Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Air pollution

‘লাস্ট নই’ এটাই কি যথেষ্ট

আসলে শুধু দিল্লির দূষণের সঙ্গে অঙ্কের হিসাবে পাল্লা দিলে হবে না। প্রয়োজন, দিল্লি যে ভাবে দূষণ কমাতে আইনের প্রয়োগ করছে, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া।

কলকাতা শহরের মধ্যেই তৈরি হয় মোট দূষণের আশি শতাংশ।

কলকাতা শহরের মধ্যেই তৈরি হয় মোট দূষণের আশি শতাংশ। ফাইল চিত্র।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫৭
Share: Save:

দূষণ নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে দিল্লি বনাম কলকাতার দূষণ সংক্রান্ত বিতর্ক হামেশাই ওঠে। সম্প্রতি দেখা গেল, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তথ্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, দিল্লির তুলনায় কলকাতার বায়ুদূষণ কম। আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, অন্য সব বড় শহরকে ছেড়ে দিয়ে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে দেশের ‘লাস্ট বয়’ দিল্লির সঙ্গে কেন তুলনা করা হবে কলকাতার; বিশেষত যেখানে অবস্থানগত ভাবে দিল্লির সঙ্গে কলকাতার অনেক তফাত? কলকাতার দূষণ কী ভাবে কমাতে হবে সেই আলোচনায় না ঢুকে কেন দিল্লির সঙ্গে দূষণ তরজায় মাতছি আমরা? না কি, এই ক্ষেত্রে ‘আমরা অন্তত লাস্ট নই’, এই কথাটা প্রমাণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য!

দিল্লির সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক রিপোর্টে পর্ষদ নিজেই মেনে নিয়েছে যে, ২০২২ সালের জানুয়ারি অবধি পর পর তিন শীতে, যার মধ্যে কোভিডের কারণে অনেকটা সময় পুরোপুরি বা আংশিক লকডাউন ছিল, কলকাতার বাতাসের গড় মান (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) ছিল ‘খারাপ’; দিল্লির ‘খুব খারাপ’-এর ঠিক আগের ধাপে। ‘খারাপ’ বাতাসে অনেক ক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে সুস্থ মানুষও শ্বাসকষ্টে ভুগতে পারেন। মনে রাখা প্রয়োজন যে, এটা গড় এবং মাঝেমধ্যেই এই মাত্রা শহরের কোনও কোনও অঞ্চলে ‘খুব খারাপ’ ছাড়িয়ে গুরুতর পর্যায়ের শেষ ধাপ অবধিও পৌঁছে যায়। যেমন— ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় বিধাননগর অঞ্চলের বাতাসের মান পৌঁছে গিয়েছিল ৫০০-তে, যার থেকে দূষিত বাতাস মাপার ক্ষমতা যন্ত্রের নেই!

সরকারি তথ্য জানাচ্ছে যে, এই বছরের শীতে গোটা কলকাতায় পিএম ২.৫-এর গড় ইতিমধ্যেই দেশের সর্বোচ্চ অনুমোদিত সীমার প্রায় ৪০ শতাংশ উপরে। বাকি রাজ্যের অবস্থাও তথৈবচ। হাওড়া থেকে আসানসোল হয়ে শিলিগুড়ির দূষণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এবং কালিম্পং বাদ দিলে রাজ্যের সব জেলাই সূক্ষ্ম ধূলিকণার হিসাবে দেশের অনুমোদিত দূষণমাত্রার সাধারণত উপরে থাকে। ফল, বহু মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছেন বা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন; বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা পত্রিকা লান্সেট বলছে, যদি পশ্চিমবঙ্গ পিএম ২.৫-কে কমিয়ে অনুমোদিত সীমার আশপাশে আনে, তা হলে এই রাজ্যের মানুষ গড়পড়তা আরও দু’বছর বেশি বাঁচতে পারবেন!

এটা মানতে হবে যে, এই বিপুল দূষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাজ্য সরকারের উপর বর্তায় না। কেননা, অবস্থানগত কারণেই গোটা গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে শীতকালে দূষণ বাড়ে। এবং কলকাতা তথা বাংলা সেই প্রবণতার বাইরে নয়। কিন্তু সরকারি দফতরগুলির দায়িত্বও অনেকখানি। তাই দূষণ কমাতে শুধুমাত্র নিত্যনতুন পরিকল্পনা ঘোষণা আর অন্যের কোর্টে বল ঠেললেই চলবে না, মাঠে নেমে কাজ করতে হবে। সম্প্রতি বলা হচ্ছে যে, রাজ্যের দূষণের প্রায় অর্ধেক আসে রাজ্যের সীমানার বাইরে থেকে; এমনকি সে দূষণ আটকাতে রাজ্য দূষণ পর্ষদ সীমান্তে গাছের দেওয়াল তোলার কথাও বলছে। যদিও এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন যে, গাছ লাগিয়ে অন্যান্য সুবিধা হলেও সীমানার বাইরে থেকে আসা বায়ুদূষণকে আটকানো যায় না। কিন্তু এক বারও বলা হচ্ছে না যে, বাংলা কোনও ব্যতিক্রম নয়, গড়পড়তা গোটা দেশেই, শতাংশের হিসাবে, এ রাজ্যের সমান মাত্রায় বাইরের দূষণ ঢোকে; অন্তত ১৩টি রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি পরিমাণে। বলাহচ্ছে না যে, কলকাতার ক্ষেত্রে বাইরে থেকে আসা দূষণ মোট দূষণের কুড়ি শতাংশ মতো। অর্থাৎ, কলকাতা শহরের মধ্যেই তৈরি হয় মোট দূষণের আশি শতাংশ।

শহর তথা রাজ্যের এই দূষণকে সামাল দিতে গেলে যে পরিবহণ, নির্মাণকার্য বা শিল্পদূষণ কমানোর উপর জোর দিতে হবে, সেটা বুঝতে বিজ্ঞানী হতে হয় না। প্রায় পনেরো বছর আগে আদালতের রায়ে বাতিল হওয়া বাণিজ্যিক গাড়ি এখনও সদর্পে ঘুরছে; বার বার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও পরিবেশবান্ধব সিএনজি আজ অবধি কলকাতায় ঢুকল না; ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রকল্পে ফিরিয়ে আনার কথা বললেও ট্রামকে ক্রমে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে; এক দিকে কয়েকশো কিলোমিটার জুড়ে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা হচ্ছে, অন্য দিকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রকল্পে নিয়মমাফিক গাছ না লাগানোর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা করা হচ্ছে না; নির্দেশ থাকলেও শহর ও রাজ্যের অধিকাংশ নির্মাণকার্য পরিবেশ আইন মানে না।

আসলে শুধু দিল্লির দূষণের সঙ্গে অঙ্কের হিসাবে পাল্লা দিলে হবে না। প্রয়োজন, দিল্লি যে ভাবে দূষণ কমাতে আইনের প্রয়োগ করছে, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। নয়তো শীতের পর শীত, বছরের পর বছর কেটে যাবে। কিন্তু কলকাতা তথা রাজ্যে দূষণ কমানোর ‘দিল্লি’ চিরকাল দূর অস্ত্ই থেকে যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Air pollution Kolkata Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE