Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Old Days of Poila Baisakh

নতুন স্বপ্ন গানে গানে

বিস্ময় জাগে কাজী নজরুল ইসলামের নববর্ষের দিনের রচনা ঘিরেও। ১৯২২ সাল, ধূমকেতু পত্রিকা-র জন্য প্রচ্ছদ আঁকছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অথচ নজরুল তখন হুগলি জেলে।

বাঙালির নববর্ষের গানে আছে অন্য ছবিও।

বাঙালির নববর্ষের গানে আছে অন্য ছবিও। ফাইল চিত্র।

অলক রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৪৮
Share: Save:

চাপড়া-ষষ্ঠী থেকে সাধভক্ষণ, সবেরই গান আছে,” শরীর কাঁপিয়ে হাসেন বাবু রামকুমার। বলেন, “শচীনকত্তার ওই আড়ো আড়ো, ছাড়ো ছাড়ো উচ্চারণের ‘মন দিল না বঁধু’ বাংলা গানে মাইলস্টোন বাপু। জবাব নেই এ বাঙালিয়ানার। আমি আজও মজে।” ফরমায়েশ আসে, হোক একটা নববর্ষের গান। পক্বকেশ নবযুবা শুরু করেন এ ভাবে: “দু’লাইন বলছি সতীশ ঘটকের প্যারডি: ‘বাঙালির মতো বাঙালির বেশ/ বাঙালির ঘরে লুচি সন্দেশ/ অনেক হউক অনেক হউক/ অনেক হউক, হে ভগবান’।” ‘বাঙলার মাটি বাঙলার জল’-এর এই লালিকায় বাঙালির ঘাড় শক্ত হোক, কচু মোচা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হোক, এমন অনেক শুভকামনা আছে। কিন্তু এ সবই বৃথা যাবে রামকুমারের পয়োধিকণ্ঠে তা না শুনে থাকলে।

ওঁর পাড়া তারক চ্যাটার্জি লেনেরই অপর প্রান্তে বিমান মুখোপাধ্যায় বসেছেন গানের ঘরে। স্মৃতিধার্য শব্দটির সাক্ষাৎ প্রতিরূপ, কদাপি ওঁকে গানের খাতা বা বই খুলতে দেখিনি। দেখিয়ে দিতেন ঠিক কোন ভঙ্গিতে হারমোনিয়াম হাতে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় শোনাতেন ‘জাগো, আলোক লগনে’। “আসলে নিজেকেই শোনাতেন গান। তোমরা শুনেছ মেগাফোন রেকর্ডে, আমরা সামনাসামনি নববর্ষের সকালে পাথুরিয়াঘাটায়,” হাসি খেলত বিমানবাবুর চোখে-মুখে।

বিস্ময় জাগে কাজী নজরুল ইসলামের নববর্ষের দিনের রচনা ঘিরেও। ১৯২২ সাল, ধূমকেতু পত্রিকা-র জন্য প্রচ্ছদ আঁকছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অথচ নজরুল তখন হুগলি জেলে। নববর্ষের দিন বন্দিদের নিয়ে অনশনে বসলেন তিনি, বাংলা জানা অত্যাচারী জেলরের উদ্দেশে ধেয়ে গেল রবীন্দ্রগানের প্যারডি, “রেখেছ সান্ত্রি পাহারা দোরে/ আঁধার কক্ষে জামাই আদরে/ বেঁধেছ শিকল প্রণয়ডোরে/ তুমি ধন্য ধন্য হে/ তোমারই জেলে পালিছ ঠেলে/ তুমি ধন্য ধন্য হে।” প্রতিবাদের জাত কুল মান সবই উচ্চাঙ্গের। আবার ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের নববর্ষে মৈত্রেয়ী দেবী ও আরও অনেকের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন গান ‘ওই মহামানব আসে’। সেই গান কবির জন্মদিনে গাওয়া হবে এমন খবর কানে যেতেই তিনি বললেন, লোকে বলবে, দেখো নিজের জন্মদিন নিয়ে নিজেই লিখেছে!

হিমানীশ গোস্বামী বলেছিলেন, “ধরো হাজরার মোড়ে বছরের প্রথম দিনে কচুরি-ডাল আর ল্যাংচা খাচ্ছ। তখন কি তোমার মনে আসবে না কান্তকবির সেই বিখ্যাত রচনা, ‘কবে ভবের সুখদুখ চরণে দলিয়া/ যাত্রা করিব গো শ্রীহরি বলিয়া’!” সাত-সতেরো ভাবনার মধ্যে মনে এল দূরদর্শন কলকাতা-র নববর্ষের অনুষ্ঠানস্মৃতি, নৌকায় পঙ্কজ সাহা-সহ সকলে। এক কোণে ছিপছিপে একটি মেয়ে, গাইলেন একটিই গান, ‘ও মাঝি, মাঝি রে, পার করে দাও বলব না আর’। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কথা ও সুরের এই গানের সহৃদয় পরিবেশন শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাতারাতি বসাল খ্যাতির আসনে। অন্য এক বছরে এই ‘নববর্ষের বৈঠক’ অনুষ্ঠানেই ঘটে গিয়েছিল তুমুল এক ঘটনা। তবলা বাজিয়ে কদাপি অর্থ নেননি হীরুবাবু, হীরেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। এ আসরেও নেবেন না, পঙ্কজবাবু বলে দেবেন তা এক ফাঁকে, এমনই ঠিক আছে। অথচ, লাইভ অনুষ্ঠান শেষ হতে চলল, সে কথা বলা হচ্ছে কই? হীরুবাবু তো ঘেমেনেয়ে অস্থির। শেষে নিজেই মাইক্রোফোন টেনে বলে দিলেন, “গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে কথা দেওয়া। তাই পাগল-ছাগল যা-ই বলুন, এই অনুষ্ঠানে বাজিয়ে কোনও টাকা নিইনি, বলে দিলাম।” সামলানো যায়নি জয়কৃষ্ণ সান্যালকেও। ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়িতে এক নববর্ষের পুরাতনী গানের আসরে কিছু বলতে বলা হল ওঁকে। প্রথমেই বলে বসলেন, ধ্রুপদ ছাড়া অন্য গানে ঈশ্বর-সাধনা হয় না। সকলে তা মেনে নেবেন কেন? ব্যস, বেধে গেল ঝগড়া। যুক্তি তক্কো কাজিয়া থামাতে শেষে মঞ্চে দু’বার করে আসতে হল খোদ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রকে।

এরই পাশে বাঙালির নববর্ষের গানে আছে অন্য ছবিও। উত্তর কলকাতার যে বাড়িতে বসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখলেন নববর্ষের অমল সঙ্গীত ‘আজি নূতন রতনে’, সে বাড়ি হেরিটেজ তকমা পায়নি, বেহাত হয়ে অন্য মালিকানায় চলে গেছে। কিন্তু বেঁচে আছে গান। ‘আজি পুরানো যা কিছু দাও গো ঘুচিয়ে/ মলিন যা কিছু ফেলো গো মুছিয়ে’-র সারল্য শ্রোতার মনে স্থায়ী হয়েছে যুগে যুগে নীলুফার ইয়াসমিন, মিতা হক, জয়তী চক্রবর্তী বা ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠগুণে। বেশ মনে পড়ে, নাথবতী অনাথবৎ-এর সুরনির্মিতি যাঁর, প্রয়াত সেই তড়িৎ ভট্টাচার্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদয়শঙ্কর হলে বসে সুর করছেন নতুন গান, ‘রাত শেষে প্রতিদিন তারিখ বদলে যায়, বদলায় কি এ জীবনের মানে?/ এ ভাবেই এক দিন তবু আসে বৈশাখ, নতুন স্বপ্ন গানে গানে।’

এখানেই প্রশ্ন। বাংলা নববর্ষের আনুষ্ঠানিক খাওয়াদাওয়া, মেলা, ধুতি-শাড়ির চেনা উৎসব আর হুল্লোড় ছাপিয়ে আগেকার মতো সেই ‘বেসিক’ এক-আধটি গানের সন্ধান কি মিলবে, যার সুর-বাণীতে শাশ্বতের রোমন্থন আর নবীনের স্বপ্নের হাত ধরাধরি ফের দেখতে পাব আমরা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

poila baisakh Bengalis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE