E-Paper

কৃত্রিম বুদ্ধি ও মনের বিনির্মাণ

অন্তরে যোগাযোগের প্রবল বাসনা সত্ত্বেও দীর্ঘ দিনের দমবন্ধ বিচ্ছিন্নতা মানসিক অবসাদ ডেকে আনে। অবসাদ কাটাতে জোরালো হয়ে ওঠে আরও বেশি ব্যক্তিগত ইকো-চেম্বারে বুঁদ হয়ে থাকার প্রবণতা।

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৮
Artificial Intelligence

—প্রতীকী ছবি।

রবীন্দ্রনাথ মন নিয়ে খাঁটি কথাটি বলেছেন, “আমাদের ভিতরকার সমস্ত সামঞ্জস্য নষ্ট করিয়া আমাদের মনটা অত্যন্ত বৃহৎ হইয়া পড়িয়াছে। তাহাকে কোথাও আর কুলাইয়া উঠিতেছে না।... এই জন্য, প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ সারিয়া ফেলিয়াও চতুর্দিকে অনেকখানি মন বাকি থাকে। কাজেই সে বসিয়া বসিয়া ডায়ারি লেখে, তর্ক করে... যাহাকে এক ভাবে বোঝা উচিত তাহাকে আর-এক ভাবে দাঁড় করায়... এমন-কি, এ সকল অপেক্ষাও অনেক গুরুতর গর্হিত কার্য করে।” ইতিহাসের দিকে পাশ ফিরলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশের মানুষের এই অনেকখানি বাকি থাকা মনের দখল নিতে পারলেই, যাকে এক ভাবে বোঝা উচিত শাসক তাকে আর এক ভাবে দাঁড় করাতে পারেন, করিয়ে নিতে পারেন গুরুতর গর্হিত কাজ, মানুষের সর্বান্তঃকরণ সম্মতি নির্মাণ করেই। এই নিপুণ নির্মাণ সুবোধ বালকের মধ্যেও জাগিয়ে তুলতে পারে নরখাদক প্রবৃত্তি, শান্ত সুন্দর সমাজকে করে তুলতে পারে নরক গুলজার।

কিন্তু এ কাজ সহজ নয়। বিশেষত, বিচিত্র সব ভাবনার অভিমুখ, অফলাইন-অনলাইনে রকমারি লেনদেন-অধ্যুষিত কোটি কোটি মানুষের একুশ শতকীয় মনকে নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ কথা নয়, শাসকের মস্তিষ্ক যতই সুচতুর হোক না কেন। এখানেই শাসকের দোসর হয়ে ওঠে প্রযুক্তি— আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই। সভ্যতার এই সময়ের অন্ধকার দিকটা আরও গাঢ় হবে জেনেও শুধু মুনাফার জন্য এই কর্মকাণ্ডে সাহায্যের হাত বাড়ায় ফেসবুক, গুগল, অ্যামাজ়ন-এর মতো সংস্থা। তাদের হাতেই রাশ, এআই সম্পর্কিত সামগ্রী তাদেরই দখলে।

পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের যাবতীয় যা কিছু অনলাইন, তার সবটাই এআই-অ্যালগরিদমের মহার্ঘ কাঁচামাল। যেমন হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, ফেসবুক পোস্ট, অট্টহাসির ইমোটিকন বা অ্যামাজ়ন কার্টে পছন্দের পণ্য। অ্যালগরিদম নির্ভুল খুঁজে বার করে নেয় আমাদের পছন্দ-অপছন্দের খুঁটিনাটি। বিপুল সংখ্যক মানুষের অনলাইন প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে ফেসবুক, স্ন্যাপচ্যাট, গুগল এত দিনে বুঝে ফেলেছে যে, মানুষ আসলে দারুণ প্রেডিক্টেবল। প্রতিটি মানুষের চিন্তাভাবনার নির্দিষ্ট ছাঁচ রয়েছে, তার গতিবিধিতেও বিশেষ ছক। এপিস্টেমিক এবং ফিল্টার বাবল পছন্দের অংশগুলিকে অতিরঞ্জিত ও অপছন্দের জায়গাগুলিকে খারিজ করে এমন এক অনলাইন-দুনিয়ায় আমাদের মাতিয়ে রাখে, যেখানে সব কিছুই আমাদের পছন্দমাফিক। আমি যেন আমার বৌদ্ধিক প্রতিলিপিকেই দেখতে পাই সর্বত্র।

এই নিয়মে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ধৰ্মপ্রাণ নাগরিকের নিউজ়ফিডে ‘রেকমেন্ডেড ফর ইউ’, ‘সাজেস্টেড ফর ইউ’ তালিকা ভরে ওঠে এমন সব টেক্সট, ভিডিয়োতে যেখানে ধামাচাপা পড়ে যায় ভারতীয় দর্শনের নিবিড় বিশ্বজনীন ঐতিহ্য। মুখ্য হয়ে ওঠে সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ। পোস্ট-ট্রুথ দুনিয়ায় এআই-এর আর এক শাখা ডিপফেক-এর ব্যবহারে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় হিংসা-ওস্কানো ভিডিয়ো। বছরের পর বছর এই সবের নিরন্তর অভিঘাতে নাছোড় ইএমআই, চড়া মেডিক্যাল বিল, যখন তখন চাকরি চলে যাওয়ার বাস্তবতায় ঘেরা নাজেহাল নাগরিকের মন আবদ্ধ হয়ে পড়ে অভূতপূর্ব এক ইকো-চেম্বারে। একই ধরনের ভাবনার চর্বিতচর্বণে একে অপরকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেন ইকো-চেম্বারের সমস্ত সদস্য, সবচেয়ে সন্দেহপ্রবণ মানুষটিও বিশ্বাসবান হয়ে ওঠেন। দলে যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে দাম্ভিক আস্ফালনে তিনিও ন্যায্যতা দিতে শুরু করেন ইতর সঙ্কীর্ণতাকে। এক সময় এই দৃষ্টিকোণ সিংহভাগ মানুষের কাছেই হয়ে ওঠে স্বাভাবিক।

বিশেষ মতাদর্শের প্রতি মানুষের আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। নিজের পছন্দ, আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক বীক্ষণের প্রতি যত্নশীল হয়ে নির্দিষ্ট ধাঁচায় প্রতি দিনের জীবন এগিয়ে নিয়ে যেতেই অভ্যস্ত বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু ছকে বাঁধা দীর্ঘ দিনের চর্চায় এই ধাঁচা খাঁচার চেহারা নিলে সামাজিক সম্পর্কও বিপজ্জনক বাঁক নেয়। নতুন স্রোতে গা-ভাসানো মানুষ সহ-মানুষের আকুতি বোঝেন না। অন্য দিকে, মানবিক যুক্তিবাদীরাও ভেদ করতে পারেন না বদলে-যাওয়া মনের ভয়াবহ উল্লাস। অনলাইন স্মাইলির আদান-প্রদানকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়, প্রকৃত সামাজিকতার নিরিখে আজকের অনলাইন ইকো-চেম্বারে পৃথিবীর প্রায় সকলেই একে অপরের থেকে আমূল বিচ্ছিন্ন।

অন্তরে যোগাযোগের প্রবল বাসনা সত্ত্বেও দীর্ঘ দিনের দমবন্ধ বিচ্ছিন্নতা মানসিক অবসাদ ডেকে আনে। অবসাদ কাটাতে জোরালো হয়ে ওঠে আরও বেশি ব্যক্তিগত ইকো-চেম্বারে বুঁদ হয়ে থাকার প্রবণতা। শেষে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সামাজিকতা ফিরে পেতে অবলম্বন হিসাবে পড়ে থাকে অন্ধত্ববাদ, চরমপন্থা। আলাদা বিত্তের ও বৃত্তের মানুষ বিনা প্রশ্নে তা আঁকড়ে ধরেন।

পরিণাম? কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে হিংসায় উন্মাদ কেউ তেড়ে যায় অহিংস অপরের দিকে। মারমুখী ধার্মিক চড়াও হয় বিধর্মীর উপর। তবে উল্টো দিকও রয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, কেমন সহানুভূতি ও ভালবাসায় গড়ে উঠেছিল দু’জনেরই শৈশব। মতভেদ থাকলেও, দিনের শেষে বাগ্‌বিতণ্ডা মুছে যেত নিখাদ বন্ধুতায়। দু’জনেই আরও একটু বেশি সমাজ-সচেতন মানুষ হয়ে উঠতেন অজানতেই, প্রতি দিন। সরলীকরণ নয়, অতিরঞ্জিত ভাবোচ্ছ্বাসও নয়; এমনই ঘটেছিল, ঘটেও, ঘটতে পারে আবার। কৃত্রিম বুদ্ধি নয়, মহাকাল জানে সে কথা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Artificial Intelligence Society Science

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy