উল্লাস: বহরমপুরে রামনবমী উপলক্ষে মিছিল। ১৭ এপ্রিল, ২০২৪। পিটিআই।
ভেবে দেখলাম, এ পোড়া ভারতে খাবার, বাসস্থান, জল, কোনও কিছুরই অভাব নেই। সবই পর্যাপ্ত রয়েছে, শুধু অভাব ছিল ধর্মের। আর যদি বা তা রয়েছে, তা ভয়ানক বিপন্ন। নইলে আর সব ছেড়ে দেশের প্রধান শাসক দল এবং প্রধানমন্ত্রী হিন্দু-মুসলিম, মঙ্গলসূত্র নিয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়বেন কেন? আর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন পশ্চিমবঙ্গে এসে বলে যান যে হিন্দুরা এখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, এবং নাগরিক সমাজ থেকে তার কোনও সর্বব্যাপী প্রতিবাদ হয় না, তখন মনে হয়, নাহ্। আমাদের নিয়ে তৈরি মনুষ্যসমাজ তথা ভোটারসমাজ হয় মেরুদণ্ড হারিয়েছে, নয় ভিতরটা পচে গলে গিয়েছে।
মফস্সলের মিশনারি স্কুলে পড়ে বড় হওয়া আমাদের প্রথম শ্রেণিতে একটি ছোট্ট বইয়ে রামায়ণ-মহাভারত, সব ধর্মগুরুর জীবন পড়তে হত। মৌখিক পরীক্ষাও হত জীবনীগুলো নিয়ে। স্কুলে বাইবেল ক্লাস ছিল, তা সকলেই করত, পরীক্ষাও হত, তবে তা ছিল ঐচ্ছিক। কোনও অভিভাবক এতে কোনও দিন আপত্তি করেছেন বলে কানে আসেনি, এখন হলে বোধ হয় কেন বাইবেল জোর করে পড়ানো হচ্ছে, এই প্রশ্ন তুলে স্কুলই ভেঙে দেওয়া হত। স্কুলে প্রাইজ় দেওয়া হয়েছিল মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু— সেই কারবালা যুদ্ধের গল্প। সকালের প্রার্থনাসভায় খ্রিস্টসঙ্গীতের সঙ্গে গাইতে হত রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘তুমি যদি থাক মনে, বিকচ কমলাসনে’ গাওয়া হচ্ছে আর বড়দি— কেরলের এক খ্রিস্টানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, এ দৃশ্য যারা দেখেছে তারা ভোলেনি। স্কুলের বাইরে ছিল মাজার, এখনও রয়েছে, ভিতরে চ্যাপেলে মাথা ঠেকিয়ে মেয়েরা অঙ্ক পরীক্ষা দিতে যেত। এটা শুধু আমাদের সময়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, এটা প্রজন্মের পর প্রজন্মের অভিজ্ঞতা। কারণ এটাই তখন স্বাভাবিক ছিল। স্কুলে সরস্বতী পুজো হত না বলে হয়তো মন খারাপ হত, কিন্তু কেন স্কুলে সরস্বতী পুজো হবে না, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি, মাথাও ফাটায়নি।
আসলে বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে যা শুরু করা হয়েছিল, তা এখন চরম রূপ পেয়েছে। শাসক দল এটুকু মানুষের মনে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পেরেছে: ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ, এখানে মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন সকলেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, দয়া করে থাকতে দেওয়া হয়েছে তাই আছে। এখানেই ভারতের সবচেয়ে বড় ক্ষতি, যা অন্তত এই মুহূর্তে প্রশমনযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। আমরা চিরকাল, এবং হ্যাঁ, আমরা বাঙালিরা চিরকালই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলাম, হালে সাম্প্রদায়িক হয়েছি, এই সব ন্যাকামি করে কোনও লাভ নেই, আমরা ভিতরে ভিতরে সাম্প্রদায়িক নিশ্চয়ই ছিলাম, এখন জল-বাতাস পেয়ে ফনফন করে বেড়ে উঠেছি।
আগে বাসের ভিতর বসে গজগজ করতাম, কী করে রাস্তা জুড়ে নমাজ পড়ে, এখন বুক চাপড়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় চিৎকার করে বলি। প্রশ্ন হল, রেড রোডে নমাজ পড়তে এসে কেন জাতীয় পতাকা কাঁধে করে নিয়ে আসতে হবে? পুজোর সময় প্যান্ডেলে জাতীয় পতাকা লাগান কি? এগুলো দেখে তো লজ্জা পাওয়া উচিত, কান্না পাওয়া উচিত আত্মদহনে যে, দেশটাকে এতটাই একধর্মীয় করে ফেলেছি আমরা যে অন্য ধর্মের লোকদের জাতীয় পতাকা তুলে প্রমাণ করতে হচ্ছে যে তাঁরা ভারতীয়! বহু, বহু বছর আগে সাহিত্যিক আবুল বাশার এই পত্রিকায় একটি রিপোর্ট লিখেছিলেন, মুসলিম মেয়েরা কী ভাবে নাম বদলে বাড়িতে বাড়িতে কাজ করেন। এই ঘটনা আজও সত্য। কারণ আমরা সাম্প্রদায়িক, এবং যত দিন যাচ্ছে, আরও বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছি। এবং আমাদের কোনও প্রতিবাদ নেই। কারণ আমাদের অধিকাংশ নাগরিক নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন, যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে। বড্ড বাড় বেড়েছে ‘ওদের’।
তেমনই হয়েছে বিরোধী দলের ভূমিকা। হয় তিন তালাকের মতো অবক্ষয়ী প্রথা নিয়ে তারা চুপ করে বসে থাকে, ভোটব্যাঙ্ক কোথায় যাবে বুঝতে না পেরে নীরবতাই শ্রেয় বলে মনে করে, অথবা দলের সংখ্যালঘু নেতা কেটে ফেলার হুমকি দিলেও চুপ করে থাকে। সততার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিবাদ করা এদের ধর্মে নেই। বরং আছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ধর্মের বীজে সার দেওয়া। ভোটের সময় ধর্মস্থানে গিয়ে মাথা ঠেকাতে সকলেই ওস্তাদ। ভুলে গেলে চলবে না, শাহবানু মামলায় ঐতিহাসিক রায়ের পর হিন্দুদের তুষ্ট করতে অযোধ্যায় রামলালার মন্দিরের তালা খোলা হয়েছিল রাজীব গান্ধী সরকারের আমলে। এই ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও অর্থ নেই, কার্যকারিতাও নেই।
খুব পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া ভাল যে, ধর্ম দিয়ে আপনার ঘরের উনুন জ্বলবে না, ছেলেমেয়ের চাকরি হবে না, হাসপাতালের বিল দেওয়া যাবে না, ঘরের ছাদ হবে না, পরনের কাপড়ও হবে না, আর মৃত্যুও আটকাতে পারবেন না। আজ মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধকে জুতোর তলায় রাখবেন, রাখুন। পর দিন তো আপনার নতুন জুতো লাগবে, আর সেই জুতোর তলায় নতুন কাউকে রাখার জন্য পা চুলকাবে, আপনার চিন্তন-মালিকদেরও পা চুলকাবে, তখন কী হবে? তখন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, এই ভাবে ভাগ হতে হতে জুতোর তলায় আসবে। ধনী, দরিদ্র, শাসক, বিরোধী, নিরামিষাশী, আমিষভোজী ভাগাভাগি তো ছেড়েই দিলাম। আপনি কোন জুতোর তলায় পড়বেন, সেটা ঠিক করে নিতে পারেন এখন থেকেই।
চলতি বিতর্কে গলা মেলানোর আগে তাই বাস্তবটা জেনে নিন। ভারতে সব ধর্মেরই টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর (অর্থাৎ, এক জন মহিলা গড়ে মোট যতগুলি শিশুর জন্ম দেন) কমেছে— ২০১৯-২১ সালের পঞ্চম জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা বলছে, জাতীয় গড় টিএফআর নেমে গিয়েছে রিপ্লেসমেন্ট লেভেল ২.১-এর নীচে। ১৯৯২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হিন্দুদের টিএফআর ৩.৩ থেকে কমে হয়েছে ১.৯; মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা ৪.৪ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২.৪-এ। অর্থাৎ, মুসলমানদের মধ্যে সন্তানের জন্মের হার কমেছে তুলনায় অনেক বেশি হারে। এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ২০০৬ সালে বলেছিলেন (যার প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল), “আমাদের অগ্রাধিকার স্পষ্ট। কৃষি, সেচ, জল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা... তফসিলি জাতি, জনজাতি, অন্য অনগ্রসর শ্রেণি, সংখ্যালঘু, মহিলা এবং শিশুদের জন্য কর্মসূচি। আমাদের নতুন ভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলমানরা উন্নয়নের সুফল সমান ভাবে পাওয়ার ক্ষমতা লাভ করেন (এমপাওয়ারমেন্ট)। সম্পদের উপর তাঁদের প্রথম অধিকার।”
অতএব ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে ক্ষুধানিবৃত্তি আগে দরকার না মন্দির নিয়ে উন্মাদনা, তা বুঝে নিতে হবে। ধর্মবিশ্বাস এক কথা, পুজোপাঠ এক কথা। ধর্মের নামে অন্যের গলা কাটার সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। দেশভাগের দোহাই দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার সমর্থন করবেন না। আজ যারা মাথায় ফেট্টি বেঁধে সাম্প্রদায়িক গলা ফাটাচ্ছে, সেই তরুণ বা যুবকদের সঙ্গে দেশহারা মানুষের দুঃখের, শোকের, মৃত্যুর কোনও যোগ নেই। এই দেশেরই খেয়ে-পরে এই দেশেরই সর্বনাশ করবে, দেশের লোককেই মারবে, এ তো চলতে পারে না।
এগুলো বুঝলে ভাল। নইলে ফায়ারিং স্কোয়াড অপেক্ষা করছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনারই জন্য।
সব মৃত্যুই শারীরিক নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy