Advertisement
E-Paper

এর মধ্যে ‘আনন্দময়’ শিক্ষা?

‘দারিদ্র’ আর্থিক হয় না, কিছু কিছু দারিদ্র থাকে ‘মানসিকতা’-তেও। যে পরিবেশে আমাদের স্কুলগুলোতে লেখাপড়া চলে, তাকে পঠনপাঠনের অনুকূল বলা চলে না।

সীমান্ত গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২২ ০৪:৫০

এক নিকটাত্মীয়া সম্প্রতি একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে প্রথম কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায় তিনি মুগ্ধ। তাঁর কাছেই শুনলাম, গোটা স্কুল-বাড়িটাই নাকি শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত। শৌচালয়গুলো ঝকঝকে। যে কোনও বিদ্যুৎ বিপর্যয় সামাল দেওয়ার জন্য রয়েছে জেনারেটরের ব্যবস্থা। স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীরা থাকে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময় মোটেও শুধু পড়াশোনা হয় না। সচরাচর একটি থিয়োরি ক্লাসের পরেই থাকে সেই বিষয়ে হাতে-কলমে কাজ শেখার ব্যবস্থা। রয়েছে বহু লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি ‘অটল থিঙ্ক ল্যাব’, যেখানে অজস্র রকমের শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে কাজ শেখা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ ঘটানো হয়।

দেশ জুড়ে ক’টিই বা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় আছে! এ-হেন উন্নত বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষালাভের সুযোগই বা পায় ক’জন! তবু, আত্মীয়ার সেই কথাগুলো মনে পড়ে ঈর্ষা জাগছিল সে দিন দুপুরবেলা, যখন ক্লাস নাইনের ঘরে জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়াচ্ছিলাম। কম-বেশি আশি জনের শ্রেণিকক্ষে তো কমপক্ষে চারটি পাখা থাকার কথা— রয়েছে দু’টি, তার মধ্যে আবার একটি বেশ কয়েক দিন ধরে খারাপ। এমন সময় আচমকা লোডশেডিং। সবেধন নীলমণি পাখাটিও গেল থেমে। ছাত্র-শিক্ষক সকলেই তখন দরদরিয়ে ঘামছে। ‘রূপসী বাংলা’ পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ বইকি! ভ্যাপসা গরমে টানা চিৎকার করে পড়াতে গিয়ে রীতিমতো মাথা ধরে গিয়েছিল। ছাত্রদের সে কথা বলে একটু শান্ত থাকতে অনুরোধ করাতে ব্যঙ্গের সুরে এক জন বলে উঠল, “আমাদের টয়লেটে গিয়ে দু’মিনিট কাটিয়ে আসুন স্যর, অ্যামোনিয়ার দুর্গন্ধে মাথা ছেড়ে যাবে!”

পঠনপাঠনের মতো বিষয় কিছু ন্যূনতম শারীরিক ও মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য দাবি করে। দুঃখের সঙ্গে বলি, রাজ্যের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সেটুকুও পাওয়া যায় না। যে পরিবেশে আমাদের স্কুলগুলোতে লেখাপড়া চলে, তাকে পঠনপাঠনের অনুকূল বলা চলে না।

সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে (‘শিক্ষায় বৈষম্য অসহনীয়’, আবাপ ১৯/৭) অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, “আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মুখস্থ করে উগড়ে দেওয়ার উপর বড় বেশি জোর দেয়। সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসে ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের মনে কৌতূহল তৈরি করতে হবে। শেখাটাকে একটা আনন্দময় জার্নি করে তুলতে হবে।” শিক্ষাকে ‘আনন্দময়’ করে তোলার জন্য প্রয়োজন হয় উপযুক্ত পরিকাঠামো এবং উৎকৃষ্ট দরদি শিক্ষকের। এর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ-বরাদ্দ এবং কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

জানি, আমাদের রাজ্য গরিব। কিন্তু, ‘দারিদ্র’ আর্থিক হয় না, কিছু কিছু দারিদ্র থাকে ‘মানসিকতা’-তেও। যে গ্রামে এই স্কুলটি অবস্থিত, সেই গ্রামের পঞ্চায়েত অফিসটি কিন্তু ঝাঁ-চকচকে। থানা, বিডিও অফিস, ভূমি রাজস্ব দফতরের অফিস-সহ বিভিন্ন সরকারি দফতরেই সংস্কারের ছোঁয়া লেগেছে, একাধিক দফতরে বসেছে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, শৌচালয়ে পাতা হয়েছে টাইলস। শুধু স্কুলগুলিতেই ‘নেই নেই’ রব। পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, শ্রেণিকক্ষে যথেষ্ট আলো-বাতাস নেই, বিদ্যালয়-চত্বর, শৌচালয় ইত্যাদি পরিষ্কার রাখার পর্যাপ্ত তহবিল নেই, মিড-ডে মিলের পাতে পর্যাপ্ত পুষ্টির আয়োজন নেই। নেই শিক্ষাদানের জন্য আধুনিক কোনও বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি বা পরিকল্পনা। শিক্ষাখাতে এ-হেন দৃষ্টিভঙ্গি আসলে মানসিক দেউলিয়াপনারই প্রকাশ।

খামতি রয়েছে পঠনপাঠনের পদ্ধতিতেও। অবশিষ্ট পৃথিবীর শিক্ষাজগতে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে, শিক্ষাবিজ্ঞানের ধারাবাহিক গবেষণা শিক্ষাদান তথা পঠনপাঠন পদ্ধতিতে যুগান্ত ঘটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমরা এই একবিংশ শতাব্দীর দু’টি দশক অতিক্রম করেও আটকে আছি সেই সাবেক চক-ডাস্টার-ব্ল্যাকবোর্ড এবং লেকচার মেথডে। ইদানীং শিক্ষকেরা লাঠির ব্যবহার একটু কমিয়েছেন বটে, তবে তাও অন্তরের টানে নয়, নেহাত-ই চাকরি হারানোর ভয়ে। না হলে এ রাজ্যের অধিকাংশ শিক্ষকই আজও পথের পাঁচালী-র প্রসন্ন গুরুমশায়ের পথেই আস্থাশীল।

শিক্ষাবিজ্ঞানের নতুন উদ্ভাবন, সাম্প্রতিকতম গবেষণার ফল সম্পর্কে শিক্ষকদের অবহিত করার দায় সরকারের। নিয়মিত ট্রেনিং, রিফ্রেশার কোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে এই কাজটি চালিয়ে যেতে হয়। আমাদের সে সবের বালাই নেই। সর্বশিক্ষা মিশনের পৃষ্ঠপোষণায় এ রকম কিছু ট্রেনিংয়ের আয়োজন মাঝেমধ্যে হয় বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, ভাল-মন্দ খাওয়াদাওয়া আর দিনভর গুলতানি ছাড়া সেখানে বিশেষ কিছুই হয় না।

ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্মার্টফোন, এককালীন মোটা অঙ্কের নগদ টাকা বিলি, বা আবহাওয়া একটু প্রতিকূল হলেই ছুটি ঘোষণা করে দেওয়ার রাস্তা ছেড়ে এ বার রাজ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করে তোলার কাজ শুরু করা দরকার, এখনই।

Education Sector rural areas West Bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy