগে শুরু-হওয়া প্রতিবেশী দু’টি দেশের অনর্থক যুদ্ধ। যেন বার বার ফিরে আসে মহাভারতের যুদ্ধের সেই অসহায় প্রশ্ন। দেখি, অবিকল কৃষ্ণের কাছে অর্জুনের আর্তির মতো প্রশ্ন ভেসে আসে, কার বিরুদ্ধে লড়বে আজ? শ্বশুরমশাই ইউক্রেনীয়, জামাই মস্কোবাসী, শিক্ষক রুশ, আর তাঁর প্রিয় ছাত্রেরা কিয়েভ-এর মানুষ, দুই বোন দুই দেশে সংসার পেতেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের স্বামী-পুত্র পরস্পরের মুখোমুখি। কোথায় যায় মানবাধিকারের বারো নম্বর অনুচ্ছেদে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি— পারিবারিক বসতবাড়ির ব্যাপারে খেয়ালখুশি মতো হস্তক্ষেপ বা আক্রমণ করা চলবে না?

বাংলার ভিটা খোঁজার গ্রুপে বাঁকা মন্তব্যের নীচে নব্বইয়ের দশকে জন্মানো এক দল যুবক-যুবতীর ভুল বানানে ও এলোমেলো বাক্যের উত্তর থাকে, যার সারাৎসার— আপনাদের গৃহচ্যুত আমরা করিনি, যাঁরা করেছেন তাঁদের কিছু বলার অধিকার আমার পূর্বজদের ছিল না। তাঁদের প্রতিবেশী বন্ধুদের হাত তাঁরা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সবাই লুটেরা, নৃশংস হত্যাকারী ছিলেন না, শুধু ছিলেন ক্ষমতাহীনের দলে। পড়ে মনে হয় অতীত মনে রেখেই আমরা কথা তো শুরু করতে পারি। কথা ছাড়া আমরা আর কোন কাল্পনিক সঙ্কেতে হারিয়ে-ফেলা ভিটার স্মৃতি জাগরূক রাখতে পারব?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.