Advertisement
০১ মে ২০২৪
Society

রাজনীতির গ্রাসে লৌকিক জ্ঞান

দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অবশ্য এত পরিশ্রমে রুচি নেই। একটা বা একগুচ্ছ দাবি বাজারে ছেড়ে দিয়ে, তা নিরলস প্রচার করলে সুবিধা অনেক বেশি।

—ফাইল চিত্র।

আদিত্য ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৭
Share: Save:

কুসংস্কার আর জ্ঞান-ভিত্তিক লোকাচারের মধ্যে পার্থক্য কী? ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার ধারায় এই প্রশ্নের সহজ উত্তর ছিল— তাদের ধারণাবহির্ভূত জ্ঞানচর্চার কোনও বিকল্প স্থানীয় পদ্ধতি, অন্য ভাবে আহরিত জ্ঞান, তার সামাজিক সংরক্ষণ, সমস্তটাই অজ্ঞানতার মূর্ত প্রতীক। উপনিবেশের যুগ পেরোনোর পর দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত মূলত লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার গবেষক-তাত্ত্বিকরা বহু তর্ক করে, বহু প্রচেষ্টায়, অসীম অধ্যবসায়ে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি চিন্তাধারা, একটি প্রক্রিয়া— পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ় বা উত্তর-ঔপনিবেশিক চর্চা। তাঁরা জ্ঞানসৃষ্টির পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকে ঔপনিবেশিক স্বার্থের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার উপায় নির্ধারণ করলেন প্রচুর গবেষণার মাধ্যমে শক্তিশালী পশ্চিমি দুনিয়ার মোকাবিলা করে। তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া গেল প্রচুর অকাট্য প্রমাণ যে, পৃথিবীর বিভিন্ন লোকাচারে ও লোকসংস্কৃতিতে বিভিন্ন প্রকারের বৈজ্ঞানিক সত্য নিহিত। জানা গেল, পশ্চিমি বিজ্ঞান ও ঔপনিবেশিক শক্তি কী ভাবে একে অপরের পরিপূরক, কী ভাবে তারা তাদের ক্ষমতাবলে বাকি সব জ্ঞানচর্চার পদ্ধতিকে প্রান্তিক করে রেখেছে, অসত্য ও অবৈজ্ঞানিক বলে উপহাস করেছে।

তবে কি পুষ্পক রথ সত্যিই প্রথম হেলিকপ্টার? গোমূত্র কি প্রকৃত পানীয়? ঔপনিবেশিক জ্ঞান নির্মাণ পদ্ধতি সত্যগুলিকে স্বীকার করেনি, এইমাত্র? হতে বাধা নেই, কিন্তু তার প্রমাণ প্রয়োজন। বিজ্ঞান দাবির উপরে চলে না, চলে প্রমাণের ভিত্তিতে। উত্তর-ঔপনিবেশিক বিদ্যাচর্চার গবেষকরা তাঁদের দাবির সপক্ষে তেমনই প্রমাণ খুঁজে বার করেন।

১৯৬৮ সালে গ্যারেট হার্ডিন নামক এক প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্‌স নামে এক তত্ত্ব পেশ করে দাবি করলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ যদি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে, তা হলে প্রত্যেকটি মানুষ নিজের সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করার জন্য পরিবেশ থেকে যথাসর্বস্ব আহরণ করবে, নিজেদের ক্ষুদ্র ও ব্যক্তিগত স্বার্থে পরিবেশের ধ্বংসসাধন করবে, তার সংরক্ষণে কখনও যথেষ্ট উদ্যোগী হবে না। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করতে হলে প্রয়োজন এই সম্পদের ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও কড়া নজরদারি। কিন্তু এর সপক্ষে না দেওয়া হল কোনও প্রমাণ, না হল কোনও গবেষণা। কিন্তু, এই তত্ত্বের দোহাই দিয়েই পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র প্রাকৃতিক সম্পদকে নিয়ে আসা হল সরকারি মালিকানার আওতায়। শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিবিদ এলিনর অসট্রম ১৯৯৫ থেকে প্রায় ১২ বছর সারা পৃথিবী জুড়ে গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ একত্রিত করলেন; দেখালেন যে, হার্ডিনের তত্ত্ব ভিত্তিহীন। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সরকারি সংরক্ষণের চেয়ে অনেক চমৎকার ভাবে তাদের পরিবেশ সংরক্ষণ করে এসেছে বহু যুগ ধরে, বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক লোকাচার ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ২০০৯ সালে নোবেল পেলেন তিনি। প্রমাণ পাওয়ার আগে কিন্তু অসট্রম দাবি করেননি যে, হার্ডিনের তত্ত্ব ভ্রান্ত।

দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অবশ্য এত পরিশ্রমে রুচি নেই। একটা বা একগুচ্ছ দাবি বাজারে ছেড়ে দিয়ে, তা নিরলস প্রচার করলে সুবিধা অনেক বেশি। সে প্রচারযজ্ঞে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল লৌকিক জ্ঞান নিয়ে চর্চার। সেই গবেষণাকে এখন দেখা হচ্ছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দোসর আর সমাজকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাখার এক নিকৃষ্ট পরিকল্পনা হিসাবে।

দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কাছে এই সব সামাজিক আচার ও রীতি কিন্তু নেহাতই ভোগ্যপণ্য। জনজাতি মানুষরা বিলাসবহুল রিসর্টে পর্যটকদের সামনে নাচবেন, গাইবেন, পুঁজিপতিরা মুনাফা লুটবেন। এ ভাবেই জনজাতিরা এক সময় আত্মবিস্মৃত হয়ে উঠবেন তাঁদের ঐতিহ্যবাহিত জ্ঞানের গুরুত্ব সম্বন্ধে। প্রক্রিয়াটি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তাঁদের সেই সঙ্গীত, নৃত্য বা শিল্পের মধ্যে অন্তর্নিহিত পরিবেশ-সংক্রান্ত জ্ঞান— যা তাঁরা শত-সহস্র বছর ধরে সঞ্চয় করেছেন আর সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন— তা হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি আর বাজারি অর্থনীতির জাঁতাকলে পড়ে দেশের জনজাতিরা নিজেদের অজানতেই পণ্য হয়ে উঠছেন। নিজেদের লোকাচার বিক্রয় করে তাঁরা পাচ্ছেন ন্যূনতম গ্রাসাচ্ছাদন মাত্র, কারণ তাঁদের সংরক্ষণের আদর্শ, জীবনদর্শনের বিজ্ঞানকে সম্মান দিতে পর্যটক বা হোটেল মালিকের বয়েই গিয়েছে।

সুন্দরবনের বিভিন্ন হোটেল, রিসর্টে যেমন আজকাল ঢাকঢোল পিটিয়ে বনবিবির পূজা হয়। কিন্তু সেই লোকাচার যে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এক অসামান্য সংহতির প্রতীক, যার মাধ্যমে সুন্দরবনের মানুষ যুগ যুগ ধরে অরণ্যের সর্বজনীন সম্পদ রক্ষা করেছেন, পরিবেশের সুস্থায়িত্ব বজায় রেখেছেন, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনা হয় না। ইসলাম মূর্তিপূজার বিরোধী। অন্য দিকে, হিন্দু দেবীর নাম ‘বিবি’ হওয়া অসম্ভব। তা হলে বনবিবির সৃষ্টিই বা হল কেন, আর হিন্দু মুসলমান জনজাতি নির্বিশেষে যুগ যুগ ধরে সবাই তাঁর পূজাই বা করেন কেন? বনবিবির পাঁচালিতেই বা কী রয়েছে? রয়েছে পরিবেশ রক্ষার, সর্বজনীন সম্পদকে সংরক্ষণ করার, তাকে নিঃশেষ না করার, তাকে সুস্থায়ী করার পথনির্দেশ। যেমন, বনবিবির বিধানে হতদরিদ্র ছাড়া কারও অধিকার নেই জঙ্গলের মধু, কাঠ বা মাছের উপর। অসট্রমের তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যাখ্যা করলে, বনবিবি ধর্মীয় বিভাজনের অনেক ঊর্ধ্বে, বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গোষ্ঠীভিত্তিক প্রাকৃতিক সম্পদ পরিচালনার এক অভাবনীয় দৈবিক প্রতিভূ। যেখানে ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস গৌণ, পরিবেশ রক্ষার তাগিদ মুখ্য।

সুন্দরবনের পর্যটকদের কাছে তা নেহাতই অবান্তর— বনবিবির পূজা নিতান্তই তাঁদের আমোদ-আহ্লাদের অঙ্গ, ছবি তুলে সমাজমাধ্যমে প্রচার করার সামগ্রী। তাঁরা বনবিবিকে গ্রাম্য কুসংস্কার হিসাবে ব্যঙ্গ করে বিমলানন্দ উপভোগ করবেন। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি আর বাজারের যৌথ আক্রমণে বনবিবির পালার মধ্যে ধরে রাখা জ্ঞান আজ প্রায় বিনষ্ট। যে অভিজ্ঞতা-আহরিত জ্ঞান আর আদর্শ থেকে এই লোকাচারের প্রবর্তন, তা বিস্মৃতির অতলে পর্যবসিত, কারণ নতুন প্রজন্মের কাছে এ নিছকই অভিনয় আর প্রদর্শনী।

ক্ষুদ্র রাজনীতি আর বাজারের স্বার্থের হাত থেকে লৌকিক জ্ঞানকে রক্ষা না করতে পারলে ওই রাজনীতির প্রচারটুকু থাকবে, মুনাফা থাকবে, জ্ঞান থাকবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Politics Secular Country Superstition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE