—প্রতীকী চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সরকারি সফরে ভুটানে চলেছেন। তাঁর যাত্রাসঙ্গী হয়েছি। না, সফরসঙ্গী নয়। কলকাতা থেকে তাঁর সঙ্গে একই বিমানের যাত্রী হয়েছি আমরা— আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ এবং আর একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিনিধি। শুধু এইটুকুই। আনন্দবাজার-এর উপর তখন তাঁর বেজায় রাগ। এই সংবাদপত্রে তাঁর সরকার এবং দলের ‘দ্ব্যর্থহীন স্তাবকতা’ না থাকার কারণে আমরা জ্যোতিবাবুদের নজরে অপাঙ্ক্তেয়, শত্রুসম। জনসভায় সাংবাদিকদের আসনের দিকে আঙুল তুলে তাঁকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, “ওই যে ওখানে বসে আছে আনন্দবাজার। ওদের কাজ শুধু আমাদের বিরোধিতা করা...” ইত্যাদি।
বিমানে সামনের সারিতে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আসনের কাছে যেতে শুধু এক বার তাকালেন, কথা নয়। পারো-তে নেমে সদল তিনি চলে গেলেন রাজ-আতিথ্যে। আমরা বিভুঁইয়ে নিজেদের মতো হোটেল-সন্ধানী।
পেশার দায়ে বিকেলে তাঁর নিবাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। যদি অন্তত কর্মসূচিগুলি জানা যায়! অনুরোধ-উপরোধে তাঁর সচিবালয়ের এক অফিসার এসে জানালেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজন বুঝলে আমাদের হোটেলে খবর পাঠাবেন।
সেখান থেকেই অন্য এক কাহিনির শুরু। অল্প ক্ষণের মধ্যে হোটেলে ভুটান সরকারের দুই অফিসার হাজির। তাঁরা জানালেন, ‘ভিভিআইপি’র ইচ্ছানুসারে তাঁর সফরে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মানে, আমরা এ বার প্রকৃতই তাঁর ‘সফরসঙ্গী’, তাঁর সঙ্গেই আমরা ঘুরতে পারব।
পর দিন সকালে একটি গুম্ফা পরিদর্শনের পরে গাড়িতে ওঠার সময় জ্যোতিবাবুর ডাক এল। এগিয়ে গেলাম। বললেন, “রাজার একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে তো!” সবিনয়ে জানালাম, থিম্পুতে গিয়ে অবশ্যই চেষ্টা করব। আমাদের অবাক করে জ্যোতি বসু বললেন, “ওখানে সব বলা আছে। আমি পরে যাব। তোমরা এগিয়ে যাও।”
থিম্পুতে সরকারি আয়োজনেই থাকা। রাজার বাড়ির কাজ মিটিয়ে হোটেলের ঘরে খবর লিখছি। ‘ভিভিআইপি’-র কনভয় পৌঁছল। কারণ ওই হোটেলেই তাঁর সম্মানে নৈশভোজ। আমরাও আমন্ত্রিত। পরিচয়পর্বের সময় আমাকে দেখিয়ে ভুটানের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী দাওয়া শেরিংকে জ্যোতিবাবু বললেন, “ওদের কাগজ সব সময় আমাদের বিরুদ্ধে লেখে। আমি ওদের সঙ্গে করে আনিনি। তবে আমি এসেছি, তাই এসেছে। এখন ওরা ওদের মতো কাজ করবে, করুক। আমরা আমাদের কাজ করে যাব। এটাই আমাদের মধ্যে সম্পর্ক। অ্যান্ড দে আর অল গুড বয়েজ়।”
হয়তো অকিঞ্চিৎকর। তবু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সে দিনের ওই ঘটনাগুলি কোথাও যেন প্রাসঙ্গিক মনে হয়। আসলে রাজনীতিক তথা ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সম্পর্কের সাঁকোটি চিরকালই দোলে। তবে, এখন যত দিন যাচ্ছে, ততই সেটি বড্ড নড়বড়ে, ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। সৌজন্যের প্রসাধনীটুকুও অবশিষ্ট থাকছে না! বোধ হচ্ছে, তাঁবেদারির নাট-বল্টু ছাড়া সেতুটি খাড়া থাকুক, তা চাওয়া হচ্ছে না!
তার জন্য চাপও বাড়ানো হচ্ছে নানা ভাবে। রাজনীতির রুই-কাতলা-চুনোপুঁটি থেকে শুরু করে সরকারের সিপাই-আমলা-পুলিশ সবাই আরও বেশি ‘বশ্যতা’ দাবি করছে। আর দাবি পূরণ না হলেই প্রতিহিংসা। সাংবাদিককে প্রহার, প্রাণনাশ, মিথ্যা মামলা, জেল, সামাজিক হেনস্থা, সংবাদমাধ্যমের উপর চাপ সৃষ্টি, কী নয়! দলমতনির্বিশেষে এটা সাধারণ সত্য। সে কেন্দ্রই হোক, বা রাজ্য। শাসকই হোক, বা প্রভাবশালী বিরোধী।
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা আজও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণের নির্মমতম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তখন টিভি ছিল না, এত রকম সমাজমাধ্যম ছিল না। প্রেস সেন্সরশিপ জারি করে দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রের টুঁটি টিপে দর্প জাহির করেছিল ইন্দিরার সরকার। গ্রেফতার করা হয়েছিল মাথা তুলতে যাওয়া সাংবাদিকদের। তার পর? ১৯৭৭-এ হেরে ক্ষমতাচ্যুত ইন্দিরাকে লন্ডনে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে শেষ পর্যন্ত কী লাভ হল? কী পেলেন? ইন্দিরা গান্ধী ঘুরিয়ে জবাব দিয়েছিলেন, “জরুরি অবস্থার একুশ মাসে আমরা দেশের সমস্ত জনগণের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পেরেছিলাম!” কথাটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সময় ও সমাজের দর্পণ হিসাবে জনমত গঠনে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য।
সে জন্যই সংবাদ যদি ‘প্রভাবশালী’দের মনঃপূত না হয়, তা হলে তাঁরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং দিগ্বিদিক ভুলে আক্রমণকেই তখন কার্যত আত্মরক্ষার পথ ভেবে নেন। জঙ্গলের জীবজন্তুদের স্বভাবেও আক্রমণের এমন লক্ষণ আছে। অভিজ্ঞেরা বলেন, তারা আগে ভয় পায়। তার পরে প্রতিক্রিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, ছোবল দেয়। তাতে কখনও ‘শত্রু’ ঘায়েল হয়, কখনও নিজেরা মরে!
স্বাধীনতার পর থেকে শুধু আনন্দবাজার পত্রিকা-র উপর যত আঘাত এসেছে, তার তুলনা মেলা ভার। যদিও প্রতিষ্ঠান তাতে দমেনি। বস্তুত বিধানচন্দ্র রায়ের আমল থেকে আজ পর্যন্ত রাজ্যের সকল সরকার এই সংবাদপত্রকে কোনও না কোনও ভাবে বেগ দিয়ে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারও ব্যতিক্রম নয়। তার মূল কারণ, সংবাদের ‘ধাক্কা’। সেখান থেকেই জন-প্রতিক্রিয়ার ‘ভয়’ এবং প্রত্যাঘাত। জরুরি অবস্থায় চরম পরিস্থিতির কথা তো বাদই দিলাম। মানুষ এগুলি সব জানেন, বোঝেন। তাই বিশদ আলোচনার প্রয়োজন নেই।
তবে ইদানীং দেশে আর একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা এসেছে। তা হল, সাংবাদিককে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়া। তিন বছর আগে যা ঘটেছে সিদ্দিক কাপ্পানের ক্ষেত্রে। কেরলের ওই সাংবাদিক যাচ্ছিলেন উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত মেয়ের ‘মৃত্যু-কেলেঙ্কারি’ উন্মোচনে। সবাই জানেন, মেয়েটির ‘রহস্যজনক’ (অভিযোগ গণধর্ষণেরও) মৃত্যু এবং তাঁর পরিবারকে জোর করে আটকে রেখে সরকারি উদ্যোগে অন্ত্যেষ্টির ঘটনা দেশে আলোড়ন ফেলে। তাতে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক বিজেপি প্রমাদ গনে। অন্য সাংবাদিকদের ওই গ্রামের ধারেপাশে ঘেঁষতেই দেওয়া হয়নি। আর যাওয়ার পথে মথুরায় কাপ্পানকে গ্রেফতার করে চাপানো হয় দেশদ্রোহের অভিযোগ। আজও তাঁকে কেরল থেকে নিয়মিত লখনউ আসতে হচ্ছে পুলিশের কাছে হাজিরা দিতে!
প্রায় একই কায়দায় এই রাজ্যেও খবর লিখে সাংবাদিকের জেল হচ্ছে। অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে মহিলার শ্লীলতাহানি, বা আরও কঠোর কোনও ধারায়। কানে আসে আইনরক্ষকদের মুখে ‘চামড়া খুলে নেওয়া’র হুমকিও। কোথাও, কখনও মুখ্যমন্ত্রীর স্তরে বিষয় পৌঁছলে হয়তো বা ক্ষেত্রবিশেষে ছবি একটু বদলায়, কিন্তু সামগ্রিক প্রবণতা বদলায় না। ‘বেকায়দায়’ পড়ার খবরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার তাড়না সমানেই বাড়ে। সাংবাদিক এবং সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলিকে বেছে বেছে বিচ্ছিন্ন করে রাখারও কমতি নেই। দেশে, রাজ্যে সর্বত্র একই।
চার দশকের সাংবাদিকতায় বহু নেতা, মন্ত্রী, শাসক, বিরোধী দেখার সুযোগ হয়েছে। আগেও দেখেছি খবরের তীব্র প্রতিবাদ করতে। কিন্তু সাংবাদিকের উদ্দেশে শাসক বা বিরোধী শিবিরের নেতৃস্থানীয় কাউকে বলতে শুনিনি ‘ঘর থেকে বেরিয়ে যান’, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে ঘৃণা হয়’-এর মতো অসহিষ্ণু কোনও বাক্য। দেখিনি সাংবাদিকদের চিহ্নিত করে ‘অচ্ছুত’ করা। আজ সে সবও আকছার, শাসক এবং বিরোধী দু’দিকেই! টিভি চ্যানেল ‘বয়কট’ এখনকার আর এক চালু প্রকরণ।
ইচ্ছাকৃত মিথ্যা খবর অবশ্যই শাস্তিযোগ্য। কিন্তু ক্ষমতার জোরে সত্যকে দাবিয়ে রাখার জুলুম কিছু কম অপরাধ নয়। দেশ জুড়ে তার পাল্লা ভারী হচ্ছে। হে মোর দুর্ভাগা দেশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy