Advertisement
০৯ মে ২০২৪
পুরুষ-প্রতাপী রাজনীতির এক প্রবল প্রতিস্পর্ধী
Sarala Devi Chaudhurani

‘সিংহাসনটা ছেড়ে দাও’

গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতৃত্ব থেকে রাজ্যের রাজনীতিতে উঠে এসেছেন, বিধায়ক কি সাংসদ হয়েছেন, নিদেনপক্ষে দলের জেলা সম্পাদক হয়েছেন, এমন একটা মেয়ে কোনও রাজনৈতিক দল দেখাক দেখি?

An image of Sarala Devi Chaudhurani

সরলা দেবী চৌধুরাণী। —ফাইল ছবি।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩ ০৪:৫০
Share: Save:

পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় মহিলা সংরক্ষণের সাড়ে তিন দশক পার করল পশ্চিমবঙ্গ। তাতে হলটা কী? গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতৃত্ব থেকে রাজ্যের রাজনীতিতে উঠে এসেছেন, বিধায়ক কি সাংসদ হয়েছেন, নিদেনপক্ষে দলের জেলা সম্পাদক হয়েছেন, এমন একটা মেয়ে কোনও রাজনৈতিক দল দেখাক দেখি? ক্ষমতার যে তোলাপাড়ার মধ্যে সরকারের নীতি তৈরি হয়, সেখান থেকে অতি যত্নে মেয়েদের দূরে রাখে রাজনীতি। আশা ছিল, সংরক্ষণ মেয়েদের জন্য রাজনীতির দরজা খুলে দেবে। দেখা গেল, সংরক্ষণের বেড়া দিয়ে খোঁয়াড় তৈরি করেছে দলগুলো। পাঁচ বছর অন্তর এক পাল মেয়েকে বার করা হয়, আর এক পাল মেয়ে ঢোকানো হয়। এই তো দেখা গেল, এক মহিলা জেলা সভাধিপতিও দলের টিকিট পাননি। নির্দল হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, তা-ও শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন— আন্দাজ হয়, স্বেচ্ছায় নয়। লড়াই করে যাঁরা দলে জায়গা করে নিয়েছেন, তেমন ক’জন মেয়ে রাজনীতিতে টিকে হয়তো যান। তাঁদের গলা পাওয়া যায় কি?

এই রাজনীতি বেশ ভাল বুঝেছিলেন ঠাকুরবাড়ির এক মেয়ে। প্রায় আশি বছর আগে সরলা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭২-১৯৪৫) লিখেছিলেন, “রাজনীতি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে কোন পুরুষ কোন মেয়ের জন্য সিট ছাড়তে পরাঙ্মুখ, সবই আপকে ওয়াস্তে— তাই অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি থেকে শুরু করে বেঙ্গল কৌন্সিল অ্যাসেম্বলি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য গুটিকত আলাদা সিট নির্ধারিত করা হয়েছে, সেই কটি দখলের জন্য মেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে যত চাও লড়াইদাঙ্গা, আঁচড়াআঁচড়ি কামড়াকামড়ি কর তাতে পুরুষের আপত্তি নেই...। কিন্তু মেয়েরা যদি পুরুষ দেবতাকেই বলে বসেন, ‘তোমার সিংহাসনটাই আমায় ছেড়ে দাও না ভাই’— তা হলেই বিপদ, তা হলেই পুরুষের পৌরুষ বেরিয়ে পড়ে চোখ রাঙা করে বলে, ‘কভি নেই’।” (জীবনের ঝরাপাতা)

এই প্রখর রাজনৈতিক চেতনা সরলার পরিচয়। ১৯৩১ সালে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনের পাশাপাশি মহিলা কংগ্রেস নেত্রীদের অধিবেশন হয়েছিল। সেখানে সরলা বলছেন, কেবল আইনভঙ্গের আন্দোলনে মেয়েদের ডাক পড়ে, আইন তৈরি করার সময় কাউন্সিল হল, কমিটি, সাব-কমিটির পদগুলো ছেলেদের দিয়ে ভরা হয়। বিদ্রুপের কশাঘাত করে বলছেন, কংগ্রেসকে কত না ঠেলা দিয়ে চাষি ও মজুরদের অধিকার সনদ ঘোষণা করেছেন পণ্ডিত নেহরু। এ দিকে যারা জনসংখ্যার অর্ধেক, সেই মেয়েরা প্রতীক্ষায় আছে এক ‘পণ্ডিতানীর’ যিনি কংগ্রেসকে আর একটু ঠেলে মেয়েদের অধিকারের সনদটা বার করবেন।

নিজেই মেয়েদের ‘মৌলিক অধিকার’-এর তালিকা দিয়েছেন সরলা, ওই বক্তৃতাতেই। তার প্রথম দু’টি ছিল, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে, স্বামীর উপার্জনে স্ত্রী, কন্যা ও বোনেদের অধিকার। তৃতীয়টি ছিল সন্তানে সমানাধিকার। আর চতুর্থটি ছিল আইনসভা, পুরসভা থেকে লিঙ্গবৈষম্যের জন্য মেয়েরা যাতে বাদ না পড়ে, তা নিশ্চিত করা। যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন সরলা। রামমোহন রায় লিখেছিলেন, সম্পত্তি থেকে মেয়েদের বঞ্চনাই সতীদাহের আসল উদ্দেশ্য (১৮১৮-১৯)। সরলা মেয়েদের সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নটিকে নিয়ে এলেন জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে। সেই সঙ্গে বললেন, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি মেয়েদের ‘মৌলিক অধিকার’। এর পঁয়ষট্টি বছর পরে সংসদে পেশ হয় মহিলা বিল, আজও যা পাশ হয়নি।

পাশাপাশি, মেয়েদের ‘মৌলিক কর্তব্য’ কী কী, সেই তালিকার চার নম্বরে সরলা রেখেছিলেন, ‘রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা বর্জন’। গোটাকয়েক মেয়ে রাজনীতি করবে, এমন নয়। প্রতিটি মেয়ে সক্রিয় হবে রাজনীতিতে। সরলা নিজেকে ‘নারীবাদী’ বলে ঘোষণা করেননি কখনও, ভারতের নারীবাদীরাও সরলাকে তেমন আপন করে নেয়নি। অথচ, সরলাই প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম সর্বভারতীয় নারী সংগঠন, ‘ভারতীয় স্ত্রী মহামণ্ডল’ (১৯১০)। সেই উপলক্ষে তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ভারতে মেয়েদের লড়াই হল পুরুষদেরও লড়াই (দ্য উইমেন্স কজ় ইজ় দ্য মেনস কজ়)। তখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছর। ষাটের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সেই সরলা কংগ্রেসের মহিলা অধিবেশনে বলছেন, পুরুষরা মেয়েদের অনুগ্রহের পাত্র বলে মনে করে, তাই পুরুষের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাখ্যান করতে হবে মেয়েদের। পুরুষের সমান মর্যাদা চাইতে হবে সব মেয়ের জন্য। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী, দুই যুগপুরুষকে কাছ থেকে জেনেছেন যে সরলা, তাঁর কাছ থেকেই এল পুরুষের নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যানের আহ্বান।

সরলার জীবনের জানলা থেকে রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধীর দিকে তাকালে তাঁদের দেখতে একটু অন্য রকম লাগে। রবীন্দ্রনাথের ন’দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা, ‘রবিমামা’-র চাইতে এগারো বছরের ছোট। এই ভাগ্নিটির প্রতি বিরূপতা রবীন্দ্রনাথ বার বার প্রকাশ করেছেন— কখনও প্রকাশ্যে সরলার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন (সরলার ‘বিদেশি ঘুষি বনাম দেশি কিল’ নিবন্ধের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘ঘুষাঘুষি’), কখনও ঘনিষ্ঠদের কাছে নালিশ করেছেন (প্রমথ চৌধুরীকে লিখছেন, “সরলা কিছুদিন শান্তিনিকেতনে ঘোরতর মিশনারিগিরি করে গেছে”)। সরলাকে আবেগসর্বস্ব, অপরিণতবুদ্ধি বলে দেখানোর চেষ্টা রবীন্দ্রপরিমণ্ডলে বরাবরই রয়েছে। তরুণী সরলার জাতীয়তাবাদী রাজনীতি রবীন্দ্রনাথের অপছন্দ ছিল। হয়তো অন্য কারণও আছে। রানী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “দয়া সেবা লালন পালন এতেই তোদের সত্যিকার রূপ প্রকাশ পায়।... বাইরের দিক থেকে মেনে নেওয়াকে বলে ‘অপমান’। কিন্তু আসলে হৃদয়ের দিক থেকে এর মস্ত সম্মান।” অপমান গিলে ‘সম্মানিত’ বোধ করা সরলার ধাতে ছিল না। তিনি বেথুনের গ্র্যাজুয়েট, ঠাকুরবাড়ির প্রথম মেয়ে যিনি চাকরি করেছেন, সাতাশ বছর বয়সে একাকী ভারতী পত্রিকার সম্পাদনার দায় নিয়েছেন।

সরলার সবল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন গান্ধী। জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনার পরে তিনি লাহোরে সরলার শ্বশুরবাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন। সরলা চরকা ও খদ্দরের প্রচারে নামেন, তিনিই প্রথম খদ্দরের শাড়িকে ‘ফ্যাশনেবল’ করেন। সরলার সঙ্গ কামনা করে গান্ধীর চিঠিগুলি (১৯২০) গান্ধী-ঘনিষ্ঠদের অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। আজ চিঠিগুলি পড়লে অস্বস্তি জাগে অন্য কারণে— আটচল্লিশ বছরের সরলাকে গান্ধী অনায়াসে ‘স্কুলগার্ল’ বলছেন। বিধান দিচ্ছেন, সরলাকে নিজের হাতে ঘরের কাজ করতে হবে। অন্য দিকে, অসহযোগ আন্দোলন, অহিংস রাজনীতি নিয়ে সরলার সব প্রশ্নকে এড়িয়েছেন, বলছেন সরলা ধৈর্যহীন, জটিলমনা। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের প্রতি সরলার ‘কমপ্লিট সারেন্ডার’ চেয়েছিলেন গান্ধী, পাননি। কয়েক মাসের ব্যবধানে ‘মাই ডিয়ারেস্ট সরলা’ সম্বোধন হয়ে উঠেছে ‘টু সরলা দেবী চৌধুরাণী’। তার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছে চিঠির ধারা।

গান্ধী যখন ভারতীয় রাজনীতির শীর্ষে, তখন সরলা জনসভায় বলছেন, “...অহিংসা মন্ত্র নিয়ে ঘরে বসে থাকলে সকলেরই যে মন্ত্রসিদ্ধি হবে, তা আমি বিশ্বাস করিনে। উল্টা ছলনায়, রাশি রাশি কৃত্রিম মহাত্মায় দেশ ভরে যাবে— অহিংসাবাদীদের বুকের ভিতর সাতপুরু ঢাকনায় ঢাকা হিংসা নানা ছুতোয় বেরিয়ে আসবে...” (ঢাল, ১৯২৫)। সরলা খদ্দর গ্রহণ করেছিলেন, অহিংস আন্দোলন নয়।

যতই জ্ঞানীগুণী হোক না কেন, মেয়েরা বেসুরো হলে হয় ধমকে থামানো হয়, না হলে কথায় কান না দিয়ে বোঝানো হয়, এ বার এসো। শ্রমিক নেত্রী সন্তোষ কুমারী থেকে বাম নেত্রী মণিকুন্তলা সেন, যে মেয়েরা নিজের শর্তে, নিজের বিবেচনায় রাজনীতি করেছেন, তাঁদের জীবদ্দশাতেই হারিয়ে যেতে হয়েছে। সরলাও ১৯৩৫ সালে, মৃত্যুর দশ বছর আগে, সরে গিয়েছিলেন জনজীবন থেকে। তাঁর আত্মকথা জীবনের ঝরাপাতা অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। তাঁর জীবন ও রচনা নিয়ে বাংলায় একটিমাত্র পূর্ণাঙ্গ বই লেখা হয়েছে (আহিতাগ্নিকা, দেবারতি চক্রবর্তী)। ভারতী রায়, জেরাল্ডিন ফোর্বস-এর মতো অল্প ক’জন গবেষক খোঁজ করেছেন সরলার।

যে রাজনীতি মেয়েদের খাতায়-কলমে ‘জনপ্রতিনিধি’ করে আসলে বর-শ্বশুরের প্রতিনিধি করে রাখে, মেয়েদের নিজের কথা, নিজের কাজকে জায়গা দিতে চায় না, তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে ফিরে দেখা চাই সরলাকে। প্রতিপক্ষকে যেমন চিনেছিলেন তিনি, তেমন আর কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sarala Devi Chaudhurani
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE