Advertisement
১১ মে ২০২৪
ঢেউ উঠবে, কারা টুটবে
Charlie Chaplin

অবিশ্রান্ত মিথ্যাভাষণ কেমন ‘দৈববাণী’ হয়ে ওঠে, দেখিয়েছেন হিটলার-বেশী চ্যাপলিন

এই দেশের শিল্পীরা ক্রমশ একা হয়ে পড়ছেন, রুদ্ধদ্বার ঘেরাটোপে নজরবন্দি তাঁরা। বিজেপি সরকার শিল্পীদের পরস্পরের থেকে, জনসাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে।

কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২১ ০৫:০০
Share: Save:

কৌশিক সেন: এ এক বিপন্ন পরিস্থিতি। আমাদের রাষ্ট্র চাইছে শিল্পচিন্তা রুদ্ধ করতে, আটকাতে চাইছে শিল্পী ও তাঁর শিল্পকর্মকে। মানুষের আর্ত চিৎকার যাতে শিল্পের চৌহদ্দিতে পৌঁছতে না পারে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে। শ্রীজাতর লেখা সম্প্রতি মঞ্চস্থ কবির বন্ধুরা নাটকের কথা ভাবছি যেখানে রাষ্ট্র বন্দি করে রেখেছে এক কবিকে।

সুমন মুখোপাধ্যায়: এ সেই পরিস্থিতি যেখানে দেশের শিল্পীদের সঙ্গে সংঘাত চলে দেশের শাসক দলের। ঠিক যেমন বর্তমান ভারতে শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশকে দুর্বিষহ করে তুলেছে রাষ্ট্র। আসলে, শিল্পীদের দু’ভাবে বন্দি করা যায়: শারীরিক ভাবে, আর কণ্ঠরোধ করে। তাঁদের ‘মগজে কার্ফু’ করে রাখা হয়, ভিন্ন স্বর সহ্য করা হয় না, নির্ধারিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাইরে কোনও ভাবনা বরদাস্ত করা হয় না। কেবল নাম শুনেই নিষেধাজ্ঞা জারি। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে আইপিটিএ নাট্যোৎসবে বিজয় তেন্ডুলকরের জাত হি পুছো সাধু কি নাটকের অভিনয় বন্ধ করা হল, তাকে ‘অ্যান্টি-হিন্দু’ ‘অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান’ বলল বজরং দল। পুলিশ-প্রশাসন কিছুই করল না, তাদের পক্ষপাত হামলাকারীর দিকেই।

কৌশিক: এই দেশের শিল্পীরা ক্রমশ একা হয়ে পড়ছেন, রুদ্ধদ্বার ঘেরাটোপে নজরবন্দি তাঁরা। বিজেপি সরকার শিল্পীদের পরস্পরের থেকে, জনসাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে। সুমন: দেখো, আগে কিন্তু শিল্পীরা সঙ্ঘবদ্ধ ছিলেন। তাঁরা নিজেদের শিল্পসঞ্জাত কৌম বা সঙ্ঘের এক জন মনে করতেন, সেখানে নির্ভয়ে নিজস্ব শিল্পভাবনা প্রকাশ করতেন। তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক মতের ভিন্নতা ছিল, কিন্তু মতান্তর সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের শিল্পগত অবস্থান থেকে নড়তেন না, পারস্পরিক সৌহার্দ থেকেও সরতেন না। কিন্তু দেশের শাসক দল এখন এমন এক ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করেছে যেখানে শিল্পীরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন, রাজনৈতিক সন্ত্রাসে নিজস্ব অবস্থান অটুট রাখতে পারছেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানির নাৎসি পার্টি এমন পরিস্থিতিই তৈরি করে। দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শিল্পীরা, ব্রেশ্‌ট লেখেন ফিয়ার অ্যান্ড মিজ়ারি অব দ্য থার্ড রাইখ নাটক।

কৌশিক: এ রাজ্যে বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর, এই দুই সময়েই ক্ষমতাদর্পী কিছু মানুষ আমাদের থিয়েটার কমিউনিটির মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেন। টানা লড়াই করে নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের পরিসর ধরে রাখতে পেরেছি। বিজেপি এ রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সেটুকুও মুছে যাবে। কিছু দিন আগে ত্রিপুরার প্রাক্তন বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী এ রাজ্যে এসে তৃণমূলের যথেষ্ট সমালোচনা করেও বললেন, বিজেপিকে একটি ভোটও নয়, বিজেপি-আরএসএস শাসক হিসেবে কত ভয়ঙ্কর তা দেখতে ত্রিপুরায় আসুন, মানুষের সঙ্গে কথা বললেই টের পাবেন।

সুমন: এত দিনে বুঝে যাওয়ার কথা, বিজেপি কী ভাবে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ থেকে শিক্ষাব্যবস্থা, সব কিছুকেই ধসিয়ে দিচ্ছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পৃথিবীর কোথাও কোনও দেশে উন্নয়ন হয়েছে কি? সংখ্যালঘু থেকে প্রান্তিক মানুষ এ দেশে এখন বিচ্ছিন্ন বোধ করেন, যা অত্যন্ত দুঃখের, লজ্জার। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিক্ষাক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে যে জায়গা করে নিয়েছিল ভারত, তাকে কোথায় টেনে নামানো হচ্ছে আজ?

কৌশিক: অর্থনীতিরও কোনও উন্নয়ন হয়নি। এত লাগাতার রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমাদের উন্নয়নের পরিকাঠামোকেও সেটা ভেঙে ফেলছে। পরিযায়ী শ্রমিক থেকে কৃষক, সকলে বিপন্ন। দীর্ঘ সময় ধরে, দুঃসহ শীতেও কৃষকরা যখন তাঁদের আন্দোলন থেকে এক পা-ও পিছোননি, সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্রও তাঁদের আন্দোলনকে বিভক্ত করতে পারেনি, তখন তাঁদের বলা হল ‘দেশদ্রোহী’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘বিদেশি মদতে পুষ্ট’। নোট বাতিল থেকে নাগরিক আইন প্রবর্তনের ভয়ানক পরিণাম তো আমাদের জানা। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে গোটা দেশের অর্থনীতিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা, এই তো নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক চেহারা!

সুমন: এই সরকার শুধুই আইন পাল্টে দিচ্ছে, নিজেদের ইচ্ছেমতো আইন চালু করছে, যাতে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বলতে পারে: আইন ভেঙেছ, তোমার কোনও রাজনৈতিক অধিকার নেই! এ যেন ঔপনিবেশিক শাসনকাল, আগে আইন তৈরি করো, তার পর ধরে এনে মারো। সিএএ-র মতো আইন প্রকাশ্যে ‘বহিরাগত’র কথা তুলে ভিতরে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষকে প্রায় জাতিবৈরিতার স্তরে নিয়ে গিয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশ মানবাধিকার বা পরিবেশ বিষয়ক যে রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচগুলি অর্জন করেছিল, নরেন্দ্র মোদী সরকার সেগুলি ধ্বংস করছে, স্বভূমি ও নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে মানুষকে উৎখাত করে চলছে।

কৌশিক: শাসক দল হিসেবে তৃণমূলের থাকাটাই ঠিক, এও যেমন বলতে পারছি না, তেমনই আফসোস এই, কোনও বিকল্পের খোঁজও পাচ্ছি না। বিকল্প হিসেবে সর্বাগ্রে বামপন্থীদের কথাই মনে আসে, কিন্তু তাঁরা তো দু’টি ক্রাচ নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন: একটি কংগ্রেস, অন্যটি আব্বাস সিদ্দিকির দল। নিজেদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েই নির্বাচনে দাঁড়ালে, নিজেদের নীতি-আদর্শ নিয়ে লড়াই করলে, পরাজিত হলেও একটা উজ্জ্বল ছবি থেকে যেত। তা না করে তাঁরা হাত মেলাচ্ছেন কংগ্রেসের সঙ্গে, যে কংগ্রেস ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারি করেছিল, ’৮৪-র শিখ নিধনকারী দাঙ্গার প্রধান হোতা ছিল। অন্য দিকে ধর্মীয় ফতোয়া জারি করা আব্বাস সিদ্দিকির দল, যিনি হঠাৎ ভোল পাল্টে পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতিনিধি হতে চাইছেন। সংখ্যালঘু সমাজকে অবশ্যই সমান অধিকার ও সুযোগ দিতে হবে, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, বিজেপি-শাসিত এই সময়ে চার পাশে ধর্মীয় কুসংস্কারের যে ফাঁদ তৈরি হচ্ছে তাতে আমরা যেন পা না দিই, গরিষ্ঠ হিন্দুর অসহিষ্ণুতা ঠেকাতে সংখ্যালঘুর গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় না দিই।

সুমন: আমার মতে, বামপন্থীদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, তাঁরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না। লড়াইয়ের যে আদর্শ বা ঐতিহ্য তাঁদের ভিত্তিভূমি, তা এক জায়গায় গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। মার্ক্সীয় দর্শন কোনও অনড় বিষয় নয়, প্রখর মানবিক দর্শন। চার পাশের বদলগুলিকে সেই দর্শনের পরিসরে, ব্যবহারিক পরিকাঠামোয় এনে বাস্তবায়িত করতে হবে, তবেই নতুন প্রজন্মের পক্ষে বামপন্থী মতাদর্শে শামিল হওয়া সম্ভব। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে অবিরত আলাপের ভিতর দিয়েই বামপন্থী সংস্কৃতি ও রাজনীতি অগ্রসর হতে পারত। নবীন প্রজন্ম ও তাদের ভাবনাকে অনেক আগেই সামনের সারিতে নিয়ে আসা উচিত ছিল প্রবীণ নেতৃত্বের। ক্ষমতায় থাকাকালীন দীর্ঘ অবহেলায়, আর ২০১১-য় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এক দশকেও তা তাঁরা করে উঠতে পারেননি।

কৌশিক: পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জে বামফ্রন্টের সাধারণ কর্মীদের একটা অংশ মনেপ্রাণে চাইছেন তৃণমূলকে সরাতে। কারণ তাঁরা তৃণমূলি নেতাদের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছেন। নিজেদের বাঁচাতে তৃণমূলকে সরাতে গিয়ে বিজেপিকে ডেকে আনছেন। অথচ বাম নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিল এই কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের ভুল রাস্তায় হাঁটা থেকে ফিরিয়ে আনার, তাঁদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠার। কাজের দাবিতে প্রাণ দিলেন যে মইদুল, তিনিই এই নির্বাচনে বামপন্থীদের মুখ হয়ে উঠতে পারতেন, অথচ মুখ হয়ে উঠলেন আব্বাস সিদ্দিকি। এমন পরিস্থিতি রীতিমতো বিষণ্ণ করে তুলেছে আমাদের, তাই তৃণমূলের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত দলের উপরেও আস্থা রাখতে হচ্ছে, কারণ তৃণমূল বিজেপির চেয়ে ‘লেসার ইভিল’, বিজেপি ‘মাচ মোর ইভিল’। পাশাপাশি বামপন্থীদের দুর্ভাগ্যজনক ভূমিকা... কিছু কাল পরেই হয়তো পার্টি-কংগ্রেসে তাঁরা একে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে স্বীকার করবেন— তাঁদের বরাবরের অভ্যেস।

সুমন: তৃণমূল বা বামপন্থীরা আমাদের কাছে প্রায় শাঁখের করাত, তবু এঁদের উপরই আস্থা রাখতে হচ্ছে, কারণ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে বিজেপির উত্থান এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আরএসএস-বিজেপির যুগলবন্দি দেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের পক্ষে এতটাই ক্ষতিকারক যে তা আটকাতেই হবে।

কৌশিক: জাতীয়তাবাদের জিগির-তোলা যে মিথ্যে রূপকথাটা ফানুসের মতো ফাঁপিয়ে তুলেছে বিজেপি, তারও একটা শেষ আছে। প্রতি মুহূর্তে যেন বিপদের আতঙ্ক। এই অবস্থায় কী করতে পারি আমরা? আমরা আমাদের দায়িত্বটুকুই পালন করতে পারি, শিল্পের ভাষায় কথা বলতে পারি। তাই এই সময়ের চিহ্নটুকু নাটকের মধ্য দিয়েই ধরে রাখা, যেখানে স্পষ্ট— কোনও ক্ষমতাই কল্পনাকে বরদাস্ত করতে পারে না, কবিকে তাই নির্বাসিত হয়ে থাকতে হয়।

সুমন: এই শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশেরও কোথাও একটা শেষ আছে, শিল্পের ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে। শিল্পীকেই ঠিক করে নিতে হয়, তিনি নিজস্ব স্বরে অবিচল থাকবেন, না কি ক্ষমতার স্বরে কথা বলবেন। গুজরাত-দাঙ্গার সময় ক্লাউস মান-এর উপন্যাস অবলম্বনে মেফিস্টো হয়েছিল মঞ্চে, তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই নাটকই আবার করব। শিল্পী কী ভাবে ভাঙতে পারেন শাসনের লৌহকপাট, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর-এ দেখিয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। অবিশ্রান্ত মিথ্যাভাষণকে প্রায় দৈববাণীর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যিনি, সেই হিটলারের বেশেই মঞ্চে উঠে চ্যাপলিনের নাপিত-চরিত্রটি ভাষণ দিয়েছিলেন... শুনতে শুনতে দেশ-দেশান্তরের মানুষ অশ্রুপাত করেছিলেন মুক্তির আশ্বাসে।

অনুলিখন: শিলাদিত্য সেন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Adolf Hitler Charlie Chaplin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE