Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
দেশ বলতে কী বোঝেন এঁরা
Farmers Agitation

সিমেন্ট গাঁথা ইস্পাতের ফলা: নাগরিক যখন যুদ্ধের প্রতিপক্ষ

পরিণতি যা-ই হোক, আজকের কৃষক-আন্দোলন যে স্বাধীন ভারতের অন্যতম বড় ও সফল আন্দোলন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ কোনও সর্বহারার আন্দোলন নয়।

ভারতভাগ্য: কৃষক-আন্দোলন ঠেকাতে দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ গাজ়িপুর সীমান্তে রাস্তায় সমর-সজ্জা, ৩ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

ভারতভাগ্য: কৃষক-আন্দোলন ঠেকাতে দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ গাজ়িপুর সীমান্তে রাস্তায় সমর-সজ্জা, ৩ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

অনিতা অগ্নিহোত্রী
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:১১
Share: Save:

মনে হচ্ছে এক ঐতিহাসিক লগ্নের সাক্ষী হয়ে নির্বাক বসে আছি। প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগদান ও দেশদ্রোহ যে সমার্থক, তা কোনও পাঠ্য বই বা আইনের কেতাবে পড়িনি। এত দিন কৃষকদের ভাষ্য শুনতে হচ্ছিল ইউটিউব চ্যানেলে, যে হেতু টিভি চ্যানেলগুলি এ সব সংবাদ পরিবেশনযোগ্য মনে করে না। আজ সংবাদপত্র, টেলিভিশন সর্বত্র এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি। দিল্লি সীমান্তে কৃষক আন্দোলনের কাছে দুই ধারে লাগানো হচ্ছে লোহার বড় বড় ছুঁচালো গজাল, সিমেন্ট-সহ ভিতের উপর পোক্ত করে, যাতে কোনও মানুষ বা যান চলাচল না সম্ভব হয়। এ যেন দেশের ভিতরে যুদ্ধ। অথচ প্রশাসনের প্রতিপক্ষ কিন্তু নিজেদেরই দেশের মানুষ, কৃষক সংগঠনগুলি কোনও নিষিদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠী নয়। না কি দিল্লির সাধারণ মানুষের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে পুলিশ তাঁদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চায়, বলতে চায়, তাঁরাই প্রতিবাদ করুন জমায়েতের। এর আগে সিংঘু সীমান্তে পুলিশের সামনেই স্থানীয় লোকজন পাথর ছুড়ছিল। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টার ‘অপরাধ’-এ এক সাংবাদিক গ্রেফতার ও পরে জেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। জামিন-অযোগ্য ধারা বেশ ভাল করে লাগানো হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

দিল্লির গাজ়িপুর সীমান্তে জল সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছিল, কেটে দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ। দিল্লি জল বোর্ডের ট্যাঙ্কার আসতে দিচ্ছে না পুলিশ। দেশের প্রশাসন কি চলে গেল পুলিশের হাতে? যে ভাবে লকডাউন ম্যানেজমেন্ট-এর নামে পদাতিকদের লাঠিপেটা করাতে অধিকৃত করা হয়েছিল পুলিশকে? এ যেন গণআন্দোলন নয়, সমাজবিরোধীদের বেআইনি জমায়েতের মোকাবিলা করার চেষ্টা হচ্ছে। সরকার আশা করেছিল, ২৬ জানুয়ারির পর কৃষকরা ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরে যাবেন। প্রস্তুতি হচ্ছিল, তাঁদের তাঁবু উপড়ে তুলে সব সাফ করে দেওয়া যাবে। কৃষক নেতার চোখের জলে আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হবে। কিন্তু হল অন্য রকম। মহাপঞ্চায়েত হাজার হাজার জাঠ কৃষককে সীমান্তে ও অন্যান্য অঞ্চলে পাঠিয়ে আন্দোলনে নতুন রক্ত সঞ্চার করল।

২৬ জানুয়ারির বিক্ষিপ্ত হিংসার পর দিল্লি পুলিশ কমিশনারের শান্ত-সমাহিত বক্তব্য শুনে আশ্চর্য লেগেছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের কথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখা হবে, পুলিশ ইন্টেলিজেন্স বলে কোনও বস্তুর অস্তিত্ব থাকবে না, দেশপ্রেমের সমার্থক যে কেল্লা, তার দিকে কুড়ি কিলোমিটার ধরে মিছিল এগোবে, কোনও বাধা পাবে না, লালকেল্লায় ২৬ জানুয়ারি কোনও পুলিশ-প্রহরা থাকবে না— তার পরও আন্দোলনকারীরা পাবেন বিশ্বাসঘাতকের তকমা আর পুলিশি ব্যর্থতার কোনও তদন্ত হবে না, এও কি সমর্থনযোগ্য? টেলিভিশন চ্যানেলগুলি ২৬ জানুয়ারির শান্তিপূর্ণ ট্র্যাক্টর মিছিল, যা আউটার রিং রোড ধরে এগিয়েছিল, তার কোনও দৃশ্য জনসমক্ষে আনেনি। তাদের উপর আন্দোলনকারীদের একাংশের আক্রমণ বর্ষিত হওয়ায় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ তারা, তিরস্কারই করছিল আন্দোলনের নেতাদের। কিন্তু তাই বলে তাদের নিজস্ব নিরপেক্ষতাও বিসর্জন দেওয়া উচিত হয়নি। আন্দোলনের নেতারা কৃষকদের একাংশের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। এটা যদি সত্যি হয়, ওই দিনের ঘটনার উচ্চস্তরীয় তদন্তও তেমন জরুরি।

দেশদ্রোহ। গুরুতর অপরাধ। একে তো আইনের এই ধারাটির অনেক আগেই সমীক্ষা হওয়া উচিত ছিল স্বাধীন দেশে। কিন্তু ধারাটি প্রয়োগের সময় অভিযুক্তের অভিপ্রায়— যা যে কোনও অপরাধের মূল উপাদান— তা দেখা তো পুলিশের কাজ। একাধিক সমাজকর্মী ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকের উপর এফআইআর দায়ের হল ষড়যন্ত্র ও দেশদ্রোহের অপরাধে। তাঁরা কি পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করে ‘ভুল’ সংবাদ পরিবেশন করছিলেন? বস্তুত, স্বাধীন দেশে গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ দেশদ্রোহের ধারায় মামলা হয়েছে, তা বোধ হয় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন-কালেও হয়নি। যাঁরা এই মামলাগুলির পিছনে আছেন, তাঁরা ‘দেশ’ বলতে কী বোঝেন, জানতে ইচ্ছে করে। ভারতের অখণ্ডতা, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র, সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তি— এ সব কিছুই তাঁদের মনের সন্দেহ নিরসন করে না? ভীমা কোরেগাঁও-এর সভাস্থলের কাছাকাছিও যাঁরা ছিলেন না, সেই কবি, অধ্যাপক, পুরোহিত তো বটেই, জেএনইউ ও জামিয়ার ছাত্ররা দেশদ্রোহী, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যাঁরা শামিল হয়েছিলেন, তাঁরা দেশদ্রোহী, এখন কৃষকরাও দেশদ্রোহী! ‘শত্রু দেশের মদতে পুষ্ট’, ‘বিশ্বাসঘাতক’। এই উচ্চারণের মধ্যে যে অহমিকা ও অবিশ্বাস প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে, দেশকে নষ্ট করার জন্য তা-ই তো যথেষ্ট।

পরিণতি যা-ই হোক, আজকের কৃষক-আন্দোলন যে স্বাধীন ভারতের অন্যতম বড় ও সফল আন্দোলন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ কোনও সর্বহারার আন্দোলন নয়। বড় ও মাঝারি কৃষকরাই (তা-ও তিনটি রাজ্যের) এতে শামিল হয়েছেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, লকডাউনের গোড়া থেকেই বিনা সংসদ, বিনা পরামর্শে অর্ডিন্যান্স-এর পথে নীতিগত পরিবর্তনের যে উল্লাস আরম্ভ হয়েছে দেশে, এই প্রথম তার গর্বিত রথকে আটকানো সম্ভব হল। এক দিকে রোজগারহীন পদযাত্রায় বহিরাগত শ্রমিক ভোগ করেছেন অশেষ লাঞ্ছনা, অন্য দিকে উৎসাহী কিছু রাজ্য সরকার বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার নামে শ্রম আইনের সংশোধন করেছে। ন্যূনতম মজুরির ধারা সরিয়ে, শ্রমদিবসের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে। শ্রমিক ও তাঁদের সংগঠনগুলি কিছুই করতে পারেনি। পরিবেশ-প্রভাব বিষয়ের অধিনিয়ম পাশ হয়ে গিয়েছে, সাধারণ মানুষকে অভিমত জানানোর যথেষ্ট সুযোগ না দিয়ে। পরিবেশ আন্দোলনকারী সংস্থাগুলিকে কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছে, আপত্তি দাখিলের জন্য সময়সীমা বাড়াতে; এমনকি সব ভারতীয় ভাষায় এগুলি অনুবাদ করানোর জন্য। তাতেও আপত্তি জানিয়েছে সরকার পক্ষ।

দীর্ঘমেয়াদি নতুন শিক্ষানীতি লকডাউনের মধ্যে নিয়ে আসার যুক্তি কী? জীবিকা হারিয়ে, ১৪৪ ধারা এবং সংক্রমণের সাঁড়াশি চাপে মানুষ যখন মৌন, বিচ্ছিন্ন, সেই সময়ে এতগুলি নীতি নিয়ে আসার তাৎপর্য কী? এ কি অতিমারি-জনিত স্তব্ধতার সুযোগের সদ্ব্যবহার? সেই রথ এসে থামল কৃষি সংস্কার সম্বন্ধিত তিনটি আইনে এসে, যা কোনও আলোচনা ছাড়াই তড়িৎগতিতে পাশ হল, জন পরামর্শ হল না, বিল সিলেক্ট কমিটিতে গেল না। যদি বিলের ধারা নিয়ে আলোচনা না-ও করি, যে ব্যস্ততা ও অগণতান্ত্রিকতার পরিচয় এই বিলগুলি পাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল, তাতে প্রশ্ন ওঠে, কাদের সুবিধের জন্য এই আইন? কেন এই তৎপরতা? দেশকে কোথায় পৌঁছোনোর তাড়া?

দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের রাজ্যে আন্দোলন অবস্থান করে তার পর কৃষকরা এসে বসেছেন দিল্লি সীমান্তে। এই দু’মাস ধরে তাঁদের উপর বর্ষিত হয়েছে নানা অভিধা ও নিন্দা। দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক, বিলাসবহুল জীবনযাপনের, বিদেশি অর্থের মদত নেওয়ার। ষাট দিন দুঃসহ শীতে তাঁদের বসিয়ে রেখে আলোচনা প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা মোটেই অনিবার্য ছিল না। কৃষকরা বহিরাগত শ্রমিক নন, সতর্ক মধ্যবিত্ত নন, রাজনৈতিক কর্মী নন যে নানা নিয়ন্ত্রক বিভাগকে তাঁদের পিছনে লাগিয়ে চুপ করানো যাবে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অস্ত্রও এঁদের বিরুদ্ধে খাটে না। তাই শেষ পর্যন্ত এই ইস্পাতের ফলা, তাই সিমেন্টের ভিত। ব্যারিকেড মজবুত করতে হবে, পুলিশ অধিকর্তা বলেছেন, কারণ ২৬ জানুয়ারি আন্দোলনকারীরা উল্টে দিয়েছিলেন ব্যারিকেড। এই তা হলে রণনীতি? আঘাত, প্রত্যাঘাত। তাই জল, শৌচালয়, আবর্জনা পরিষেবা সব তুলে নেওয়া হয়েছে। দিল্লির মন্ত্রী ও জল বোর্ডও পুলিশের কাছে অসহায়। এই মানবাধিকার উল্লঙ্ঘনই কি ভারতের মতো এক গণতন্ত্রের আধুনিক চেহারা, যেখানে দেশের মানুষ এক নির্বাচিত সরকারের প্রতিপক্ষ? আন্দোলনের পরিসর ছোট হতে হতে মুছে যাবে? নানা বর্ণনার দেশদ্রোহীতে ভরে যাবে আমাদের কারাগার? গণতান্ত্রিক সরকার, কোর্ট— সবার সামনে পুলিশের হাতে সমর্পিত হবে আমাদের যাবতীয় অধিকার? আমরা হয়ে যাব অচেনা এক অন্য দেশ, যেখানে আন্দোলনের কোনও তাৎপর্যই আর অবশিষ্ট নেই?

না। এখনই এমন নিরাশা শোভা পায় না। গত দু’বছরের নানা প্রতিবাদ, এবং এই কৃষক-আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে, দেশে থাকতে গেলে পথে নামতে হয়। জন-আন্দোলন লাগে। মাঝেমধ্যে গিয়ে কেবল ভোট দিয়ে এলেই চলে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Farmers Agitation Police Barricade
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE